মাশরুম

মাশরুম একটি অত্যন্ত সুস্বাদু খাদ্য, যাকে আমরা সবজির মধ্যে আমিষ বলি।মাশরুমের খাদ্যগুণও প্রচুর, যা নিরামিষাশীদের দেহে অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলির চাহিদা মেটায়। তাই বলে সব মাশরুমই খাদ্য নয়, এমনকি হাতে ধরার জন্যও নিরাপদ নয়। কোন মাশরুম আমরা খাই? আর কোনগুলো বিষাক্ত? আসুন, আজ জেনে নিই মাশরুম নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
মাশরুম একধরনের ছত্রাকের মাংসল দেহ বা ফল যা মাটি, পচা খাবার, উদ্ভিদ কিংবা অন্যকোনো জৈব অংশের উপর জন্মায় এবং পরজীবীর মতো বেঁচে থাকে।আমরা সেগুলিকে ব্যাঙের ছাতা বলি মূলত রং ও মজাদার আকৃতির কারণেই। কিন্তু দেখতে যতই আকর্ষণীয় হোক, মাশরুমের গায়ে হাত দেবার আগে এবং বাজার চলতি যেকোনো মাশরুম খাবার আগে সতর্কতা অবলম্বন করুন। আগে জেনে নিন ঠিক মাশরুম বাছছেন কিনা।


মাশরুম গোষ্ঠীর পরিচিতি
খাবার মাশরুমের বিজ্ঞানসম্মত নাম আগারিকাস বিস্কোরাস; ‘মাশরুম’ কথাটি সাধারণত এগুলির জন্যই প্রয়োগ করা হয়। এই গোষ্ঠীর সমস্ত ছত্রাকের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। ছত্রাকগুলির কান্ডের ওপর থাকে একটি টুপি আকৃতির মাথা। টুপির নিচে থাকে লামেলা বা ফুলকার মতো গিল।এই গিলগুলি আনুবীক্ষনিক ছিদ্র বা স্পোর তৈরি করে যা ছত্রাককে জমি বা এর ধারক পৃষ্ঠের উপর নিজেকে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে।
তবে, সাধারণ গোত্র থেকে বিচ্যুত হলেও “বোলেট”, “পাফবল”, “স্টিঙ্কহর্ন”, “মোরেল” জাতীয় ছত্রাক এবং ফুলকা বা গিল সমেত যেকোনো ছত্রাককেও প্রায়শই আগেরিকাসের সঙ্গে মিলের জন্য “অ্যাগ্রিক” বলা হয়। তাই, বড় অর্থে “মাশরুম” বলতে গোটা ছত্রাক প্রজাতি এবং মাইসেলিয়াম নামক ছত্রাক যার ফলের নাম মাশরুম সেটিকেও বোঝানো হয়।

নামকরণ বৃত্তান্ত

mushroom house 4022480 1280
source: needpix.com


১৫ থেকে ১৬ শতকের মধ্যেই ‘মাশরুম’ কথাটির চল হয়। এর আগে মাশরুমের কোন নাম বা সংজ্ঞা কিছুই পাওয়া যায়না। ফরাসী শব্দ ‘মুসেরন’(mousseron)যা মস বোঝাতে ব্যবহৃত হতো সেখান থেকেই মাশরুম এবং তার বাকি সমস্ত প্রকারভেদের নামের উৎপত্তি।যদিও সুস্বাদু মাশরুম, তেতো মাশরুম কিংবা বিষাক্ত মাশরুম আপনি নাম দিয়ে চিনতে পারবেন এমন কোন উপায় ছিলনা।তবে ইংল্যান্ডের উইলিয়াম হেয়ে নামের এক ব্যক্তি ‘ছত্রাকের ভয়’ ( ফাঙ্গিফোবিয়া) কথাটির উদ্ভব ঘটান, যাতে বোঝা যায় মাশরুম বা ব্যাঙের ছাতার ক্ষতিকর দিকগুলির ভয়ে মানুষের মনে বেশ কিছু কুসংস্কার তৈরি হয়েছিল।বিদেশি রূপকথায় ব্যাঙের ছাতার অনুষঙ্গ বারবার এসেছে। সেখানে গল্পে দেখা যায় ব্যাঙেরা এইধরনের ছত্রাকের নিচে বসে লম্বা জিভ বাড়িয়ে পোকা শিকার করে চলেছে।

যে মাশরুম আমরা খাই
সাধারণত আকৃতিতে বড়, গোলাকার, সাদা রঙের মাশরুম আমাদের খাওয়ার উপযুক্ত। এগুলি মাটির ওপরে বা নীচে হয়। ভোজ্য মাশরুমগুলি তাদের পুষ্টি গুণ এবং স্বাদ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে।

White button mushroom


খাবার মাশরুমের মধ্যে ভারতের বাজারে সাধারণ এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় হোয়াইট বাটন মাশরুম। এর আরেক নাম চাষের মাশরুম। সাদা এবং বাদামি এই দুরঙের হতে পারে। মাশরুমগুলির গন্ধ খুব মৃদু। কাঁচাও খাওয়া যায় আবার সালাড, পিৎজা কিংবা তরকারির মধ্যেও খেতে পারেন।কম ক্যালরির এই মাশরু্মে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি6 এবং ভিটামিন ডি থাকে যা শরীরের ১00রকম ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। এছাড়াও এই মাশরুম খেলে ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের সম্ভাবনা দূরে থাকে।

Shitake mushroom

shiitake mushrooms 732x549 thumbnail
source: healthline


শুকনো মাশরুম যেমন শিটেকের খুব সুন্দর গন্ধ যা অনেক খাবারের সঙ্গে ভালো লাগে। এটি জাপানের মাশরুম কিন্তু কয়েকটি বিশেষ কারণে সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয়।শিটাকে কথাটির জাপানি ভাষায় অর্থ- ওক গাছের ছত্রাক। টাটকা হলে এগুলি থেকে ভেজা কাঠের গন্ধ বেরোয়।এটি শুকনো অবস্থাতেও খুবই সুস্বাদু এবং সুগন্ধি। অনেক খাবারের সঙ্গে শিটাকে খাওয়া যায়।অনেকটা মাংসের মতই চিবোতে লাগে।স্বাদ গন্ধ ছাড়াও এর সবথেকে গুরুত্ব স্বাস্থ্যকর উপাদান হিসেবে। এটি সমস্তরকম রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে এবং বার্ধক্য দূরে রেখে আপনাকে চির যৌবনের সতেজতা দিতে পারে।

Portobello mushroom

Portobello Mushrooms
https://www.google.com/url?sa=i&url=https%3A%2F%2Fwww.welcometothetable.coop%2Ffresh-from-the-source%2Fportobello-mushrooms&psig=AOvVaw1b8SPa1YNj-Tck07924xn2&ust=1608098251924000&source=images&cd=vfe&ved=0CA0QjhxqFwoTCLiu_fumz-0CFQAAAAAdAAAAABAD


ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার ঘাসজমিতে একধরণের প্রাচীন প্রজাতির মাশরুম হয় যেটি সাধারনভাবে সারা পৃথিবীতে খাওয়া হয় এমন মাশরুমগুলোর একটি। এর নাম পোর্তোবেলো।কচি অবস্থায় এগুলির নামই সাদা বোতাম বা হোয়াইট বাটন মাশরুম।বাদামি রঙের এই মাশরুমে মাটির মতো গন্ধ হয়।এতে তামা এবং সেলেনিয়ামের পরিমাণ খুব বেশি থাকায় শরীরের কলা-কোশের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায় এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।

Oyster mushroom

oystermushrooms bannersnack
https://www.chelseagreen.com/wp-content/uploads/oystermushrooms_bannersnack-820×410.jpg



ঝিনুক বা অয়েস্টার মাশরুম সবথেকে বড় আকৃতির খাদ্য মাশরুম। এগুলি মূলত পচে যাওয়া, জল বসা কাঠের ওপর জন্মায়। বর্ষাকালে এধরণের মাশরুম অনেকেই দেখে থাকবেন। এই বুনো মাশরুম গোটা পৃথিবী জুড়েই জনপ্রিয়। ভেলভেটের মতো তুলতুলে মাংসের এই মাশরুমের স্বাদ মিষ্টি এবং গন্ধ মৃদু, অনেকটা মৌরির মতো। ঝিনুকের মতো আকৃতির কারণেই এটির নাম অয়েস্টার মাশরুম।
এটির পুষ্টিগুণ অনেক। সমস্তরকম ভিটামিন ও মিনারেলসের গুনে এটি ভরপুর এবং সেইসঙ্গে ফ্যাট ফ্রি।

Enoki mushroom


এনকি, যার আরেকটা নাম এনোকিটাকে হল পূর্ব এশিয়ার একটি শীতকালীন মাশরুম।এদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চকচকে সাদা টুপি যুক্ত মাথার নীচে লম্বা সাদা লেজের মতো কাণ্ড দেখতে খুব সুন্দর।এগুলিতে ফলের মতো গন্ধ হয়। তরকারি করে খাওয়া ছাড়াও পিৎজা, পাস্তা, সালাড, সুপ কিংবা স্যান্ডউইচে এই মাশরুম খুবই উপাদেয়।এতে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, আয়রন, কপার, ফসফরাস ও সেলেনিয়াম থাকে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রন করে। মেদ কমাতেও ডায়েটে রাখা যায় এই সুস্বাদু মাশরুম।

Porcini mushroom


পরকিনি মাশরুম ইতালিয়ান রান্নার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। বেশ বড় আকারের টুপিজুক্ত মাশরুমগুলি প্রায় ১২ ইঞ্ছি অবধি লম্বা হয়। পরকিনি মাশরুমের রং ও প্রজাতি নানা রকমের হয়। কাঠ এবং বাদামের ঘ্রাণযুক্ত হওয়ায় খাদ্যরসিকদের মহলে পরকিনি অত্যন্ত প্রিয় একটি খাদ্য। গ্রেভি জাতীয় খাবার যেমন সুপ, ব্রথ, সস, পাস্তা প্রভৃতিতে এই মাশরুম দেওয়া হয়।
এতে প্রোটিন এবং ফাইবারের পরিমাণ বেশি। পেশির স্বাস্থ্য রক্ষায়, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে, এবং কোষ্ঠ পরিশোধনে এই মাশরুম বেশ কার্যকরী।

Paddy straw mushroom


প্যাডি স্ট্র মাশরুমের চাষ করা সবচেয়ে সহজ। ১৯৪০ সালে প্রথম চাষ হয়েছিল ভারতবর্ষে। স্বাদ গন্ধ এবং পুষ্টিগুণের দিক থেকে সাদা বোতাম মাশরুমের মতই জনপ্রিয় প্যাডি স্ট্র। ফোলাফাঁপা গদিযুক্ত এই মাশরুমে থাকে প্রচুর প্রোটিন, আয়রন, ফাইবার, ফলিক অ্যাসিড, এবং ভিটামিন বি, ডি ও সি। পটাশিয়াম এবং কপারের পরিমাণও এতে কম নয়। সব মিলিয়ে এর উপকারিতা অনেক। হার্টের অসুখ থেকে শুরু করে রক্তাল্পতার সমস্যায়, অস্থি দুর্বলতায়, ডায়াবেটিস এবং হজমের সমস্যায় এটি অসম্ভব কার্যকরী একটি ওষুধের মতই ক্রিয়াশীল।



এছাড়াও বিভিন্ন দেশে লব্ধ অনেক প্রজাতির খাদ্য মাশরুম রয়েছে, যাদের এগুলির সঙ্গে গঠন ও উপাদানের দিক থেকে অনেক মিল। যেমন- পূর্ব এসিয়ার শিমেজি, মাইটাকে, হেজ হগ, মরেল, ছান্তেরেল, ক্ল্যামশেল এবং লবস্টার মাশরুমেরও স্বাদ এবং উপকারিতার কারণে বিশ্ব জুড়েই চাহিদা রয়েছে।



মাশরুমের বিষক্রিয়া

মাশরুম ভালবাসেন? সাবধান! আগে জেনে নিন এই কয়েকটি বিষয়।


খেতে খুব ভাললাগলেও আমাদের অনেরকেরই মাশরুম হজম করার ক্ষমতা নেই।বুনো মাশরুম খাওয়ার ২৪ঘন্টার মধ্যেই হতে পারে অ্যামাটক্সিন বিষক্রিয়া।সেক্ষেত্রে বাঁচার সম্ভাবনা থাকেনা বললেই চলে। এছাড়া সাধারণ মাশরুম থেকেও হতে পারে মাথা ধরা, বমি, পেট ব্যথা এমনকি সংজ্ঞা হারানোর মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তাই যদি প্রথমবার মাশরুম খাবার পরিকল্পনা করেন, সঠিক খাদ্য মাশরুম কিনে খুব অল্প পরিমাণে আগে খেয়ে দেখুন।বাজার থেকে কিনে এনে আগে গরম জলে আধঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন যাতে মাশরুমের বিষাক্ত উপাদানগুলো বেরিয়ে যায়।রান্না না করে মাশরুম খেলে বিষক্রিয়া হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।


বিষাক্ত মাশরুম চেনার উপায়


খুব রংচঙে ছত্রাক দেখলে সাবধান। গভীর জঙ্গলে অনেক বুনো ছত্রাক হয়ে থাকে যেগুলি দেখতে খুব সুন্দর এবং তা থেকে উগ্র গন্ধও বেরোয়।এগুলোর বেশিরভাগই বিষাক্ত। শিকার ধরার জন্যই বিষাক্ত মাশরুমগুলি আকর্ষণীয় চেহারা নিয়ে বসে থাকে। ওদের ফাঁদে পা দিলেই মৃত্যু। অনেক সময় মাশরুমগুলির কাছাকাছি গোটা বাতাস বিষাক্ত হয়ে থাকে, তাই কাছে না যাওয়াই ভালো। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাতটি মাশরুম হল- ডেথ ক্যাপ, কনসি বেট্টিলারিস, ওয়েব ক্যাপ, অটম স্কালক্যাপ, ডেস্ট্রয়িং অ্যাঞ্জেল, পডস্ট্রন আ করনু-দেমে এবং ডেডলি ড্যাপারলিরি।

মাশরুম নিয়ে জরুরী কিছু তথ্য

১। জিনগতভাবে মাশরুম উদ্ভিদের তুলনায় মানুষের বেশি কাছাকাছি। ১৩০০ লক্ষ্য বছর আগে থেকেই মাশরুমের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
২। মানুষের মতই শ্বাসগ্রহনের সময় মাশরুম বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয় এবং নিশ্বাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ে।
৩। আপনার পায়ের নীচে ৮০ শতাংশেরও বেশি মাটি ছত্রাকের অংশ বা মাইসেলিয়াম দিয়ে তৈরি।
৪। মাশরুম বা ব্যাঙের ছাতার মতো অংশটি আসলে মাইসেলিয়ামের ফল, যা সমগ্র ছত্রাক দেহের ৫ শতাংশেরও কম।
৫। পৃথিবীর বৃহত্তম জৈব উপাদান হল হানিফাঙ্গাস যা একটি মাশরুম। এর বিস্তৃতি ২.৪ মাইল!
৬। প্রকৃতির সবচেয়ে শক্ত প্রাকৃতিক উপাদানটি হল স্পোরোপোলেনিন যা মাশরুমের স্পোরগুলি দিয়ে তৈরি।
৭। মাশরুমের স্পোরগুলি শূন্যমাধ্যমে এবং মহাজাগতিক বিকিরণের মধ্যেও বাঁচতে পারে।
৮। ডেথ ক্যাপ ছত্রাক (অমানিটা ফ্যালোয়েডস) পৃথিবীর সর্বাধিক বিষাক্ত জীব। এগুলিতে আমাটক্সিন থাকে, একবার যদি কারও পেটে যায় তার আর বাঁচার আশা নেই।
৯। সিলোসাইবিন মাশরুমকে বলা হয় ম্যাজিক মাশরুম কারণ তা বিভিন্নপ্রকার মানসিক সমস্যা, অবসাদ এবং নেশার আসক্তি কাটাতে পারে বলে বর্তমানে গবেষণা চলছে।
১০। মাশরুমের স্বাদ ভাল, নিখরচাতেও পেতে পারেন। শুধু চিনতে হবে কোনগুলো খাবার আর কোনগুলো বিষাক্ত।
১১। একটি পোরটাবেলা মাশরুমে একটি কলার থেকেও বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে।
১২। পৃথিবীতে যত মাশরুম উৎপন্ন হয় তার ৫০ শতাংশই হয় চীনে।

আপনার পছন্দের মাশরুম রেসিপি জানিয়ে নীচের বক্সে কমেন্ট করুন। আর পড়তে থাকুন বাংলা খবর।

https://www.banglakhabor.in/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%b2-%e0%a6%a4%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%8f%e0%a6%87-10-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%ac%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%9c/