তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি হলো এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল। তৃণমূল যেমন এই রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আছে, তেমনি ভারতীয় জনতা পার্টি অর্থাৎ বিজেপি কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় আছে। বিজেপি উদগ্রীব হয়ে উঠেছে সামনের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করতে, তেমনই তৃণমূল সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করছে যাতে এই রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় তারা থেকে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এই দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাকবিতন্ডা-চাপানউতোর চলছেই। আইন শৃঙ্খলা, কর্মসংস্থান, দুর্নীতি নানান বিষয়কে কেন্দ্র করে যেন কু-কথার ভাষার প্রতিযোগিতা চলছে রাজ্যে !
প্রতিটা রাজনৈতিক দল তার নিজের ভাবনা চিন্তা অবস্থান এবং আশু লক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে অন্য রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করে থাকে। তৃণমূল এবং বিজেপির এই নিত্য নৈমিত্তিক টানাপোড়েনের ফলে তৃতীয় একটি পক্ষের কিন্তু বেশ ভালই লাভ হচ্ছে। মানুষের কাছে তাদের একটা জায়গা ধীরে ধীরে ঠিক তৈরি হয়ে যাচ্ছে।হ্যাঁ, আমি বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস জোটের কথা বলছি। আমরা বরং একটু বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করি কিভাবে লাভবান হচ্ছে বাম-কংগ্রেস জোট।
১) আইন শৃঙ্খলা
তৃণমূলের সমালোচনা করতে গিয়ে বিজেপি প্রতি মুহূর্তে এই রাজ্যের আইন শৃঙ্খলাকে হাতিয়ার করে। সদ্য তাদের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার কনভয়ে পাথর ছোড়াকে কেন্দ্র করে তারা রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অভিযোগকে উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়েছে।
অন্যদিকে তৃণমূল দাবি করছে এই রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিজেপি শাসিত অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় যথেষ্ট ভালো। এই প্রসঙ্গে তারা উত্তরপ্রদেশের উদাহরণ বারবার তুলে আনে। প্রসঙ্গত বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশের মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে খারাপ। স্বাভাবিকভাবেই একটি বিজেপি শাসিত রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি তুলে ধরে নিজেদেরকে ভালো প্রমাণ করার চেষ্টা করে তৃণমূল। সেইসঙ্গে তারা বিজেপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ প্রতিনিয়ত করে থাকে। বলে রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করার জন্য মিথ্যা অভিযোগ করে বিজেপি।
তৃণমূল ও বিজেপির পরস্পরের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে রাজ্যবাসীর কাছে কিন্তু এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে তৃণমূলের শাসনে পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন যেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে তেমনি বিজেপির শাসনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বর্গতুল্য হয়ে যাবে তেমন ভাবাটা বোকামি হবে। আর ঠিক এই জায়গাটাতেই মানুষের মনে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করছে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস। তারা মানুষকে বোঝাতে চাইছে রাজ্যের হাল ফেরাতে হলে তৃণমূল এবং বিজেপি, উভয়কেই পরাজিত করতে হবে।
২) দুর্নীতি
দুর্নীতি রোধে বিজেপি যেমন তৃণমূলের বিরুদ্ধে সারদা নারদা আম্ফান ত্রাণ বিতরণ কাণ্ডগুলিকে মূল হাতিয়ার করে, তেমনি তৃণমূল বিজেপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হিসাবে নোট বন্দি ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। সেইসঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত বেশকিছু তৃণমূল নেতা দল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে যোগ দেওয়ায় তাদেরকে নিশানা করেতে কোনো অসুবিধা হয় না রাজ্যের শাসক দলের।
কিন্তু রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় না থাকায় এই দুর্নীতির কালি বাম-কংগ্রেস জোটের গায়ে সেভাবে লাগে না। বিশেষত বামফ্রন্টের গায়েতো একদমই লাগেনা। এই পরিস্থিতিতে বামেরা রাজ্যের মানুষকে বারেবারে বলতে পারছে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন পেতে চাইলে তাদের উপরেই ভরসা রাখা উচিত।
৩) অর্থনীতির বেহাল দশা
ঘটনা হল পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির যেমন দুরবস্থা চলছে তেমনি সমগ্র ভারতবর্ষের অর্থনীতির হালও বেহাল হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে পরস্পরকে আক্রমণ করতে গিয়ে তৃণমূল যখন দেশের অর্থনীতি বেহাল হওয়ার জন্য বিজেপির দিকে আঙ্গুল তোলে, তখন বিজেপির পক্ষ থেকে পাল্টা রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য তৃণমূলকে দায়ী করা হয়।
খুব স্বাভাবিকভাবেই বাম-কংগ্রেস জোট দেশ এবং রাজ্যের অর্থনীতির এই দুর্দশার জন্য তৃণমূল এবং বিজেপিকে তাদের যুক্তি দিয়েই আক্রমণ করে থাকে। ঘটনা হল রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু দেশের অর্থনীতি খারাপ হওয়ার জন্য মোদি সরকারকে যেমন দায়ী করে, তেমনি রাজ্যের অর্থনীতি সঠিক পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত করতে পারেননি বলেও তারা মনে করেন। এক্ষেত্রে রাজ্যের একটা অংশের মানুষের কাছে বিজেপি-তৃণমূলের বাইরে গিয়ে বিকল্প সম্ভাবনার চাহিদা ক্রমশ তৈরি হচ্ছে।
৪) সাম্প্রদায়িক রাজনীতি
বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার অভিযোগ তৃণমূল সহ সমস্ত বিরোধী দলই করে থাকে। বিজেপি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মধ্য দিয়ে মুসলমানদের অধিকার কেড়ে নিতে চায় বলে অভিযোগ করে তৃণমূল। অন্যদিকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ বারেবারেই তুলেছে বিজেপি।
পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার- ভোটারদের একটা বড় অংশই মনে করে তৃণমূল এবং বিজেপি উভয়ই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ভোট যুদ্ধে নিজেদের হাতিয়ার বানিয়ে তুলেছে। তৃণমূল প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির না করলেও তারা অনুচ্চারিত ভাবে মুসলিম তোষণ করে বলে একটা অংশের মানুষ মনে করেন। সেইসঙ্গে এই মানুষরাই মনে করেন বিজেপি হিন্দু তোষণের যে রাজনীতি করে সেটাও ভয়ঙ্কর। এই পরিস্থিতিতে ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন মানুষদের কাছে বিকল্প হয়ে দেখা দিয়েছে বাম-কংগ্রেস জোট। কারণ তারা বুঝতে পারছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাত থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে হলে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হলে বাম ও কংগ্রেসের ওপর ভরসা করাটাই একমাত্র পথ।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ শেষ পর্যন্ত কাদের প্রতি আস্থা রাখবে বা কাদের সঠিক বলে মনে করবে তা একুশের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরই বোঝা যাবে। কিন্তু তৃণমূল এবং বিজেপি প্রতিনিয়ত পরস্পরের প্রতি যে কাদা ছুঁড়ে চলেছে, তা থেকে গা বাঁচাতে রাজ্যের একটা অংশের মানুষের মধ্যে বিকল্প পরিসরের চাহিদা ক্রমশই তৈরি হচ্ছে। সেই পরিসর দখল করার প্রধান সুযোগ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের কাছেই। এখন দেখার তারা সেটা করতে সক্ষম হয় কিনা।