তৃতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার নেতৃত্বে আবারও পাঁচ বছরের জন্য বাংলা শাসনের দায়িত্ব পালন করবে জোড়া ফুল শিবির। মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পরপর তিনবার সরকার গঠন করার কৃতিত্ব এর আগে ভারতে আর কারোর ছিল না। রেকর্ড গড়লেন মমতা। এদেশে সবচেয়ে বেশিবার মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন জয়রাম জয়ললিতা। কিন্তু তিনি কখনোই টানা তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হননি। সর্বচ্চ টানা দু’বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন আম্মা। তৃণমূল নেত্রীর এই বিরল রেকর্ড গড়ার দিনে আমরা চোখ বুলিয়ে নেব তার রাজনৈতিক জীবনের পাঁচটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের দিকে।
১) প্রথম সংসদ হওয়া-
১৯৮৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে দেশের ৫২৩ টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৫ টিতেই জয়ী হয় কংগ্রেস। রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে সেবার বিরল রেকর্ড গড়ে জয়ী হয়েছিল তারা। এই সাফল্য তার আগে বা পরে আর কেউ পায়নি। এই ভোটেই মাত্র ২৯ বছর বয়সেই কংগ্রেসের উঠতি যুব নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাদবপুর কেন্দ্রে প্রার্থী করেছিলেন রাজীব গান্ধী। তার উল্টো দিকে ছিলেন হেভিওয়েট সিপিআই(এম) নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
সোমনাথ বাবু ততদিনে সংসদে প্রায় ১৩ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। তার বাগ্মিতায় দেশের তাবড় তাবড় নেতারা মাত হয়ে যান। যাদবপুর কেন্দ্রে সোমনাথ বাবুর জয় নিয়ে একরকম নিশ্চিত ছিল বাম শিবির। কিন্তু সেবারের কংগ্রেস ঢেউয়ে দেখা যায় উনিশ হাজারের কিছু বেশি ভোটে রাজনীতিতে নবাগতা মমতা হারিয়ে দিয়েছেন এই দুঁদে বাম নেতাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে এই মুহূর্তটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলা যায়। আজকের দাপুটে জননেত্রী হয়ে ওঠার সূত্রপাত ঐদিন ঘটেছিল। সেই সময় বয়সের কারণে যদি রাজীব গান্ধী তাকে প্রার্থী না করতেন তাহলে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইলেও বইতে পারত।
২) একুশে জুলাই আন্দোলন-
১৯৯৩ সাল। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী। তার সঙ্গে দলের মূল সংগঠনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। এই পরিস্থিতিতে বামেদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপি করার অভিযোগ তুলে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করলো যুব কংগ্রেস। যদিও এই জাতীয় দলের মূল সংগঠন সে সময় খুব একটা পাশে থাকেনি মমতার।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক করলেন ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযান করবেন। তিনি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘মহাকরণ দখল কর’। নির্ধারিত দিনে হাজার হাজার যুব কংগ্রেস কর্মী রাস্তায় নেমে আসেন। মমতার নেতৃত্বে শুরু হয় মহাকরণ অভিযান। হঠাৎই হিংসাত্মক হয়ে ওঠে যুব কংগ্রেস কর্মীদের একাংশ। সেই সুযোগে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব মণীশ গুপ্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। মৃত্যু হয় ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর।
২১ জুলাই ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যুর পর থেকে প্রতি বছর এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে নিজের দল তৈরি করার পরও তার নেতৃত্বে সংঘটিত এই আন্দোলনের স্মৃতিতে দিনটি উদযাপন করেন। একুশে জুলাই আন্দোলনের যে ঐতিহ্য মমতা বহন করছেন সেটা তাকে জননেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করেছে। একুশে জুলাই পালন করতে গিয়ে রাজ্যব্যাপী প্রতিটি মানুষের সঙ্গে তার সংযোগ গড়ে ওঠে।
৩) নিজের রাজনৈতিক দল গঠন-
তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল অহি-নকুল সম। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে সোমেন মিত্রের কাছে পরাজিত হন মমতা। এরপরই তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন কংগ্রেসে আর থাকবেন না। শুরু করেন নিজের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতি। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা তৃণমূল কংগ্রেসের পথ চলা।
মমতা যদি তৃণমূল কংগ্রেস গঠন না করতেন তাহলে বামেদের বিরুদ্ধে সর্বতো আন্দোলন গড়ে তোলা তার বিরুদ্ধে কতটা সম্ভবত সেই নিয়ে সংশয় আছে। কারণ কংগ্রেস জাতীয় দল হওয়ায় তাদের কিছু বাধ্যবাধকতা থেকে যায়। মূলত সেই কারণেই মমতা দল ছেড়েছিলেন। কারণ রাজ্যব্যাপী সার্বিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বারবার তার লাগাম টেনে ধরছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। স্বাভাবিকভাবেই বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই লড়ার জন্য অন্য প্ল্যাটফর্মের দরকার হয়ে পড়েছিল তার। সেই জায়গা থেকেই তৃনমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তার পরবর্তী অধ্যায় সকলের জানা।
৪) একা মমতা, তবু নাছোড়-
২০০৪ সাল। বিজেপি বিরোধী হাওয়া বইছে সর্বত্র। লোকসভা ভোটে ঐতিহাসিক সাফল্য পেল বামেরা। কংগ্রেস এবং বিজেপির পর জোরালো তৃতীয় পক্ষ হিসেবে গোটা দেশে উঠে আসলো তারা। এই নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে লড়াইয়ের কুফল টের পেলেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি লোকসভা কেন্দ্রের সবকটিতে হেরে গেল তার দলীয় প্রার্থীরা। কেবলমাত্র দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে জয় লাভ করলেন তিনি। জয়ের ব্যবধান কমে হয়ে গেল অর্ধেক।
এরপরও হাল ছাড়েননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। এবারেও নিরাশ হতে হল তাকে। রাজ্যে মাত্র ৩০ টি বিধানসভায় জয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পর্যন্ত খোয়ালো তৃণমূল। উপর্যপরি বিপর্যয় সত্বেও হাল ছাড়েননি মমতা। তার সুফল পেয়েছেন ২০১১ সালে। কিন্তু তার এই লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল ২০০৪ এর লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার দিন। যেদিন ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েও ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়েছিলেন মমতা।
৫) যেদিন মহাকরণে প্রথম পা রাখলেন-
দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালের ১৯ মে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর মহাকরণে প্রবেশ করেন তিনি। এটি বাংলার রাজনীতিতে ঐতিহাসিক একটি মুহূর্ত। তিনি প্রথম পশ্চিমবঙ্গ মহিলা মুখ্যমন্ত্রী পেল। তার ওপর দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটেছিল তার হাত ধরে।
যে মহাকরণ অভিযান করতে গিয়ে ১৩ জন দলীয় সতীর্থকে হারিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজার হালে তার প্রবেশ করার ঘটনা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। যে জনসমর্থনে ভেসে গিয়ে তিনি মহাকরণের প্রবেশ করেছিলেন তা অতীতে কখনও দেখা গেছে কিনা সন্দেহ আছে।