আরব দুনিয়ার সবচেয়ে প্রগতিশীল দেশ বলে মনে করা হয় কুয়েতকে। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে, আমার আপনার প্রগতির ধারণার সঙ্গে মেলাতে গেলে কিন্তু সবটা গুলিকে যাবে। আপনাকে এই তুলনা করতে হবে আরব দুনিয়ার বাকি দেশগুলির প্রেক্ষিতে। কারন আমরা সবাই জানি আরব দুনিয়া মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার আরব প্রধান দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত। সমাজ ব্যবস্থায় কুয়েতের সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলো সেদেশের মেয়েদেরকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর তুলনায়। বেশিরভাগ আরব রাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় দেশগুলোতে নারীরা যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা পায় সেখানে কুয়েতের সমাজ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে অংশগ্রহণ করতে পারে নারীরা।
তা বলে আমরা যদি মনে করি কুয়েতে নারী স্বাধীনতা পশ্চিমী দুনিয়ার দেশগুলির মতো বা নিদেনপক্ষে ভারত-শ্রীলংকার মতো দেশগুলির সমান, তাহলে ডুবতে হবে। এই এগিয়ে থাকার কথাটা বলা হচ্ছে পুরোটাই প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে তুলনা করে। কুয়েত একটা ছোটো উপসাগরীয় স্বাধীন রাষ্ট্র। ফ্রিডম হাউস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কুয়েতকে “আংশিক মুক্ত” দেশ বলে ঘোষণা করেছে। ঘটনা হল উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে কুয়েতই একমাত্র আংশিক মুক্ত দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে।
একটা চমকপ্রদ তথ্য হলো কুয়েতের কর্মক্ষেত্রে পুরুষ কর্মচারীদের তুলনায় নারী কর্মচারীর সংখ্যা অনেক বেশি ! যা আমাদের ভারতেও দেখা যায় না। এমনকি এই দেশের বিপুল সংখ্যক মহিলাকে শ্রমিকের কাজ করতেও দেখা যায়। কুয়েতি সমাজে নারী-পুরুষের গড় মধ্যপ্রাচ্যের বাকি সমস্ত দেশ গুলির থেকে অনেক উন্নত। এই দেশের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ শাসক al-sabah (আল-সাবাহ) পরিবারের হাতে আছে। যদিও এই শাসক পরিবারটি নিজেদের উদ্যোগে একাধিকবার কুয়েতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেছে।
১৯৬২ সালে বর্তমান সংবিধান গৃহীত হয়। এরপর রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের জন্য তাতে একাধিক সংশোধন করা হয়েছে। কুয়েতের প্রধান হলেন আমির। আল সাবাহ পরিবারের কোনো সদস্যই আমির হিসাবে নিযুক্ত হন। এই পরিবারের উদ্যোগে নানা সংস্কার সাধনের মধ্য দিয়ে ৬৫ সদস্যের জাতীয় পরিষদ বা মজলিশ আল-উম্মাহ তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫০ জন সদস্য দেশের নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হন। মন্ত্রী পরিষদের ১৫ জন সদস্য অধিকার বলে জাতীয় পরিষদেরও সদস্য।
কুয়েতে ২১ বছর বয়স হলে তবেই ভোটার হওয়া যায়। ২১ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রতিটা নারী ও পুরুষ ভোটারের স্বীকৃতি পেয়ে থাকে। দেশটি ৫ টি নির্বাচনী জেলায় বিভক্ত। প্রতি নির্বাচনী জেলায় ১০ টি করে জাতীয় পরিষদের আসন আছে। কুয়েতের সংবিধানে রাজনৈতিক দল তৈরীর অধিকার থাকলেও তা নথিভুক্তিকরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রার্থীরা দলীয় প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
কুয়েতের আমির মনে করলে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিতে পারেন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী তাকে দু’মাসের মধ্যেই নতুন করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পরিষদ গঠন করতে হয়। এই জাতীয় পরিষদের অধিকার আছে মন্ত্রীদের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন করার এবং প্রয়োজনে কোনো মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার। আমির মনে করলে জাতীয় পরিষদের যেকোনো সিদ্ধান্তের উপর ভিটো দিতে পারেন। যদিও আমিরের সেই ভিটো জাতীয় পরিষদের সদস্যরা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে খারিজ করে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখে।
খুব ভালো করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কুয়েতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাতীয় পরিষদের অধিকার যথেষ্ট বেশি। তারা চাইলে দেশের সর্বোচ্চ শাসক অর্থাৎ আমিরের একাধিক সিদ্ধান্ত বাতিল বা পরিবর্তন করতে সক্ষম। যদিও প্রধানমন্ত্রীর নিযুক্ত করা যে মন্ত্রীরা অধিকারবলে জাতীয় পরিষদের সদস্য হন তারা সাধারণত আমিরের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন না। এর মাধ্যমে কুয়েতের রাজনীতির ওপর আল সাবাহ পরিবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আগে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কুয়েতি নারীদের ভোটাধিকার পেতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। এর আগে ১৯৯৬ সালে আমির দেশের নারীদের ভোটাধিকার দিয়ে আদেশ জারি করলে, তার সেই ঘোষণা মাত্র দু’ ভোটের জন্য জাতীয় পরিষদে বাতিল হয়ে যায়। এরপর ২০০৫ সালে কুয়েতের জাতীয় পরিষদ দেশের মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবি মেনে নেয়। ২০০৬ সালে প্রথম সে দেশের মহিলারা নির্বাচনে ভোট দেয়।
কুয়েতের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রার্থীদের বয়স কমপক্ষে ৩০ বছর হতে হবে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে ২৮ জন মহিলা প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সবাই হেরে গিয়েছিলেন। এরপর ২০১০ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য পান সে দেশের মহিলারা। সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪ টি আসনে জয়লাভ করে মহিলা প্রার্থীরা এবং তাদের মধ্য থেকে মাসুমা আল-মুবারক প্রথম মহিলা হিসাবে কুয়েতের মন্ত্রিসভায় জায়গা পান।
এই ধারাবাহিকতা পরবর্তী দুটো নির্বাচনেও বজায় ছিল। যদিও ২০১৬ সালের নির্বাচনে একমাত্র মহিলা প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেছিলেন সাফা আল-হাসমি। তিনি এর আগে ২০১২ এবং ২০১৬ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনেও জয়লাভ করেছিলেন। এবারের নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাফা। কিন্তু গোটা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে পরাজিত হন কুয়েতের এই মহিলা রাজনীতিবিদ।
• ২০২০ এর কুয়েত জাতীয় পরিষদের নির্বাচনী ফলের তাৎপর্য –
এবারের নির্বাচনের ফল কুয়েতের রাজনীতিতে অনেক দিক থেকেই বিশেষ বার্তা বহন করে আনছে-
* এবারের নির্বাচনে গত জাতীয় পরিষদের বেশিরভাগ নির্বাচিত সদস্য পরাজিত হয়েছেন। ৫০ জনের মধ্যে মাত্র ১৯ জন সদস্য পুনর্নির্বাচিত জাতীয় পরিষদে ফিরে এসেছেন।
* প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয়ের পর তারা নিজেদের মধ্যে ব্লক বা গোষ্ঠী গড়ে তোলে। এবারের নির্বাচনে শাসক পরিবার বিরোধী সংস্কারপন্থী ব্লক ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। ওই শিবিরের অন্তর্গত প্রার্থীরা ২৪ টি আসনে জয়লাভ করে। গোঁড়া সুন্নি ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী প্রার্থীরা মাত্র ৩ টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংখ্যালঘু শিয়া প্রার্থীরা ৬ আসনে জয়লাভ করেছে।
* এবারের নির্বাচনী ফলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ৩০ জনেরই বয়স ৪৫ বছরের কম। যা ইঙ্গিত করে সংস্কার এবং নতুন ভাবনার প্রতি কুয়েতি জনগণের আস্থাকে।
* এবারের নির্বাচনে ২৯ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও প্রত্যেকেই পরাজিত হয়েছেন।
• এই নির্বাচনে কেন একজনও নারী জয়লাভ করতে পারল না?
দীর্ঘ দশ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে দিয়ে কুয়েতের জাতীয় পরিষদ আবার নারী শূন্য হয়ে পড়েছে। যা সে দেশের নারী আন্দোলনের কাছে এক বড় ধাক্কা। কুয়েতি জনগণের এই মনোভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ এই জনগণই রায় দিয়ে সংস্কার এবং নতুন ভাবনার প্রতি এবারের নির্বাচনে আস্থা রেখেছে। কিন্তু সেই তারাই কেন নারীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব স্থাপন করলেন তা সহজে বোঝা যাচ্ছে না।
অনেকে ধারণা করছেন করোনা মহামারী এবং খনিজ তেলের দামের পতনের ফলে কুয়েতের অর্থনীতিতে যে বড়সড় ধাক্কা লেগেছে তা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে পুরুষ প্রার্থীদেরই বেশি উপযুক্ত মনে হয়েছে সে দেশের জনসাধারণের।
করোনা মহামারীর মধ্যে ভোট হওয়ায় এবারের নির্বাচনে ভোটদানের হার যথেষ্ট কম ছিল। মাত্র ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছিল এবারের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে। অন্যান্যবার এই সংখ্যাটা ৯০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মহামারীর বিপর্যয়ের ফলে ভোটকেন্দ্রগুলোতে দীর্ঘ লাইন পড়ায় মহিলাদের একটা বড় অংশ শেষ পর্যন্ত ভোটদান থেকে বিরত ছিল। যার ফলস্বরূপ একজনও মহিলা প্রার্থী জয়লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বেশিরভাগের কাছেই এবারের নির্বাচনে ভোট কম পড়া এবং মহিলাদের করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ভোটদানে উৎসাহ না থাকাকেই কুয়েতের পার্লামেন্ট নারীশূন্য হয়ে পড়ার প্রধান কারণ বলে দাবি করা হয়েছে।
কারণ যাই হোক, কুয়েতের জাতীয় পরিষদ নারী শূন্য হয়ে পড়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটা খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকল। এর ফলে ওই অঞ্চলের নারী আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই বেশ খানিকটা ধাক্কা খাবে। যার ফলে রক্ষণশীলরা উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। আমরা আশা করতেই পারি এবারের নির্বাচনের যাবতীয় হতাশাকে পরাজিত করে আগামী বারের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিপুল সাফল্য অর্জন করে কুয়েতের নারীরা আবার সে দেশের রাজনীতিতে প্রথম সারিতে উঠে আসবে।