আচ্ছা কেমন হবে যদি আপনার চরম আর্থিক সংকটের কথা জানতে পেরে আপনার প্রিয় মানুষ, প্রিয় তারকাটি নিজে থেকেই আপনাকে কিছু আর্থিক সাহায্য পাঠিয়ে থাকে?
– ধুস তা হয় নাকি !
এটাই হবে সম্ভবত আপনার উত্তর। কারণ এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আপনি জেনে এসেছেন প্রিয় তারকারা দূরের তারা হয়েই থেকে যান। সেটাই স্বাভাবিক।

আচ্ছা বেশ। এবার ধরুন হঠাৎ করে আপনার একাউন্টে আপনার প্রিয় তারকা নিজে থেকেই প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিলেন, যাতে আপনি এই সংকটজনক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার রসদ পান!! তারপর আপনাকে একটা ছোট্ট বার্তা পাঠিয়ে জানাল “তুমি আমার কাছের মানুষদের অন্যতম একজন, তাই তোমার এই দুঃসময়ে পাশে থাকার একটা ছোট্ট চেষ্টা করলাম!”
– আরে দাদা বুঝতে পারছি আপনি গতরাতে খুব সুন্দর কিছু স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু ওটা স্বপ্ন, বাস্তবে এরকম হয়না। বাস্তবে ফিরে আসুন না হলে মাথাটা যাবে যে!
আপনার এই প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক। কারণ আপনার দুঃসময়ের কথা আবেগ তাড়িত হয়ে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে ফেলেছিলেন। ওরকম তো কত হাজার লক্ষ মানুষ লেখে, তাতে কী এলো গেলো!
– আমার সমস্যার কথা আলাদা করে দেখতে বয়েই গেছে প্রিয় তারকার। তার‌ ওপর নাকি নিজের উদ্যোগে আমার মত একজন সাধারনকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন! আরে দাদা, আমার প্রিয় তারকা মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তার জন্য প্রতিনিয়ত নানান চ্যারিটি ট্রাস্ট স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে অর্থ সাহায্য করে। তারাই যা করার করে। এইরকম বড় মানুষরা নিজে থেকে কিছু করে নাকি ?

মানুষ,
The New York Times

ঠিক এ রকমই অবস্থা হয়েছিল নিউইয়র্ক সিটির হলি টার্নারের। করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর লকডাউনের কারণে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায় এই ফ্রীল্যান্স ফটোগ্রাফারের। তার এই দুরাবস্থার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন। সেইসঙ্গে জানিয়েছিলেন নিউইয়র্ক সিটি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন তিনি। এরপরই ঘটে মিরাকেল। তার প্রিয় তারকা নিজে থেকে তাকে ৩ হাজার ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা প্রায়) আর্থিক সাহায্য পাঠায়!

হ্যাঁ টেইলর সুইফটের কথা বলছি। কেবলমাত্র হলি টার্নারকেই নয়, করোনা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া অনেক ভক্তের সাহায্যেই স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন তিনি। আজ সেই টেইলর সুইফটের জন্মদিন।

মানুষ
Deseret News

এই দিনটাকে কি শুধুমাত্র একজন বিশ্ব বিখ্যাত পপ ও কান্ট্রি গায়িকার জন্মদিন হিসাবেই আমরা মনে রাখব, নাকি দেখব মানবিক এক মানুষের জন্ম হওয়ার বর্ষপূর্তি উৎসব হিসেবে ? নাকি মনে রাখব সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে বিন্দুমাত্র পিছপা না হওয়া সোজা মেরুদন্ডের একজন শিল্পীর জন্মদিন হিসাবে? নাকি মনে রাখব পশ্চিমা সংস্কৃতির বিতর্কিত যৌন আবেদনময়ী এক পপ গায়িকা হিসাবে?

আসলে এই সবকটা নিয়েই টেইলর সুইফট। একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আপনি যদি নিজের ভাবনা মতো ছকে বেঁধে ব্যাখ্যা করতে চান ৩০ বছরেই কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া এই মার্কিন গায়িকাকে, তাহলে আপনার থেকে সবচেয়ে বড় ভুল আর কেউ করবে না। ছক ভাঙতেই জন্ম নিয়েছিলেন তিনি।

না হলে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের সঙ্গে হওয়া বর্ণবিদ্বেষী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে স্বয়ং মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে গদি থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে পারেন তিনি ! আসলে তা কি ছিল নিজের প্রতি, মানুষের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। সেই হুঁশিয়ারি বাস্তবায়িত হয়ে সত্যিই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরাজিত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প , আর কয়েক দিনের মধ্যেই গদি ছাড়তে হবে তাকে। ফ্লয়েড জর্জ হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলন গড়ে ওঠে আমেরিকায়। এই আন্দোলন সেখান থেকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন টেইলর সুইফট। সেক্ষেত্রে তার ভক্তকুল হারানো বা সঙ্গীত ক্যারিয়ারে প্রভাব পড়ার বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেননি তিনি। ভাবেননি কারণ তার মনে হয়েছিল এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত, মনে হয়েছিল মানুষ আগে বাকি সবকিছু তারপর।

এই ভাবনার পথ চলা শুরু হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে। বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করে সনি মিউজিক পাবলিশিং গ্রুপ ওই বয়সেই গায়িকা হিসাবে তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০০৬ সালে প্রথম প্রকাশ পায় তার নিজের লেখা ও গাওয়া গান “টিম ম্যাকগ্রো”। এই সাফল্যের শুরুর বছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম অ্যালবাম। যার নামকরণ করা হয় তার নামেই, “টেইলর সুইফট”।

তার দ্বিতীয় অ্যালবাম “ফিয়ারলেস” ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়। যা প্রকাশ পাওয়ার পর অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায় বিশ্বজুড়ে। রেকর্ড সৃষ্টি করে এই অ্যালবামটি সঙ্গীত ভক্তরা ২.১ মিলিয়ন বার অনলাইনে শোনেন, মা নতুন শতাব্দীতে এখনো অব্দি বিশ্ব রেকর্ড। এই বছর তিনি আবার আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এই নিয়ে টানা তিন বছর এই অ্যাওয়ার্ড পেয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করলেন, যা এর আগে কেউ পায়নি। এই রেকর্ড সৃষ্টি করার পথে তিনি জাস্টিন বিবারের মত জনপ্রিয় পপ শিল্পীকে পেছনে ফেলেন।

তার অদম্য মনের জোরের পরিচয় পাওয়া যায় যখন জানা যায় তার প্রথম ৬ টি মিউজিক অ্যালবামের মাস্টার কপির ওপর তারার অধিকার নেই ! ঘটনা হল এই মিউজিক এ্যালবামগুলি প্রকাশ হয়েছিল বিগ মোশন লেভেল গ্রুপ থেকে। এই বছরের অক্টোবর মাসে হঠাৎ জানা যায় ওই মিউজিক কোম্পানির মালিক স্কুটার ব্রোন হঠাৎই টেইলর সুইফটকে কিছু না জানিয়েই এক ব্যক্তিকে ওই অ্যালবামগুলির মাস্টার কপি বিক্রি করে দিয়েছে। এই খবর জানাজানি হতে প্রাথমিকভাবে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিলেন এই সংগীতশিল্পী। তার পরেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন নতুন করে আবার রেকর্ড করবেন ওই ছটি অ্যালবামের সব কটি গান, কিন্তু বর্তমান মাস্টার রাইট যার কাছে আছে তার সঙ্গে কোনো কাজ করবেন না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁর সেই নতুন করে পুরানো গানগুলি রেকর্ড করার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হওয়ার মুখে।

মানুষ,
Pinterest

তার এই মনের জোর তৈরি হয়েছিল সম্ভবত ১১ বছর বয়সে। যখন তিনি নিজের লেখা ও গাওয়া গান রেকর্ড করে ন্যাশভিলের একের পর এক মিউজিক কোম্পানিতে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। এই বিশ্ব বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীর দিদা একজন বিখ্যাত অপেরা গায়িকা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর শুরু থেকেই ছিল কান্ট্রি মিউজিক এবং পপ গানের প্রতি ঝোঁক। নিজের সেই ইচ্ছের পথে হাঁটতে গিয়ে কোনো বাধাকেই বাধা বলে মনে করেননি তিনি। বারেবারে বিতর্কের জন্ম হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে, তবুও নিজের চলার পথেই এগিয়ে গিয়েছেন কারণ লক্ষ্য ছিল একের পর এক অসামান্য গান উপহার দিয়ে মানুষের মনকে ছুঁয়ে যাওয়া।

২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গান “লাভ সং” সম্বন্ধে একটি ইন্টারভিউয়ে বলতে গিয়ে জানান তার একজন ব্যক্তিকে ডেট করার খুব ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু সেই ব্যক্তি তার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। পরবর্তীতে যখন সেই ব্যক্তি তার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে তখন তার পরিবারের আপত্তিতে তা আর সম্ভব হয়নি। সেই না পাওয়া থেকেই এই বিখ্যাত গানের সৃষ্টি বলে জানিয়েছিলেন তিনি। আসলে তার সব গানই নিজের জীবন, জীবন ভাবনা থেকেই উঠে এসেছে। এক সময় জানিয়েছিলেন স্কুলে ছোটবেলায় সহপাঠীরা তাকে বুলিং করে বেশ কয়েকবার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ক্রমশ ভাবতে শুরু করেন স্কুলে গেলেই তাকে হেনস্তার সম্মুখীন হতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই তার প্রথম দিককার গানগুলি গড়ে তোলা হয়েছিল বলেই তিনি নিজেই জানিয়েছেন।

বর্তমান ওয়ার্ল্ড মিউজিকের অন্যতম সেরা নক্ষত্র টেইলর সুইফটের জন্মদিনে অনেক শুভেচ্ছা রইল। আমেরিকার পেনসিলভানিয়া প্রদেশ তার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সেই দিন থেকে তার যে চলার পথ শুরু হয়েছে আশা রাখবো আগামী দিনে আরো অনেক দুর্ধর্ষ গান উপহার দেওয়ার মধ্য দিয়ে তা বজায় থাকবে।
ভালো থাকবেন পপ সম্রাজ্ঞী!