সৃষ্টির আদিম পর্বে প্রথম প্রানের সঞ্চারণ আমিবার পর মানব রূপের প্রথম আবির্ভাব আদম ও ইভ। সেই তখন ইভের গল্পেই নারীর প্রকাশ।আর তখন থেকেই নারী মাতৃ রূপের প্রতিভূ , সৃষ্টির আধার স্বরূপ।

এরপর সভ্যতার ও দেশের প্রকারভেদ ঘটেছে ; পরিবর্তন ও রূপান্তর এর কালচক্রে নারীর অবস্থানের ভিন্নান্তর হয়েছে। মানব কল্পনায় নারী স্বর্গের দেবী তথা মাতৃ রূপ ধারন করলেও আমাদের আলোচ্য বিষয় মর্ত্যধামে নারীর সেকাল ও একাল এর অবস্থানে কোন পরিবর্তন সাধন ঘটেছে কিনা!

আমরা যদি বিশেষত বঙ্গনারী তথা ভারতীয় নারী কে আলোচ্য বিষয়ের আলোকপাতের পর্দায় টানি তাহলে দেখতে পাব নারী জাতির পরিস্থিতি। আমরা ঠাকুমা,প্রঠাকুমাদের মুখে সংসারে এবং সমাজে নারীর ঘোমটা পরিবৃত নিতান্তই মানসিক ও সামাজিক উৎপীড়ন এবং নিপীড়ন কাহিনী প্রত্যেকেই  শুনেছি। রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের এই নারী জাতির উত্থানের জন্য সংগ্রামের ইতিহাসও পড়েছি । আমরা বিস্মিত হয়েছি শিউরে উঠেছি নারীর বাল্য বিবাহ, সতীদাহ প্রথার কথা পড়ে। তখনকার বিধবা নারীদের যে কত করুণ পরিণতি সে আজও সে সব পুরানো বাড়ির অন্দরের করুণ প্রতিলিপি পড়লে জানা জায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবেলার বহু গল্পে দেখি ঠাকুরবাড়ির অন্দরেও নারী অবগুন্ঠনের অন্তরাল

আজ একবিংশতির আধুনিক মনস্কতার শিক্ষিত যুগে এসে আমরা কি নারীর অবস্থানে সেকালের থেকে একালে কোন প্রকৃতই উন্নতি সাধন ঘটাতে ও তাদের কে সমাজে পুরুষের সাথে একসাথে সমমর্যাদায় একসরণীতে স্থান দিতে পেরেছি, আদপেই কি তাদের সেই সন্মানে পর্যভূষিত করতে পেরেছি?

যদি সত্যিই আজ নারীর অবস্থানের উন্নীতকরন ঘটে থাকে তবে সমাজের কাছে প্রশ্ন যে শাড়ির অবগুন্ঠন ছেড়ে সালোয়ার,জিন্স আর আধুনিক পোশাকি কি তার মাপকাঠি মাত্র? তবে নারী আজও কেন স্বাধীন নয়? শুধু চাকুরীবৃত্তি আর উচ্চশিক্ষাই কেবলমাত্র স্বাধীনতার মাপকাঠি হতে পারেনা কখনই।  ‘চর্যাপদে’ আমরা পড়েছি “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”, নারীর আবস্থাও প্রায় একইরন; তার চাক্ষুষ প্রমান সদ্য হাথরাস কাণ্ড, নির্ভয়া কাণ্ড, পার্ক ষ্ট্রীট ধর্ষণ কাণ্ড। সৃষ্টির ইতিহাসে চোখ রেখে বারংবার শুধু এই নিদর্শন-ই চোখে পড়বে নারী পরাধীন, পুরুষাধীন ও সম্ভোগের শিকার। আজও একা নারীর সমাজে টিকে থাকা দুরূহ। আজও তাই এক বিধবা, অবিবাহিতা ও বিবাহবিচ্ছিনা নারী কে সমাজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুপে হেনস্থা হতে হয়।

লোপামুদ্রা, গার্গী, মৈত্রী, অপালা এই ক্ষণিক সময়পর্ব ছিল নারী শাষিত, এর পর পুনরায় নারীর ক্ষমতা কে খর্ব করা হয়েছে।

আজও নারীর নিজের অস্তিত্ব সঙ্কট, তাই কোথাও ভ্রূণ হত্যা, কোথাও আস্তাকুঁড়ে সদ্যজাতার খোঁজ মেলে, কোথাও ধর্ষণ কাণ্ড, কোথাও তুলা যন্ত্রে পরিমাপ করে পণ এর শিকার যেন তার নিজস্ব কোন মূল্য নেই; পাত্রের উপযুক্ততা পেতে ও সমতুল্য হয়ে উঠতে তাকে পণের মূল্য চোকাতে হয়, রাজস্থানের প্রত্যন্ত কোন গ্রামে আজও সতীদাহ হয়, কোথাও নারীকে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে বিকিয়ে যেতে হয়, আর বিবাহ উত্তর নারী তো  তার পিতার ঘর ত্যাগ করে; মা – বাবা কে ছেড়ে যাবজ্জীবন স্বামীর ঘরে চলে যায়; যেখানে তার মতামত কেন তার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পদবী টুকুও হারিয়ে যায়। নারীর অস্তিত্ব সঙ্কট আজও সমান্তরাল।

আজকের আধুনিক মনস্ক শিক্ষিত সমাজের কাছে আমার তথা সমগ্র নারী জাতীর একটিই মাত্র প্রশ্ন যে নারীর সেকাল ও একাল এ প্রকৃত অর্থে প্রকারভেদ কোথায়, কোথায় ন্যায়সঙ্গত তারতম্য ? এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর খুঁজুক সমাজ। নয়ত এই অন্যায়, অবিচার, ব্যাভিচার, নিপিড়ন-উৎপীড়ন থেকে নারী জাতীর মুক্তিলাভ অসম্ভবপ্রায়। সমাজের মেরুদণ্ড থেকে ঘুন পোকার স্খলন ঘটিয়ে সমাজ কে উন্নতির পথে অগ্রসর করতে নারী জাতীর উত্থান অত্যাবশ্যকীয়।