বাংলার বিধানসভা নির্বাচন হাঁটি হাঁটি পায়ে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। তৃতীয় দফার ভোট হয়ে যাওয়ার পর এবার চতুর্থ দফার প্রস্তুতি চলছে। ইতিমধ্যে ৯১ টি আসনে নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। আর‌ও ২০৩ টি আসনে ভোট বাকি। অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত যে নির্বাচন হয়েছে তার ভিত্তিতে মোটেও বলা সম্ভব নয় কারা সরকার গঠন করছে, কোন দল কতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে। কারণ এখনও পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে ভোট প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। জেলা ধরে বলতে গেলে দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রাম জেলায় ভোট শেষ হয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অর্ধেক আসনের ভোট পর্ব মিটেছে। একই কথা খাটে হাওড়া, হুগলি জেলার ক্ষেত্রে। বোঝাই যাচ্ছে রাজ্যের বেশিরভাগ জেলায় এখনও ভোটের লড়াই শুরু হয়নি।

সবেমাত্র ৯১ টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট হলেও রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই তাদের প্রাপ্ত আসনের হিসেব নিয়ে বাজার গরম করতে শুরু করে দিয়েছে। এটা অবশ্য বরাবরই রাজনৈতিক দলগুলো করে থাকে। বলা যেতে পারে ভোট কৌশলের অন্যতম অংশ হল আগাম আসন সংখ্যা জনমানসে তুলে ধরা। এর মাধ্যমে ভোট গণনার দিন পর্যন্ত নিচুতলার কর্মীদের চাঙ্গা রাখা যায়। আসলে ভোটের লড়াই উন্নয়ন-অনুন্নয়ন, পরিষেবা, আদর্শের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ‌ও বটে। সেই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জমি শক্ত করার বিষয়ে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে গোছানো পদক্ষেপ করেছে বিজেপি। চতুর্থ দফার ভোটের আগে বেহালায় ভোট প্রচারে এসে অমিত শাহ দাবি করেছেন যে ৯১ টি কেন্দ্রে এখনও পর্যন্ত ভোট হয়েছে সেখানে তারা ৬৩ থেকে ৬৮ টি আসন পাবেন। নির্দিষ্ট হিসেব তুলে ধরা না হলেও তৃণমূলের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে ভোট পর্ব যত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই বিজেপি ময়দান থেকে সাফ হয়ে যাচ্ছে। আবার তৃতীয় পক্ষ হিসেবে উঠে আসা সংযুক্ত মোর্চার দাবি তারা কড়া টক্করের মুখে ফেলে দিয়েছে দুই প্রধান প্রতিপক্ষকে। তাদের তরফ থেকে অবশ্য নির্দিষ্ট কোন‌ও আসন সংখ্যা বা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি।

আমরা বরং তৃতীয় দফার ভোটের শেষে পাল্লাটা কোন দিকে ঝুঁকে বা কেন ঝুঁকে সেটা একটু আলোচনা করে দেখি।


[  ]  কিছুটা হলেও অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল-

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল যে সরকার বিরোধী মনোভাবের সম্মুখীন হয়েছে তা এতদিনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারি পরিষেবা নিয়ে সাধারণ মানুষের যতটা না ক্ষোভ আছে, তার থেকে অনেক বেশি দায়ী তৃণমূলের স্থানীয় স্তরের নেতৃত্বের লাগামছাড়া দুর্নীতি ও অত্যাচার। তবে তৃণমূলের অভিযুক্ত নেতাদের একাংশ বিজেপিতে গিয়ে ভেড়ায় সেই ক্ষোভের আঁচ অল্প কিছুটা হলেও কমেছে। আবার সংযুক্ত মোর্চা কর্মসংস্থানের ইস্যুকে ভোট বাজারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তৃণমূলে প্রতি অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়েছে। ভোটের পাটিগণিতে এই যোগ বিয়োগের খেলা শেষ পর্যন্ত চলবে। যে দল ক্ষমতায় ফিরে আসে তারা এই সমস্ত জটিল হিসেবে সামলেই ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধেই যেমন সরকার বিরোধী হাওয়া আছে তেমনই বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে রাজ্যের সাধারণ মানুষের একটা বড়ো অংশ আতঙ্কিত। সেই অংশটা মানসিকভাবে সংযুক্ত মোর্চার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেও মনে করছিলেন বিজেপিকে আটকানো মোর্চার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা শেষ পর্যন্ত বিজেপিকে আটকানোর প্রশ্নে তৃণমূলের ওপর আস্থা রাখছে। এই হিসেবে বিজেপি এবং সংযুক্ত মোর্চার থেকে কিছুটা হলেও অ্যাডভান্টেজ অবস্থায় আছে তৃণমূল। তবে এখনও পর্যন্ত ভোটের যে ট্রেন্ড তা যদি শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে এবার আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারবে না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। তারা বড়োজোর আসন সংখ্যার নিরিখে রাজ্যের সর্ব বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে উঠে আসতে পারে।

দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূল কেমন ফল করে সেটার ওপর এই সবটা নির্ভর করছে। উত্তরবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের মতো বিপর্যয়ের না ঘটলেও তৃণমূলের ফল যে খুব একটা ভালো হবে না তা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার। তৃণমূলের ফলাফল আগের থেকে অনেকটাই খারাপ হওয়ার আভাস তাদের নেতৃত্তের কথাতেও লুকিয়ে আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার দলের ফল আগের থেকে বেশ কিছুটা খারাপ হতে পারে।


[  ]  বিজেপির হিসেব গুলিয়ে দিচ্ছে সংযুক্ত মোর্চা-

২০১৯ এর লোকসভা ভোটের পর তৃণমূল বিরোধী প্রধান পক্ষ হিসেবে উঠে আসে বিজেপি। শুভেন্দু অধিকারী তাদের দলে যোগ দেওয়ার পর একসময়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তৃণমূলকে হেলায় হারিয়ে দেবে বিজেপি কিন্তু গেরুয়া শিবিরের অভ্যন্তরের ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের একাংশের মোহভঙ্গের ফল নির্বাচনী লড়াইয়ে ভুগতে হচ্ছে বিজেপিকে।

গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে বিজেপিকে সবচেয়ে শক্তিশালী পক্ষ মনে করেছিল ভোটারদের একাংশ। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৮ জন সাংসদকে লোকসভায় পাঠাতে সক্ষম হয় তারা। কিন্তু বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ এর জোট সংযুক্ত মোর্চা ভোট ময়দানে নামার পর থেকেই দ্রুত স্কোরিং করতে শুরু করে। এই মুহূর্তে যথেষ্ট শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে তারা। সবচেয়ে বড় কথা মোর্চা সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যে এই মনোভাব তৈরি করতে পেরেছে এবারে পশ্চিমবঙ্গে ত্রিশঙ্কু ফল হতে চলেছে। অর্থাৎ তৃণমূল বা বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না।

বর্তমানে বিজেপি বিরোধী মানুষের একাংশের মধ্যে এই মনোভাব তৈরি হয়েছে বিজেপিকে আটকাতে সংযুক্ত মোর্চা সক্ষম। স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূল বিরোধী অথচ বিজেপিকেও পছন্দ করে না এরকম মানুষদের ভোট সংযুক্ত মোর্চার ঝুলিতে এসে জড়ো হচ্ছে। এর ফলে বর্তমান সরকার বিরোধী ভোট বিজেপি এবং মোর্চা এই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ায় সবচেয়ে বিপদ বিজেপির। খুব সামান্য ব্যবধানে হলেও তাদের বেশির ভাগ আসন এর ফলে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে বিজেপি নেতৃত্ব। অমিত শাহ যতই দাবি করুন তারা প্রায় ৭০ শতাংশ স্ট্রাইকরেট রেখে খেলছেন, বাস্তবে কিন্তু গোটা ছবিটা সেরকম হবে না বলেই মনে হয়।


[  ]  তলানি থেকে উঠে এসে মূল নির্ণায়ক হতে পারে সংযুক্ত মোর্চা-

তৃতীয় দফার ভোট হয়ে যাওয়ার পর আপাতত যা পরিস্থিতি তাতে তৃতীয় স্থানে থাকার কথা সংযুক্ত মোর্চার। কিন্তু একসময় মনে করা হচ্ছিল তারা সে রকম আসন পাবে না বললেই চলে। সেই পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু প্রভাবিত এলাকাগুলিতে তৃণমূলকে পরাস্ত করে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনা এবারে অত্যন্ত উজ্জ্বল। সব মিলিয়ে সংযুক্ত মোর্চা যত প্রভাব বিস্তার করছে তত ভোট শতাংশ কমার সম্ভাবনা বিজেপির। তবে তারা যে তৃণমূলের ভোটে ভাগ বসাবে না ব্যাপারটা এরকম কিন্তু নয়। কারণ তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক তছনছ করে দিতে পারে সংযুক্ত মোর্চা। এরকম একটা সম্ভাবনাও জোরালোভাবে উঠে আসছে।

ভোটের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আপাতত যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে এই ট্রেন্ড যদি শেষ পর্যন্ত চলে তবে তৃণমূলের পর দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনা আছে সংযুক্ত মোর্চার। সে ক্ষেত্রে যে পক্ষই সরকার গঠন করুক না কেন মোর্চাকে বাদ দিয়ে চলতে পারবে না। তবে নীতি-আদর্শের বিষয়টা মাথায় রাখলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত মোর্চা তৃণমূলকে সমর্থন দিতে পারে বলে অনেকের ধারণা। অবশ্য আরেকটি ঘটনা ঘটতে দেখা যেতে পারে। হয়ত সংযুক্ত মোর্চা কাউকেই সমর্থন করল না। এর ফলে আবারও নির্বাচনে যেতে হবে পশ্চিমবঙ্গকে।


ভোট রাজনীতি মহান অনিশ্চয়তার খেলা। কে কখন কাকে পিছনে ফেলে সামনে উঠে আসে তা ভোটের ফল প্রকাশের আগে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তিনটে পক্ষই সাধারণ মানুষের মনে বেশ ভালো মতো প্রভাব ফেলেছে বলেই মনে হয়।