খুব নিরপেক্ষভাবে বিচার করে দেখতে গেলে মেনে নিতেই হবে যে মনমোহন সিংয়ের প্রজ্ঞা নরেন্দ্র মোদির মধ্যে নেই। সেটাই স্বাভাবিক। রাজীব গান্ধী পরবর্তী অধ্যায়ে দীর্ঘ দিন বাদে দেশ আবার এত বড় মাপের একজন জননেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পেয়েছে। হ্যাঁ, অটল বিহারি বাজপেয়ির কথা মাথায় রেখেই বলছি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে নয়, জননেতা নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষ উত্তেজিত। আপনি বিজেপির সাংগঠনিক ক্ষমতাকে সরিয়ে দিন তারপর নরেন্দ্র মোদির কোনো একটি জনসভা করুন। তা হলেও দেখবেন প্রায় একই রকম জনসমাগম হবে। এর আগে বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনো এই একই ব্যাপার ঘটতো। কিন্তু সেটা মূলত উত্তর ভারতে। দেশের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে অটল বিহারি বাজপেয়ির জনসভায় মানুষের ভীড় উপচে পড়ছে এরকম কিন্তু দেখা যায়নি।
অনেকে বলবেন এবং তারা ঠিকই বলবেন যে নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তি গড়ার পিছনে, তার এই বিপুল জনপ্রিয়তা তৈরীর পিছনে একটা দুর্ধর্ষ ম্যানেজমেন্ট টিম কাজ করে। এটা যেমন ঠিক তেমনি এটাও মানতে হবে দিনের শেষে পুরো বিষয়টা তৈরি হওয়া এবং বজায় থাকা সম্ভব হয় নরেন্দ্র মোদীর নামে, নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখেই।
দেশে নরেন্দ্র মোদি বিরোধী মানুষের সংখ্যা তার সমর্থকদের থেকে নিঃসন্দেহে বেশি। কিন্তু তারা ভরসা রাখবে এরকম কোনো বিকল্প এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আর এই বিকল্প গড়ে উঠতে গেলে শুধু গুণগতমান দিয়ে হবে না, কোথাও গিয়ে জনপ্রিয়তায় টক্কর দিতে হবে মোদির সঙ্গে। আমরা বরং খুঁজে দেখি ঠিক কোন কোন জায়গায় মোদি বাকি নেতাদের থেকে এতটা এগিয়ে গেলেন-
এই দেশ এর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখেছে জহরলাল নেহেরু-ইন্দিরা গান্ধী-রাজীব গান্ধীদের। যারা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দক্ষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সর্বত্র কম বেশী জনপ্রিয় ছিলেন। সহজ কথায় বলতে গেলে জননেতা ছিলেন। কিন্তু রাজীব গান্ধী পরবর্তী পর্যায়ে অটল বিহারী বাজপেয়ি ছাড়া যারা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তাদের জনভিত্তি তেমন একটা ছিল না। বড়জোর কোনো একটি রাজ্যের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন তারা।
বাজপেয়ি জীর জনপ্রিয়তা উত্তর ভারত কেন্দ্রিক ছিল। দেশের বাকি অংশে তিনি অতটাও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। দীর্ঘদিন এই পরিস্থিতি চলার ফলে সাধারণ মানুষের মনে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নিয়ে একটা চাহিদা তৈরি হতে থাকে। এক্ষেত্রে কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মত কাজ করে যায় মনমোহন সিংয়ের ১০ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্ব। প্রশাসক হিসাবে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কার্যকাল সম্পন্ন করলেও এটা মেনে নিতেই হবে যে কোনদিনই জননেতা ছিলেন না। এমনকি তার রাজ্য পাঞ্জাবেও তার কোনো জনভিত্তি তৈরি হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে মোদি সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে অন্যতম জনপ্রিয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে সফল হন। এক্ষেত্রে তিনি কেবল মাত্র বিজেপির গড়গুলিতে সীমাবদ্ধ থাকেননি। দেশের প্রতিটা কোণাকে নিজের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। আর পরবর্তী পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ফলে সেই জনপ্রিয়তা স্বাভাবিক নিয়ম মেনে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বাকি রাজনীতিবিদদের থেকে তাকে আরো অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে।
দেশের যুবক-যুবতীরা নিঃসন্দেহে হাতে কাজ চায়, কিন্তু সেই সঙ্গে তারা হয় প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ। ঠিক এই জায়গাটাকেই ব্যবহার করতে সক্ষম হন মোদি। এই আবেগকে ব্যবহার করেই যুব সম্প্রদায়ের মনে দেশ গড়ার ত্যাগের বীজ বুনে দেন তিনি। এতে দুটো লাভ হয়-
• দেশ গড়ার ভাবনায় আবেগ তাড়িত যুব সম্প্রদায়ের একাংশ কর্মসংস্থান সংক্রান্ত বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা অনেকটাই কমিয়ে দেয়। তার ফলে সরকারকে কর্মসংস্থান নিয়ে আর ততটা বিব্রত হতে হয়নি।
• আবেগ তাড়িত যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজের ভাবমূর্তি আরও জোরালো করে গড়ে তোলা সহজ হয়ে যায়। তারা মনে করতে শুরু করে এত বড় ত্যাগি এবং মহান নেতা এর আগে আসেনি।
বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক নেতাদের মূল সমস্যা হলো তারা যতই সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করুক না কেন, দেশের যুবসমাজের এই আবেগ অনুভূতিকে ছুঁয়ে দেখার মত সক্ষম এখনো হয়ে উঠতে পারেনি।
৩) নিজের শক্তিশালী ভাবমূর্তি গড়ে তোলা
বেশিরভাগ দেশবাসী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং যুদ্ধের খুঁটিনাটি বোঝেন না। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে মোদি ও তার দল প্রতিমুহূর্তে পাকিস্তান এবং চীনকে লাগাতার নিশানা করে গিয়েছে। অথচ এসব কিছুই ঘটেছে দেশের রাজনৈতিক ময়দানে। অন্যদিকে নিয়ম মেনেই এই দুই দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভারত।
মোদিরা বুঝে গিয়েছিলেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ আজও পাকিস্তান ও চীনের নামে অকারনে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা অত যুক্তির ধার ধারেনা। ঠিক সেই সুযোগটাকে ব্যবহার করে নিজের শক্তিশালী ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন তিনি। তিনি জানতেন দেশের মানুষ উত্তেজিত হয়ে ওঠে যদি একজন সন্ত্রাসবাদী বা পাকিস্তান সেনাকে মারতে সক্ষম হয় ভারতীয় সেনারা। তারা মনেও রাখে না যে তার আগে দীর্ঘদিন সীমান্তে শান্তি বিরাজ করায় কোনো সন্ত্রাসবাদি বা পাকিস্তান সেনাকে মারার প্রয়োজন পড়েনি! ঠিক এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই দেশের অভ্যন্তরে তিনি নিজের পাকিস্তানবিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি করেন।
দেশের মানুষের কাছে আবেগের বিষয় হওয়ায় তারা এই যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধী নেতাদের যুক্তি গুলিতে খুব একটা কান দেয়নি কখনোই।
দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি নরেন্দ্র মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। অনেকেই রাহুল গান্ধীকে মোদির বিকল্প হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। এর মূল কারণ প্রয়োজনে মোদি মেঠো রাজনীতির পথ ধরতে পিছপা হন না। অথচ রাহুল তার শিক্ষাদিক্ষার কারণেই হোক বা অন্য কিছু ভাবনা চিন্তার জায়গা থেকে এখনো পর্যন্ত সেই পথে হাঁটেননি। তাই তিনি অনেক দূরের দ্বিতীয় স্থানেই থেকে গিয়েছেন।
৫) দিল্লির চিরাচরিত সৌজন্যের রাজনীতির ধার ধারেননি
গুজরাটের প্রধানমন্ত্রী থাকলেও দিল্লির রাজনীতির সঙ্গে তার খুব একটা যোগাযোগ কখনোই ছিলনা। তার ফলে নরেন্দ্র মোদী দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দের সৌজন্য রাজনীতিকে কখনোই খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তিনি প্রয়োজনে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বারবার পদক্ষেপ করেছেন। এর ফলে নানা কারণে বিজেপি বিরোধী শিবির প্রচন্ডভাবে আতঙ্কে থাকে। তাই তারা বোধহয় নিজেদেরকে রক্ষা করতে গিয়ে মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উঠতে এখনো পর্যন্ত সক্ষম হয়নি।
এদেশের দিশেহারা বিরোধী শিবির আজও ভেবে চলেছে ঠিক কোন পথে নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতা করা যেতে পারে। যারা পথই এখনো পর্যন্ত পথ ঠিক করে উঠতে পারেনি, তাদের পক্ষে মোদির এই সুবিশাল ভাবমূর্তির সঙ্গে টক্কর নেওয়া বেশ সমস্যার।
এই কারণগুলোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা বিষয় হল বিজেপির অভ্যন্তরের যাবতীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে মোদী-অমিত শাহ জুটির হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। যার ফলস্বরূপ মোদি বিরোধী বিজেপি নেতাদের প্রভাব প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই বলাই যায় ঘরে-বাইরে মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদী এখন শুধু নিষ্কণ্টক নয়, প্রায় অপ্রতিরোধ্য।