দ্বিতীয় দফার বিধানসভা ভোট আগামী বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে এই দফায় রাজ্যের যে ৩০ টি আসনে ভোট হবে সেগুলির রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেব আমরা।

দ্বিতীয় দফার ভোটে সবচেয়ে হাই ভোল্টেজ কেন্দ্র যে নন্দীগ্রাম তা বলার জন্য কোন‌ও পুরস্কার নেই। সত্যি বলতে পশ্চিমবঙ্গের সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচনে সবচেয়ে হাই ভোল্টেজ কেন্দ্র এটাই। বলতে গেলে এবারের নির্বাচনে পাওয়ার সেন্টারে পরিণত হয়েছে নন্দীগ্রাম। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নন্দীগ্রাম জমি রক্ষা আন্দোলনের মূল কান্ডারী শুভেন্দু অধিকারীর মুখোমুখি লড়াইয়ের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে জোরালোভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে এখানকার সিপিআই(এম) প্রার্থী তরুণ প্রজন্মের মিনাক্ষী মুখার্জি।

মিনাক্ষী মুখার্জির প্রচার এবং নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষের ব্যাপক জনসমর্থনের ফলে এখানকার দ্বিমেরু হাইভোল্টেজ লড়াই শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে ত্রিমুখী তুল্য মূল্য পাঞ্জা কষায়। নন্দীগ্রামের ভোটের ফল জানতে হলে রাজ্যের বাকি ২৯৩ টি কেন্দ্রের মতোই আগামী ২ মে বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আপাতত ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল এই দফায় কি হতে পারে তা আমরা দেখব। তবে এই দফায় নন্দীগ্রাম ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি আলোচিত বিধানসভা কেন্দ্র আছে এবং তৃণমূল-বিজেপি মিলিয়ে উভয়পক্ষের আরও বেশ কয়েকজন তারকা প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দ্বিতীয় দফার ভোটে।

পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না বিধানসভা কেন্দ্র এবারে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার অশোক দিন্দার সৌজন্যে। বরাবরের শুভেন্দু অনুগামী হিসেবে পরিচিত এই ক্রীড়াবিদ এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ময়না কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এলাকায় সাধারণ মানুষের পাশে বিপদে-আপদে দাঁড়ানো দিন্দার জনপ্রিয়তা ব্যাপক এলাকায়। এই ক্রিকেটারের কাঁধের ওপর ভর করে ময়না বিধানসভা কেন্দ্রটিতে জেতার বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী গেরুয়া শিবির।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আরেকটি তারকাখচিত বিধানসভা কেন্দ্র হল চন্ডীপুর। টলিউড অভিনেতা সোহম চক্রবর্তী এই কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে বাঁকুড়ার বড়জোড়া কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে সিপিআই(এম)-এর কাছে হেরে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার ভোট ময়দানে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে নেমেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর হয়ে প্রচার পর্যন্ত করে গিয়েছেন। এবারের ভোটে জয়ের বিষয়ে অনেকটাই আশাবাদী এই অভিনেতা।

দ্বিতীয় দফার ভোটে আরেকটি তারকাখচিত কেন্দ্র হল খড়গপুর সদর। এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে হিরণ্ময় চট্টোপাধ্যায়কে। পুরো নাম শুনে হয়ত বোঝা গেল না ইনি কে, ইনি আসলে টলিউড ষ্টার হিরো হিরন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ‌। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে মেদিনীপুর কেন্দ্র থেকে সাংসদ হওয়ার পর খড়গপুর সদরে নিয়মমতো উপনির্বাচন হয়। উপনির্বাচনে হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় তৃণমূল। এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করে তৃণমূল প্রার্থী। সেদিক থেকে দেখতে গেলে খড়গপুর সদরে হিরনের লড়াই খুব একটা সহজ নয়। যদিও বিজেপির আশা তারা তাদের এই তারকা প্রার্থীর ওপর ভর করে কেন্দ্রটি আবার পুনর্দখল করতে পারবে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের আরেকটি বিধানসভা কেন্দ্র এই দফায় নজরে উঠে এসেছে। ডেবরায় এবারে লড়াই দুইজন আইপিএসের মধ্যে। বিজেপি প্রার্থী ভারতী ঘোষ অনেকদিন ধরেই রাজনীতির ময়দানে আছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। যদিও টলিউড সুপারস্টার দেবের কাছে হেরে যান। এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার হুমায়ুন কবিরকে। এই দুই প্রাক্তন পুলিশ কর্তার লড়াই ডেবরায় বেশ আকর্ষক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে।

সবং কেন্দ্রটি এবারে আলোচনায় উঠে এসেছে তার পুরানো বিধায়কের জন্য। কংগ্রেস থেকে তৃণমূলের যাওয়ার পর রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন মানস ভুঁইয়া। পরবর্তীকালে এই কেন্দ্রের বিধায়ক হন তার সহধর্মিনী গীতারানী ভূঁইয়া। যদিও একুশের কঠিন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সবংয়ে সাংসদ মানস ভুঁইয়া-কেই আবার প্রার্থী করেছে তৃণমূল।

এই দফায় ভোট হওয়ার কথা বাঁকুড়া জেলার ৮ টি বিধানসভা কেন্দ্রে। তার মধ্যে জেলা সদর বাঁকুড়া কেন্দ্রে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল প্রার্থী করেছে আর এক তারকা সায়ন্তিকা চট্টোপাধ্যায়কে। এই কেন্দ্রটি তৃণমূলের বরাবরের শক্ত গাঁট। তারা আশা করছে সায়ন্তিকার তারকা ইমেজের উপর ভর করে এই কেন্দ্রটি যদি ছিনিয়ে নেওয়া যায়। যদিও গত লোকসভা ভোটে বাঁকুড়া জেলার ১২ টি বিধানসভা কেন্দ্রেই এগিয়ে ছিল গেরুয়া শিবির।

দ্বিতীয় দফার ভোটে কোন পক্ষ কতগুলি আসন পেতে পারে তা একবার দেখে নেওয়া যাক-

তৃণমূল:
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের নিরিখে দ্বিতীয় দফায় ভোট হতে চলা ৩০ টি কেন্দ্রের বেশিরভাগ আসনেই জয়লাভ করেছিল তৃণমূল। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক, হলদিয়া এবং পাঁশকুড়া পূর্ব কেন্দ্রটি তৃণমূলের থেকে ছিনিয়ে নেয় বামেরা। যদিও তমলুক এবং হলদিয়ার জয়ী বাম বিধায়করা ইতিমধ্যেই দল পরিবর্তন করে বিজেপিতে গিয়েছেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেবলমাত্র খড়গপুর সদর ও সবং কেন্দ্রটিতে পরাজিত হয়েছিল তৃণমূল। পরবর্তী উপনির্বাচনে খড়গপুর সদর কেন্দ্রটি উদ্ধার করে তারা। অন্যদিকে সবং কেন্দ্রের বিধায়ক মানস ভুঁইয়া কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে আসার পর উপনির্বাচনে জয়ী হয় তৃণমূল। বাঁকুড়া জেলার বাঁকুড়া, বড়জোড়ার মত কেন্দ্রগুলি তৃণমূল হেরেছিল গত বিধানসভা নির্বাচনে।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন অনুযায়ী এই ৩০ টি কেন্দ্রের মধ্যে বেশ ভালই প্রভাব বিস্তার করেছে গেরুয়া শিবির। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এই ৩০ টি কেন্দ্রে তৃণমূলের ফলাফল যতই ভালো হোক না কেন তা কোনোমতেই ২০১৬ এর বিধানসভা ভোটের ফলাফলের ধারে কাছে পৌঁছবে না। বিশেষজ্ঞদের হিসেব এই দফায় খুব বেশি হলে ১২ থেকে ১৫ টি বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হবে তৃণমূল।

বিজেপি:
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোট অনুযায়ী দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন হতে চলা ৩০ টি কেন্দ্রের মধ্যে কেবলমাত্র খড়গপুর সদর কেন্দ্রটিতে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। যদিও পরবর্তীকালে উপনির্বাচনে কেন্দ্রটি তাদের হাতছাড়া হয়। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফল অনুযায়ী বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বেশিরভাগ বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে আছে তারা। যদিও পূর্ব মেদিনীপুরে খুব একটা দাঁত ফোটাতে পারেনি গেরুয়া শিবির। গেরুয়া শিবিরের অন্যতম তারকা প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর ভাগ্য পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে এই দফাতেই। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের হিসেব অনুযায়ী লোকসভা ভোটের থেকে কিছুটা হলেও বিজেপির খারাপ ফল হবে বাঁকুড়াতে। তাদের হিসেবে দ্বিতীয় দফায় যে কেন্দ্রগুলোতে ভোট হবে তার মধ্যে বিজেপি ১০ থেকে ১৫ টি আসনে জয় লাভ করতে পারে।

সংযুক্ত মোর্চা:
দ্বিতীয় দফার ভোট যে ৩০ টি কেন্দ্রে হবে সেগুলির একটিতেও ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে এগিয়ে যেতে পারেনি সংযুক্ত মোর্চার শরিক দলগুলি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এবারের বিধানসভা ভোটে এখানে খুব একটা ভালো ফলের আশা না করাই উচিত রাজ্যের এই তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির। যদিও বিশেষজ্ঞদের হিসেব বাঁকুড়া জেলার কয়েকটি কেন্দ্রে মোর্চার ফল চমকে দিতে পারে রাজনৈতিক মহলকে। সব মিলিয়ে এই দফায় বিশেষজ্ঞরা সংযুক্ত মোর্চার ঝুলিতে ৩ টি থেকে ৫ টি আসন যেতে পারে বলে অনুমান করছেন।