২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংসদের দুই কক্ষ তিনটি নতুন কৃষি বিল পেশ করে কেন্দ্রীয় সরকার। কৃষকরা তখনই বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের এই কৃষি বিলগুলির তীব্র বিরোধিতা করলেও তাতে কান দেয়নি বিজেপি। তাদের নেতাদেরকে একবারও ভাবায়নি যারা ফসল উৎপাদন করে তারাই এই বিলের বিরোধিতা করছে, তাই মানবিক কারণেই অন্তত তাদের সঙ্গে একটু আলোচনা করি ! চরম অস্বাভাবিকতার পরিচয় দিয়ে খুব দ্রুততার সঙ্গে সংসদের দুই কক্ষ এই কৃষি বিল পাস করিয়ে নেয় সরকার।
যদিও রাজ্যসভায় কৃষি বিল পাস হওয়া নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। এই কৃষি বিলের বিরোধীরা দাবি করেছিল তাদের পক্ষে সমর্থন বেশি থাকা সত্ত্বেও রাজ্যসভার সহকারি স্পিকার অন্যায়ভাবে ধ্বনি ভোটের মাধ্যমে বিল পাস করিয়েছে। সে যাই হোক, এর পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এই তিনটি বিলে সই করে দিলে তা আইনে পরিণত হয়ে যায়।
নতুন এই তিনটি কৃষি আইন নিয়ে তারপর থেকেই আন্দোলনে নেমে পড়েন দেশের অন্নদাতারা। তারা খুব পরিষ্কারভাবে দাবি জানায় নতুন তিনটি কৃষি আইনই সরকারকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। যদিও প্রথম দিকে বিষয়টাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি বিজেপি। তারা মনে করেছিল আর পাঁচটা আন্দোলনের মত এটাও দুদিন পর ঝিমিয়ে পড়বে। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যায় তারা ভুল ছিল। করোনা সংক্রমণের ভ্রুকুটি সত্বেও দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক যখন রাস্তায় নেমে আসে তখন বোঝাই যায় সমস্যা অতি গুরুতর। তাই তো কৃষকরা করোনা, তীব্র শীত, ক্লান্তি সব উপেক্ষা করে দাবি আদায়ের আন্দোলনে শামিল হয়েছে।
এরপর বিজেপি তাদের চিরাচরিত কূটকৌশল অনুযায়ী কৃষক সংহতিতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করে। সেটা ব্যর্থ হয়ে গেলে একাধিক বিজেপি নেতা এই আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপ বলে দেগে দেয়। অনেকে আবার ইঙ্গিতে বোঝায় চীন পাকিস্তানের মতো দুই শত্রু রাষ্ট্রের মদতেই এই কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে! ক্ষমতার দম্ভে মত্ত বিজেপি সাধারণ মানুষকে এত ছোটো করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, তারা দেশের মানুষের অন্নদাতাদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করতে ভুলে যায়। যদিও বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের তরফ থেকে বারবার কৃষকদের দাবি দাওয়ার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো তারা সহানুভূতি প্রকাশ করলেও কৃষকদের দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ছলে-বলে-কৌশলে এই তিন কৃষি আইনে কিছু বদল আনতে রাজি থাকলেও আইন প্রত্যাহারে তারা নারাজ। যদিও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ-জেপি নাড্ডারা বেশ ভালই বুঝতে পেরেছেন কৃষকদের এই দেশব্যাপী আন্দোলন তাদেরকে ভালই প্যাঁচে ফেলেছে। রাজনৈতিক যে ক্ষতিগুলো হলো তার হিসাব তারা বোধহয় এখন থেকেই কষতে শুরু করে দিয়েছেন। আমরা বরং নিজেদের মতো করে বিজেপির মূল ৫ টা রাজনৈতিক ক্ষতিকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করি –
১) কৃষকদের সমর্থন হাতছাড়া হওয়া
ভারতের মতো কৃষি প্রধান দেশের ক্ষমতায় থাকতে গেলে কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষের সমর্থন অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু কৃষি আইনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় বেশিরভাগ কৃষক আর বিজেপির ওপর ভরসা করবে না। কৃষকদের মধ্যে অনেকেরই আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভাল না হলেও আত্মমর্যাদাবোধ প্রবল। বিজেপি তাদের সেই আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত করেছে, যা কৃষকরা সহ্য করবে না বলে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। কৃষকদের সমর্থন হারানোর ফল এদেশের আগামী নির্বাচনগুলিতে বিজেপিকে কড়ায়-গন্ডায় চোকাতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।
২) পাঞ্জাব থেকে দলটাই হয়তো মুছে যাবে
শিখ সম্প্রদায় অধ্যুষিত পাঞ্জাব মূলত কংগ্রেস ও শিরোমনি অকালি দল, এই দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। তবে ওই রাজ্যে হিন্দু জাঠ জনগোষ্ঠীর মানুষও বেশ ভালো সংখ্যায় আছে। শিরোমনি অকালি দলের হাত ধরে পাঞ্জাবের এই জাট হিন্দুদের মধ্যে নিজেদের ভিত আস্তে শক্ত করে তুলছিল বিজেপি। কিন্তু এই কৃষি আইন ইস্যুতেই শিরোমনি অকালি দল বিজেপির হাত ছেড়ে দেয়। তার পরবর্তী পর্যায়ে এই ব্যাপক কৃষক আন্দোলন বিজেপিকে আরো কোণঠাসা করে দিয়েছে সেই রাজ্যে।
কৃষক আন্দোলনে দেশের সমস্ত প্রান্তের কৃষকরা বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে পাঞ্জাবের কৃষকরা অগ্রগণ্য। এর আর্থসামাজিক কারণও আছে। পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা এই দুটো রাজ্য আজও কৃষিনির্ভর। এই দুই রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্য উৎপন্ন হয়, সেই সঙ্গে এখানকার কৃষকরা যথেষ্ট আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি কাজ সম্পন্ন করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকরা বিজেপির আচরণে ব্যাপক ক্ষুব্ধ। কৃষকদের ক্ষোভের আঁচ থেকে বাঁচতে পাঞ্জাব বিজেপির অসংখ্য নেতাকর্মী দল পরিবর্তন করে অকালি দল বা কংগ্রেসে যোগ দিতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে পাঞ্জাবে বিজেপির রাজ্য দপ্তরের তালা খোলার মত কর্মী পাওয়াও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। কারণ বিজেপির সঙ্গে সখ্যতা সেই রাজ্যের আর কোনো মানুষ সহজে রাখতে চাইবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।
৩) দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিল
দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সঙ্ঘবদ্ধ না হওয়ায় ৪০ শতাংশের কম ভোট পেয়েও এই দেশের ক্ষমতায় ফিরে আসতে পেরেছে বিজেপি। একই ঘটনা ঘটে চলেছে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনেও। রাজনৈতিক শিবিরের একটা চালু কথাই হল “বিরোধীরা যত ছন্নছাড়া থাকবে, বিজেপি তত গেঁড়ে বসবে”। নিজেদের এই বিপুল সুবিধাকে নিজেদের দোষেই বোধহয় হাত ছাড়া করতে চলেছে গেরুয়া শিবির। বিষয় যেহেতু কৃষকদের দাবি দাওয়া, তাই দেশের বিজেপি বিরোধী প্রতিটা রাজনৈতিক দল এই মুহূর্তে সঙ্গবদ্ধ হয়ে উঠেছে। কারণ হিসাবে বলা যায় আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতি সমর্থন এদের জোটবদ্ধ করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী বছরের পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের নির্বাচনে ভালো ফল করা বিজেপির পক্ষে খুবই কঠিন।
৪) শরিক বিচ্ছেদ এবং তার ফলাফল
কৃষি আইনকে কেন্দ্র করে বিজেপির একাধিক শরিক বিচ্ছেদ ঘটেছে বা বিচ্ছেদ হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঘটনাগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের স্থায়িত্বে প্রভাব না ফেললেও রাজ্যগুলিতে বিজেপির অবস্থান সম্পূর্ণভাবে নড়বড়ে করে দিতে পারে।
বিজেপির সবচেয়ে পুরানো শরিক ছিল পাঞ্জাবের পাঁচবারের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদলের শিরোমনি অকালি দল। দীর্ঘদিনের এই শরিকদল নতুন তিনটি কৃষি আইনকে সম্পূর্ণভাবে কৃষক বিরোধী আইন বলে দাবি করে এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এর ফলে পাঞ্জাবে বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থান সম্পূর্ণ নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে।
হরিয়ানায় জননায়ক জনতা পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকারের গঠন করেছে বিজেপি। সেই জননায়ক জনতা পার্টির প্রধান সমর্থক হল কৃষকরা। নতুন কৃষি বিল আইনে পরিণত হওয়ার দিন থেকেই হরিয়ানার কৃষক সংগঠনগুলি জননায়ক জনতা পার্টির ওপর চাপ দিতে শুরু করেছে যাতে তারা বিজেপির ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ক্ষমতার মোহে জননায়ক জনতা পার্টির নেতা তথা হরিয়ানার উপমুখ্যমন্ত্রী দুষ্মন্ত চৌতালা এখনো পর্যন্ত বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার না করলেও বাধ্য হচ্ছেন সেই নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে। এই দলটি যদি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে হরিয়ানায় বিজেপি সরকারের পতন ঘটবে। ইতিমধ্যেই চারজন নির্দল বিধায়ক এই ইস্যুতে হরিয়ানার বিজেপি সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
রাজস্থানে বিজেপির অন্যতম শরিক সাংসদ হনুমান বেনিওয়ালের দল রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার যদি কৃষকদের দাবি-দাওয়া মেনে না নেয় তা হলে তারা এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।
উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পিছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের টিকায়েত গোষ্ঠীর। কিন্তু এই কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে ব্যাপক দূরত্ব তৈরি হয়েছে বিজেপির। উত্তরপ্রদেশ রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বকে যা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এই টিকায়েতরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র যদি নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে তবেই তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করবে।
৫) শেষ পর্যন্ত আইন প্রত্যাহার করতে হলে বিজেপির ভাবমূর্তি ধুলোয় মিশে যাবে
গত ৮ তারিখ ১৩ টি কৃষক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বেসরকারি বৈঠকে বিল প্রত্যাহার করার রাজনৈতিক অসুবিধাগুলি ব্যাখ্যা করেন। সেখানে বিজেপির এই শীর্ষ নেতা জানান বিল প্রত্যাহার করা হলে দেশব্যাপী তাদের দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য বিষয় নিয়েও একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে বিল প্রত্যাহারের রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনার কথা ভেবে বিজেপি আতঙ্কিত। কিন্তু কৃষকদের আন্দোলন যেভাবে প্রতিমুহূর্তে শক্তি বাড়াচ্ছে এবং কৃষকরা যেভাবে তাদের দাবিতে অনড় আছে তাতে সরকারকে হয়তো শেষ পর্যন্ত এই তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করেই নিতে হবে। সেক্ষেত্রে বিজেপির অপরাজেয় ভাবমূর্তি মুহুর্তের মধ্যে ধুলোয় মিশে যাবে। যার সুযোগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি অবশ্যই নেবে।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে যে মুহূর্তে কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেবে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তাদের শেষের শুরু হয়ে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
কৃষক আন্দোলন এই মুহূর্তে যুক্তির সীমা পেরিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আবেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা আমাদের খাবারের যোগান দেয় সেই তারাই এই তীব্র ঠান্ডার মধ্যে অসহায় অবস্থায় দিল্লির সীমান্তে দিনের পর দিন বসে আছে। এই ঘটনাটা সাধারণ মানুষের মোটেও ভালো লাগছে না। যা বিজেপির পক্ষে আরও বড় রাজনৈতিক ক্ষতি। এখন দেখার এই রাজনৈতিক ক্ষতি সামলে বিজেপি তাদের জয়রথ একই রকম ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে কিনা!