১৭ এপ্রিল রাজ্যের পঞ্চম দফার ভোটে আরও ৪৫ টি কেন্দ্রে ভোট হবে। পঞ্চম দফার এই ভোটে উত্তরবঙ্গে যেমন নির্বাচন হবে তেমনি রাজ্যের সবচেয়ে বেশি বিধানসভা কেন্দ্র ধাকা উত্তর চব্বিশ পরগনাতেও ভোট হবে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই দফাতে রাজ্যের বেশকিছু হেভিওয়েট প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হবে। এই দফার ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে ব্যাপক ঝড় বয়ে যায়। সব মিলিয়ে পঞ্চম দফার ভোটে নানান গুরুত্বপূর্ণ দিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা এরকমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
১) চতুর্থ দফার অশান্তির পর প্রথম ভোট-
চতুর্থ দফার ভোটে কোচবিহার জেলার শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চার জনের মৃত্যুর ঘটনা সবার জানা। কিন্তু ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পর্যায়ে রাজ্য রাজনীতি ব্যাপক তোলপাড় হয়। বিজেপি যেমন কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালানোর ঘটনাকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেছে, তেমনি তৃণমূল অভিযোগ করেছে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির কারণে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে গোটা ঘটনা বিজেপির পক্ষ থেকে ঘটানো হয়েছে। সেইসঙ্গে এই ঘটনার পর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনা হলেও তা নিয়েও একাধিক প্রশ্ন আছে।
গুলি চালানোর ঘটনা বলে বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেই ভিডিওগুলি আসলে কতটা সত্যি তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে সর্বত্র। শীতলকুচি কাণ্ডের পর রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে শীতালকুচি কাণ্ডের পর প্রথম ভোট হবে ১৭ এপ্রিল। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের সাধারণ মানুষ ওই ঘটনার পর ঠিক কি মনে করছেন তা বোঝা যাবে পঞ্চম দফার ভোটে।
২) শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক পদক্ষেপের পর প্রথম ভোট-
চতুর্থ দফার ভোটের পর তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারের ওপর ২৪ ঘন্টা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন। তারপরের দিনেই বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা ওপর ৪৮ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা জারি করে কমিশন। পাশাপাশি বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে শোকজ এবং শুভেন্দু অধিকারীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। সব মিলিয়ে বলা যায় রাজ্যের এতগুলো শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কড়া পদক্ষেপ গ্রহণের পর প্রথম ভোট হচ্ছে পঞ্চম দফায়। স্বাভাবিকভাবেই কমিশনের শাস্তিমুলক পদক্ষেপকে রাজ্যবাসী ঠিক কিভাবে দেখল সেটা বোঝা যাবে ১৭ এপ্রিলের ভোটে।
৩) করোনা পরিস্থিতির প্রভাব-
করোনা পরিস্থিতিতে গোটা রাজ্য জুড়ে ভোট হচ্ছে। কিন্তু গত দুই সপ্তাতে দেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের করোনা পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলির ভোট প্রচারে এই সংক্রান্ত সতর্ক বিধি তেমন একটা মেনে চলা হচ্ছে না। কিন্তু আদালতের নির্দেশে পঞ্চম দফার ভোট থেকে কড়া সতর্কতা বিধি মেনে চলতে বাধ্য রাজনৈতিক দলগুলি এবং নির্বাচন কমিশন। এরকমও শোনা যাচ্ছে করোনার বাড়বাড়ন্তের কারণে নির্বাচন কমিশন শেষ তিনটি দফার ভোট এক’দিনে সেরে ফেলতে পারে।
সব মিলিয়ে বর্তমানের লাগামছাড়া করোনা পরিস্থিতি পঞ্চম দফার ভোটে আলাদা কোনও প্রভাব ফেলে কিনা সেটাই দেখার। কারণ করোনা আতঙ্কে ভোটারদের একাংশের ভোট দিতে না আসার সম্ভাবনা ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে। এদিকে পঞ্চম দফার ভোটের নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়ার দিনেই বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তারা করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আর কোনও বড়ো সমাবেশ করবে না। স্বাভাবিকভাবেই বামেদের এই ঘোষণা তৃণমূল এবং বিজেপির ওপর চাপ বাড়িয়েছে। মানুষের স্বাস্থের কথা মাথায় রেখে বামপন্থীদের এই অবস্থান জণগনের মনে আলাদা কোনও রেখাপাত করতে পারে কিনা সেটাও বোঝা যাবে এই পঞ্চম দফার ভোটেই।
৪) নির্ণায়ক মতুয়া ভোটের দখল-
প্রথম চারটি দফার নির্বাচন যে সমস্ত কেন্দ্রে হয়েছে সেগুলোতে মতুয়া ভোট ততটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু পঞ্চম দফার নির্বাচন নদিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার যেসমস্ত কেন্দ্রে হবে সেই জায়গাগুলিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের একচেটিয়া বসবাস। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্য রাজনীতির অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি মতুয়াদের ভোট কোনপক্ষে যাচ্ছে তা অত্যন্ত কৌতূহলের বিষয়। কারণ ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে মতুয়াদের ভোট বেশিটাই বিজেপির দিকে গিয়েছিল। এবারে ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে মতুয়া ভোটকে আবার নিজেদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে হবে তৃণমূলকে। অন্যদিকে মতুয়াদের ভোটের ওপর প্রভাব বিজেপি ধরে রাখতে পারল কিনা তা পঞ্চম দফার ভোটেই প্রমাণ হয়ে যাবে।
৩) সিন্ডিকেট রাজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ-
তৃণমূল আমলে গত দশ বছরে রাজ্যের সর্বত্র সিন্ডিকেট রাজ চলার অভিযোগ উঠেছে। তবে এই অভিযোগ সবচেয়ে গুরুতর ছিল রাজারহাট, নিউটাউন এবং সল্টলেক অঞ্চলে। যদিও ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর তৃণমূল ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেটের মাথাদের একাংশ বিজেপির ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। সিন্ডিকেট প্রভাবিত এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোট পঞ্চম দফায় হবে।
মজার বিষয় হচ্ছে সিন্ডিকেটের মাথাদের পিছনে এলাকার সাধারণ মানুষের সমর্থন আর আগের মত ততটা নেই। তাই পঞ্চম দফার ভোটে প্রমাণ হয়ে যাবে সিন্ডিকেটের মাথারা বাংলার রাজনীতিতে আদৌ আর কোনও ফ্যাক্টর কিনা? নাকি তারা যে পক্ষে থাকে সেই পক্ষেরই জয় নিশ্চিত নির্বাচনী লড়াইয়ে? বাংলার আমজনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নির্ধারণ হয়ে যাওয়ার কথা পঞ্চম দফার ভোটেই।