images 4 4
POPxo bangla

“মেহেন্দি লাগাকে রাখনা, ডোলি সাজাকে রাখনা…”
চিরন্তন এই গানের লাইনটা প্রতি মনে মেহেন্দি প্রেম এনে দিয়েছেই। স্বপ্নের রাজপুত্র আসবে, আর ভালোবাসার সাগর স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে… আর তার জন্য দুই হাত ভর্তি মেহেন্দি সাজিয়ে অপেক্ষা করবে তার প্রেমী… উফফফ কী অদ্ভুত রোমাঞ্চ।

যে মেহেন্দি মনে সঞ্চারণ করে সাত রঙের বর্ণালী… আজ সেই মেহেন্দির প্রেক্ষাপট একটু জেনে নিতে মন চাইছে বইকি।

★ মেহেন্দির ইতিকথা:-

মেহেন্দি এক ধরনের সপুষ্পক উদ্ভিদ। যার
পাতা প্রসাধন হিসেবে, প্রয়োজনের সামগ্রী হিসেবে এবং ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এর সাথে অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে আধা-কৃত্রিম পদার্থ তৈরি করা হয়। যা ত্বক, চুল, নখ, পশুর চামড়া ও পশম রঙিন করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মেহেন্দি পাতায়
লসোন (lawsone) নামক এক প্রকার পদার্থের উপস্থিতির জন্যই রঙ হয়। মেহেদির পাতাতেই প্রধানত: লসোন থাকে।

20201208 115819
নিজস্ব চিত্র

★ব্যবহার:-

১. সেই প্রাচীন যুগ থেকে মেহেন্দি রঞ্জক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সমস্ত বিশ্বে বিভিন্ন উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই মেহেন্দি। ভারতে ঈদ ও বিয়ে উপলক্ষে এর ব্যবহার বর্তমানে আবশ্যিক।
২. চুলের রঙ হিসেবে মেহেদির ব্যবহার হয়।
প্রায় ৪০০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় আদালতে এই কথার উল্লেখ আছে।
৩. মেহেন্দি পাতার রস চুল পড়া কমায়।অকালে পেকে যাওয়া দূর করতেও মেহেন্দির জুড়ি নেই।
৪. মাথার খুশকি দূর করতেও দারুণ কার্যকর।
৪. ছত্রাক রোধে মেহেন্দি বিশেষ ভাবে কাজ করে।
৫. পোকা দমনেও মেহেন্দি ব্যবহৃত হয়।
৬. কাপড় ও চামড়া সংরক্ষণেও এর ব্যবহার হয়।
৭. বহু প্রাচীনকাল থেকেই মেহেন্দি ফুল থেকে সুগন্ধী তৈরি হতো, বর্তমান যুগে আবার এর উৎপাদন শুরু হয়েছে।
৮. কাঁধের ব্যথা সারাতে মেহেন্দি পাতার রসের সাথে সর্ষের তেল মিশিয়ে মালিশ করলে ব্যথা কমে যায়।
৯. মেহেদির নানা প্রকার ওষুধি গুণও রয়েছে। এতে অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিইনফ্লামেটরি, কুলিং, হিলিং, সিডেটিভসহ অনেক গুণ রয়েছে, যা দেহ ও মনের বিভিন্ন রোগ প্রশমন করে।
১০. এটি রক্ত পরিষ্কারক হিসেবেও কাজ করে।
১১. শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।
১২. এই পাতার রস আমাশয় ও উদরাময় নিরাময়েও বিশেষভাবে কাজ করে।        
১৩. হাত ও নখের স্বাস্থ্যের জন্যও মেহেন্দি উপকারী। এটি ব্যবহারে হাতের ত্বক মসৃণ হয়। নখের কোনে নখকুনি দেখা দিলে মেহেন্দি পাতা বাটা ভালো ফল দেয়।
১৪. টাটকা মেহেন্দি পাতার রস পায়ের জ্বালা কমাতে সাহায্য করে।
১৫. মেহেদির রস দিয়ে তৈরি তেল মুখে ও চামড়ায় মাখলে ত্বক টানটান হয়ে ওঠে।
                       

images 5 3
Facebook

★বাঙালি ঘরেও মেহেন্দির অণুপ্রবেশ:-

images 6 4
wedding in ranchi on wedding.net


শ্যাওলা সবুজ মেহেন্দি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় ঘন ডিপ লালে। কী এক অদ্ভুত রহস্য আছে যেন। আর সাথে তার মন মাতানো সুবাস… যে কোনো মনের কোণে … ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়…’
অবাঙালি ঘরে মেহেন্দি ছিল সেই কোন এক অজানা অতীত থেকে। বাঙালি মন এত রঙে মজেনি তখন। বিগত কয়েক দশক থেকে বাঙালি ঘরেও দেখি মেহেন্দির আনাগোনা। শুধু আনাগোনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি, পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছেন তার।
বিয়ে বাড়ি যাবার আগে দুই হাত মেহেন্দির রঙে রক্তিম করে বঙ্গ ললনারাও। ভাইফোঁটার আগেও, রাখী পূর্ণিমার আগেও, সরস্বতী পুজোও বা বাদ যায় কেন… বাঙালি ঘরেও উঁকি ঝুঁকি মারছে করবা চৌথের সেই রোম্যান্টিক মুহুর্ত… দুই হাত ভর্তি মেহেন্দির রং, লাল শাড়ি, লাল চেলি, লাল চুড়ি, লাল টিপ ও গা ভর্তি গয়না নিয়ে সন্ধ্যায় চালনি দিয়ে চাঁদ দেখে, সেই চালনি দিয়ে স্বামীর মুখ দেখে জলগ্রহণ। উফফফ… এক্কেবারে… ‘দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে…’
আরো আছে… শ্রাবণের ঘন বর্ষায় দুই হাত রাঙিয়ে একটু রোদের প্রতীক্ষা… দুই হাতে আঁকা মেহেন্দি শুকিয়ে গেলে তাকে তুলে লেবু চিনির রস লাগিয়ে একটু আগুনে সেঁকে নেবার আকুল আর্তি। তারপর ঘি মাখিয়ে সারারাত দুই হাতে জল না লাগিয়ে ঘুমোতে যাওয়া… সকালের প্রতীক্ষা… ঘুম থেকে উঠেই দেখা কতটা গাঢ় হলো মেহেন্দির রঙ। কথায় আছে, যার মেহেন্দির রঙ যত গাঢ় হয়, তার কাছের মানুষটি তাকে তত বেশি ভালোবাসে। তাই প্রতীক্ষা গাঢ় লাল রঙের… ভালোবাসার মানুষটির তীব্র ভালোবাসা পেতে কার না ভালো লাগে।
মেহেন্দি নিয়ে এক নস্টালজিয়া কাজ করে বঙ্গ ললনার মনেও।

★অভিনব মেহেন্দি আর্ট:-

অত সময় কোথায় মেহেন্দি নিজে হাতে এঁকে নিজেকে সাজিয়ে তোলবার।
তাই বর্তমানে শহরের ইতিউতি একটু খোঁজ করলেই মেহেন্দি আর্টিস্টের সন্ধান পাওয়া যায়।

মেহেন্দি আর্টিস্ট


১. অশোক দাশ:-
গড়িয়াহাট বাসন্তীদেবী কলেজের সামনে কুড়ি বছরের দোকান। কোনো মেয়ে কলেজ সেরে বিয়ে বাড়ি যুবরাজ নিজের দুটো হাত রাঙিয়ে নেয় অবলীলায়।
২. অভিরাজ দাস:-
অশোকবাবুর ছেলে অভিরাজ আজকের যুগের ছেলে। তিনিও বাবার পেশা বেছে নিয়েছেন। কলেজের গেটের বাইরেই মেহেন্দির পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন অনেকে। তাঁর বক্তব্য, ‘কলেজের ছাত্রী বেশি পাই না, তবে সারাবছর এখানে এবং নানা অনুষ্ঠানে যা কাজ করি তাতে সংসার চলে যায়।’ তাঁর কাছে দু’শো-দু’হাজার সব বাজেটেই মেহেন্দি পড়ার সুযোগ আছে।
নকশা এবং কতটা অংশে মেহেন্দি লাগবে তার ওপর দাম নির্ভর করে।

তিনি বলেন, তিনি ভালো মেহেন্দি, যা ত্বকের ক্ষতি করে না এমন জিনিসই ব্যবহার করে। কেউ বাড়ি থেকে মেহেন্দি আনলে সেটাও পড়িয়ে দেন।

৩. মেহেন্দি আর্টিস্ট মুন্না সিং:-
দীর্ঘদিন তিনি দিল্লিতে ছিলেন, কিন্তু বেশ কয়েক বছর তিনি কলকাতায়। বিভিন্ন শপিং মলে যিনি মেয়েদের হাত সাজিয়ে চলেছেন তাঁর পটু হাতের জাদুতে। সিটি সেন্টার, সাউথ সিটি এবং বর্তমানে কলকাতার অ্যাক্রোপলিস মলে মুন্নার মেহেন্দি আউটলেট। তিন বছরের ছোট মেয়ে থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মহিলা মুন্নার কাছে আসে। দু’শো টাকা থেকে শুরু করে ন’হাজার টাকার মেহেন্দি আঁকার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘জায়গা বিশেষে বাঙালি কাস্টমারই বেশি। হাত-পা, গাল, কাঁধে মেহেন্দি লাগানোর অভিজ্ঞতাও আছে। এটাই যেহেতু আমাদের মূল জীবিকা তাই কোয়ালিটি বজায় রাখি কারণ আমাদের হাতের মেহেন্দি রং তো ওঠার সুযোগই পায় না। তাই কেমিক্যাল ব্যবহার করলে কাস্টমারের আগে আমরা নিজেদেরই ক্ষতি করব। ন্যাচারাল মেহেন্দিই আমাদের বৈশিষ্ট্য। দরদাম করার সুযোগ নেই এখানে।’
৪. শর্মিলা সিং ফ্লোরা:-
‘ফ্লোরাস’ বিউটিপার্লারের কর্ণধার শর্মিলা সিং ফ্লোরা বলেন, ‘আজকের জেনারেশন যদিও পার্মানেন্ট নকশা অর্থাৎ ট্যাটুর দিকেই ঝুঁকছে তবু বলব মেহেন্দির জায়গা একেবারে স্বতন্ত্র। আমরা যাঁরা সাজি এবং সাজাই তাঁরা সর্বদাই মাথায় রাখি যে আমাদের কাস্টমার কখনওই, ফ্লায়িং নয়। তাই তাদের থেকে অর্জিত বিশ্বাসযোগ্যতা যাতে না হারায় সে কথা সর্বদা আমাদের মাথায় থাকে। পিওরিটি এমনই একটা জিনিস যা মানুষের চোখে পড়বেই, মানুষ বুঝবেই।’

এভাবেই মেহেন্দি এখন বাংলায় ছেয়ে গিয়েছে। মেহেন্দি পড়তে তো আপনারও ভালো লাগে, দেখুন তো মেহেন্দির এই অজানা তথ্য গুলো পড়ে কেমন লাগল। জানি এরপর আরও বেশি মেহেন্দি পড়তে মন চাইবেই…।