মাইগ্রেন হল অনেকটা বাড়ীতে আসা অতিথি র মত, বেশীর ভাগ সময় না জানান দিয়েই চলে আসে আর অনেক্ষন থেকে যায়, সহজে তারা ফিরে যেতেই চায়না । যারা এই ব্যাথায় ভুক্তভুগি তার নিশ্চয়ই আমার সাথে এক মত । সকাল থেকে হয়তো আপনি দিব্যি আছেন, কিন্তু হঠাৎ আপনার মাথার একদিকে ব্যাথা শুরু হল, কিছুতেই কমছে না ! এহেন অবস্থায় কি করবেন ? জানতে হলে পড়ুন আজকের এই বিশেষ স্বাস্থ্য সম্বধীয় প্রতিবেদনটি ।
কেন হয় মাইগ্রেন ?
গননা অনুসারে দেখা গেছে বিশ্বে 14.7% মানুষ এই প্রকার মাথা ব্যাথার সমস্যায় ভোগেন । যেসব মানুষের এরূপ মাথা ধরার প্রবনতা থাকে তাদের উচ্চ শব্দ, অত্যাধিক আলো, প্রচন্ড গন্ধ, বাতাসের চাপের তারতম্য ও কিছু খাবার যেমন চকলেট, আঙুরের রস, পনির কিংবা কফি খেলেও মাথা ব্যাথা শুরু হতে পারে ।
মাইগ্রেন মূলত এক ধরনের নিউরোভ্যাসকুলার ডিসঅর্ডার, নিউরোলজিস্টদের মতে মস্তিষ্কে থাকা নিউরোট্রান্সমিটার সিরোটনিন-এর উচ্চস্তরসমূহ, যা ৫-হাইড্রোক্সিট্রিপ্টামিন নামেও পরিচিত, এরূপ মাথা ব্যাথা সৃষ্টির পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে । এই ধরনের মাথা ব্যাথা মূলত মাথার একটা দিক থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে পুরো মাথায় ব্যাথা ছরিয়ে পরে । এই ব্যাথা হওয়ার সময় মস্তিষ্কের স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়ে থাকে । অনেক সময় মাইগ্রেনের জন্য বমি বমি ভাব, চোখ ধাধিয়ে যাওয়া এমনকি দৃষ্টিভ্রমের মত উপসর্গ গুলি দেখা দিতে পারে ।
বাজারে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ এই প্রকার মাথা ব্যাথার জন্য পাওয়া গেলেও বেশীরভাগ মানুষই প্রাকৃতিক অথবা ঘরোয়া টোটকার সাহায্যে ব্যাথা কমাতে চেষ্ঠা করেন । আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের দ্বারাও অনেক সময় এই ব্যাথার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় । ব্যাথা থেকে রেহাই পাওয়ার অনেক উপায় গুলির মধ্যে 10 টি সহজ উপায় এখানে আলোচনা করা হল ।
10 টি উপায় যা আপনাকে মাইগ্রেন থেকে রেহাই দেবে:
1.আকুপ্রেশার:
আকুপ্রেশার বা আকুপাঙ্কচার হল মূলনীতিবিশিষ্ট একটি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি, এই চিকিৎসা পদ্ধতি দ্বারা অনেক দীর্ঘস্থায়ী রোগেরও চিকিৎসা করা হয়ে থাকে । শরীরে উপস্থিত কিছু আকুবিন্দুতে প্রেসার প্রয়োগ করে এই পদ্ধতির দ্বারা রোগ উপসম করা হয় । মাইগ্রেনের ব্যাথাতেও এই চিকিৎসার দ্বারা অনেকেই সুস্থ্যতাবোধ করে থাকেন । মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে বা হাতের বুড়ো আঙুল এবং তর্জনীর মাঝে উপস্থিত LI 4 বিন্দুতে 5 মিনিট করে প্রেসার প্রয়োগ করে ব্যাথা কমানো যেতে পারে ।
2.অপরিহার্য তেল (Essential oil):
বিভিন্ন ব্যাথার উপসম ঘটাতে এসেনশিয়াল বা অপরিহার্য তেলের জুরি মেলা ভার । এই তেলগুলি বিভিন্ন গাছ থেকে পাওয়া যায় যেমন লবঙ্গ, ল্যাভেন্ডার, নিম ইত্যাদি । এই তেল গুলির মধ্যে এসেনশিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড বা এসেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে তাই লবঙ্গ তেল, ল্যাভেন্ডার তেল, নিম তেল গুলি হল এসেনশিয়াল ওয়েল । এর মধ্যে ল্যাভেন্ডার একটি প্রয়োজনীয় তেল যা প্রায়শই স্ট্রেস, উদ্বেগ এবং মাথা ব্যথার প্রতিকার হিসাবে সুপারিশ করা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় নিউরোলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ল্যাভেন্ডার অয়েল ইনহেলেশনের দ্বারা কিছু লোকের মধ্যে মাইগ্রেনের ব্যথার তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে। বাজারে ল্যাভেন্ডার তেল অনায়সই পাওয়া যায়, মাইগ্রেন হলে এই তেল শুকলে অথবা ব্যাথার ওপরে সরাসরি প্রয়োগ করলে কিছুক্ষনের মধ্যে ব্যাথা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে ।
অনেক ক্ষেত্রে এই তেলের 1 ফোটা চায়ে মিশিয়ে খেয়েও অনেকে মাইগ্রেন মাথা ব্যাথা থেকে স্বস্তি পেয়েছেন ।
3. আদা চা:
মাইগ্রেনের ব্যাথা থেকে নিস্তার পাওয়ার আরেকটি মোক্ষম ওষুধ হল আদা চা । ইতিমধ্যে Sumatriptan নামে মাইগ্রেনের একটি ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়, এই ওষুধটির সাথে আদা র তুলনা করে একটি গবেষনায় দেখা গেছে আদা মাইগ্রেনের ব্যাথায় Sumatriptan ওষুধের বরাবরই ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে । অনেকেই মাথা ব্যাথার জন্য পেন কিলার খাওয়ার পক্ষে নন এবং এই ওষুধটি হঠাৎ ব্যাথা উঠলে বাড়ীতে নাও থাকতে পারে, তখন আপনি তাই সহজেই আদা চা খেয়ে এই ব্যাথার তীব্রতা কমাতে পারেন । আদাতে জিনজেরলস্ নামে একটি পদার্থ থাকে যা নার্ভাস টিস্যুকে শিথিল করে ব্যাথার উপসম ঘটাতে সাহায্য করে ।
4. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট:
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ মাইগ্রেনের জন্য একটি সাধারণ ট্রিগার। আপনি কোনো কারনে অবসাদে ভুগলে অথবা প্রচন্ড দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকলে আপনার মস্তিষ্কে একটা চাপের সৃষ্টি হয়, যাকে স্ট্রেস বলা হয়ে থাকে এবং এই স্ট্রেস এর কারনে আপনি মাইগ্রেনের শিকার হতে পারেন । বিশ্বে 80 % মানুষই নানান কারনে দিনের কোনো না কোনো সময় স্ট্রেস অনুভব করে থাকেন । এই স্ট্রেস কাটানোর জন্য আপনি যোগা বা ধ্যান অথবা জার্নালিং র সাহায্য নিতে পারেন, বিশেষ ক্ষেত্রে মানুষ গান শুনেও মানসিক চাপ থেকে রেহাই পান । যত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস থেকে আপনি দূরে থাকবেন ততই মাইগ্রেনের ব্যাথাও আপনাকে বিব্রত করবে না । এখনকার যুগে নানা জায়গায় স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ক্লাসও করার সুযোগ আছে ।
5.পর্যাপ্ত পরিমান জল:
‘জলের আরেক নাম জীবন’ – কথাটি পুরোপুরি সত্যি ! আপনারা কি জানেন রোজ পর্যাপ্ত পরিমান জল না পান করলে আপনার শরীরে বিভিন্ন রকম রোগ বাসা বাধতে পারে ? তার মধ্যে একটি হল এই মাইগ্রেন । শরীরে ডিহাইড্রেশন্ অর্থাৎ জলের পরিমান কমে গেলে অনেক সময় মাইগ্রেন ব্যাথা শুরু হয় । তাই সারা দিনে পর্যাপ্ত জল পান করলে এবং একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট বজায় রাখলে শরীর হাইড্রেটেড থাকবে সহজেই ।
6. পর্যাপ্ত বিশ্রাম:
পর্যাপ্ত বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা শরীরকে ঠিক রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । বেশীর ভাগ মানুষেরই অত্যাধিক পরিশ্রমের ফলে মাইগ্রেন হয়ে থাকে । অল্প অথবা অধিক ঘুমের ফলে এই প্রকার মাথা ব্যাথার সৃষ্টি হয় । তাই প্রত্যেকদিন 7-9 ঘন্টার গভীর ঘুমের প্রয়োজন শরীরকে ঠিক রাখতে হলে ।
7. ভিটামিন বি কমপ্লেক্স:
ভিটামিন বি এই প্রকার মাথা ব্যাথার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপযোগী । ভিটামিন বি মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। ভিটামিন বি এর বিভিন্ন ক্যাপস্যুল বাজারে সহজেই পাওয়া যায় কিন্তু শরীর বিশেষে এই ওষুধের প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে তাই চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে তবেই এই ভিটামিন ক্যাপস্যুল খাওয়া উচিত । তবে সরাসরি ওষুধ না খেয়ে ভিটামিন বি যুক্ত নানা শাকসব্জি অথবা ফল রোজকার ডায়েটে অবশ্যই খাওয়া যেতে পারে । পালং শাক, দুধ, ডিম, টুনা ফিস্ অ্যাভোগাডো, কলা ইত্যাদিতে ভিটামিন বি পর্যাপ্ত পরিমানে থাকে । শরীরে আগে ভাগেই এই ভিটামিনের মাত্রা ঠিক থাকলে মাথা ব্যাথার তীব্রতা অনেকটাই কম থাকার সম্ভাবনা থাকে ।
8. ম্যাগনেশিয়াম:
শরীরে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি থেকেও মাইগ্রেনের ব্যাথা হতে পারে । তাই ম্যাগনেশিয়াম আছে এমন খাদ্যবস্তু রোজ খাওয়াটা অপরিহার্য । বাদাম, অ্যাভোগাডো, মাছ, চীজ ইত্যাদিতে ম্যাগনেশিয়ামের পরিমান বেশী থাকে । এখানে এও উল্লেখ্য যে ডার্ক চকোলেটে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম থাকে কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রে চকোলেট মাইগ্রেনের ব্যাথা কে বাড়িয়ে দেয় তাই আপনার নিজের শরীর বুঝে তবেই ডার্ক চকোলেট খাওয়াটা ভালো ।
এই ফাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে মাইগ্রেনের ব্যাথা শুরু হওয়ার পর ম্যাগনেশিয়াম কিংবা ভিটামিন বি আছে এমন খাবার খেলে তৎখোনাৎ ব্যাথা মোটেই কমবে না । এইসব খাদ্য বস্তু যদি আপনি রোজ আগে থেকে খেয়ে শরীরে ম্যাগনেশিয়াম এবং ভিটামিন বি এর পরিমান যথাযথ রাখেন তবে কোনো কারনবশত মাইগ্রেন হলে তার তীব্রতাকে হ্রাস করার জন্য শরীরে উপস্থিত এই এলিমেন্ট গুলি আপনাকে সাহায্য করবে ।
9. কোল্ড প্যাক:
মাইগ্রেনের ব্যাথায় বরফে অথবা ঠান্ডা জলের শেখ বিশেষভাবে কার্যকরী । মাইগ্রেনের জন্য কোল্ড থেরাপি ব্যবহারের সর্বোত্তম উপায় হ’ল একবারে 15 থেকে 20 মিনিটের জন্য আইস প্যাকটি প্রয়োগ করা। 2013 সালের সমীক্ষানুসারে বিশেষত বরফটিকে ঘাড়ের মোড়কের আকারে প্রয়োগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা মাথা ব্যথা এবং মাইগ্রেনের ব্যাথা এবং অস্বস্তি হ্রাস করতে সহায়তা করে।
10. সঠিক ডায়েট:
যেকোনো রোগের ক্ষেত্রেই সঠিক ডায়েটের বিশেষ প্রয়োজন আছে । মাইগ্রেনে ধাত থাকলে কিছু খাবার এবং কিছু পানীয় আপনাকে কম খেতে হবে । যেমন, অ্যালকোহল, রেড ওয়াইন, চকোলেট, ক্যাফিন যুক্ত পানীয় যথা কফি, টমেটো, চীনাবাদাম, লেবু ইত্যাদি যথা সম্ভব কম খেতে হবে ।
তবে বেশী পরিমান মাথা ব্যাথা হলে দেরী না করে অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন । চিকিৎসকের পরামর্শ ছারা নিজে থেকে কোনোপ্রকার ওষুধ সেবন করবেন না ।
উপরোক্ত উপায়গুলি আপনার কেমন লাগলো অবশ্যই লিখে জানান আমাদের কমেন্ট বক্সে ।