সিলিঙে শতাব্দী প্রাচীন ইতালিয়ান মার্বেলের কারুকার্য।ঘর জুড়ে সেগুন কাঠের পুরনো আসবাব এবং সারি দিয়ে সাজানো বেলজিয়ান কাঁচের বাক্সে রকমারি স্বাদের কেক পেস্ট্রি সবই আগের মতো। নতুন কোন বিপণন কৌশল বা বিজ্ঞাপনের মারফৎ নাহুম অ্যান্ড সন্সের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়না। ব্রিটিশ আমল থেকে আজ অবধি নাহুমের কনফেকশনারি বহন করে চলেছে এক অনন্য স্বাদ-গন্ধের ইতিহাস।
সারাবছরই সমানতালে কেক, ক্যান্ডির চাহিদা থাকলেও শীতের শুরু থেকে পামকেক, আমন্ড টার্ট ও বিভিন্ন পেস্ট্রি কেনার ধুম পড়ে যায় নাহুমে। ক্রিস্টমাসের সপ্তাহে দোকান খোলার আগে থেকেই শতাধিক মানুষ বড়দিনের কেক কেনার জন্য লাইন দেন নিউমার্কেটের নাহুম অ্যান্ড সন্স এর দরজায়। বড়দিনের সেন্ট্রাল কলকাতায় নাহুমের কেকের গন্ধ আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেয় ক্রিস্টমাস কেবল খ্রিস্টধর্মের সংস্কৃতি নয়, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের আনন্দ-উল্লাসে ভরা এক বিপুল মিলনউৎসব।
ঔপনিবেশিক কলকাতা ছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ভাগ্যান্বেষণের ক্ষেত্র। উনিশ শতকে অন্যান্য চাকুরিসন্ধানীদের মতই বাগদাদ থেকে এসেছিলেন ইহুদী যুবক নাহুম ইস্রায়েল মোর্দেকাই। শহরে এসে তিনি বেকারি শিল্পের অনুরাগী হয়ে কেক বানাতে শুরু করেন। তখনও জানতেন না এ বিষয়ে তাঁর শৈল্পিক দক্ষতা ভবিষ্যৎ রচনা করতে চলেছে।
১৯০২ সালে হগ মার্কেটের কাছে একটা ছোট্ট আউটলেট খুলে তা থেকে ঘরে ঘরে নিজের বানানো কেক পেস্ট্রি বিক্রি শুরু করতে শুরু করেন ইস্রায়েল নাহুম। কিন্তু জিভে জল আনা নাহুমের হাতের সেইসব খাবার মুখে দেওয়া মাত্রই জনপ্রিয় হয়ে যায়। ব্রিটিশরা ধন্য ধন্য করতে থাকেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটি এবং স্থানীয় মানুষদের মধ্যে যারা মিষ্টিপ্রেমী ছিলেন তাঁরাও নাহুমের ভক্ত হয়ে পড়েন রাতারাতি। ফলত, প্রতিভার গুণেই ভাগ্য খুলে যায় ইস্রায়েলের, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এরপর ইস্রায়েল নাহুমের তৈরি ছোট্ট আউটলেট স্থান পরিবর্তিত হয়ে চলে আসে নিউমার্কেটের এখনকার জায়গায়, ১৯১৬ সালে সেখানেই গড়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী নাহুম অ্যান্ড সন্স, কলকাতার প্রাচীনতম ইহুদী বেকারি। সেই থেকে আজ অবধি মৌলিক স্বাদ ও মানের কেক, পেস্ট্রি, ব্রাউনি, ম্যাকারুন, ক্যান্ডি প্রভৃতি সরবরাহ করে শহরের মানুষের আভিজাত্যের রুচিকে সযত্নে লালন করে চলেছে নাহুম । শুধু কলকাতার বাসিন্দারাই নন,কলকাতায় বসবাসকারী বা ভ্রমণকারী বিদেশী মানুষরাও নাহুমের খাবার খেতে আসেন, দেশে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে যান নাহুমের উপহার।
১৯৬৪ সালে ইস্রায়েলের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে ইলিয়াস নাহুমকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। বর্তমানে নাহুম অ্যান্ড সন্সের পরিচালক আইজ্যাক নাহুম। তিনি ইস্রায়েলের নাতি এবং পেশায় একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। ২০১৩ সালে তৎকালীন কর্ণধার ভাই ডেভিডের অকাল মৃত্যু হলেও কর্মচারীদের ভালোবাসায় এবং আইজ্যাক ও তাঁর অন্যান্য ভাইবোনেদের সাহচর্যে নাহুমকে অভিভাবকহীন হতে হয়নি এক মুহূর্তও। মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কোনোদিন ত্রুটি রাখেনি তাঁদের আতিথেয়তা।
এতগুলো বছরে কলকাতা জুড়ে অনেক নামজাদা কেকপেস্ট্রির দোকান, কফিশপ এবং শপিং মল জায়গা করে নিয়েছে কিন্তু নাহুম কিছুমাত্র না বদলেও এখনও একই জনপ্রিয়তা বজায় রেখে চলেছে। প্রতিযোগিতায় না নেমেই জয়ী! এ যে কতখানি চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল নাহুম পরিবারের কাছে, তা অনুমান করা শক্ত।
অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে নাহুমের প্রসঙ্গ। ইস্রায়েলের সময়ে নাহুমের কেকের ভক্ত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ডেভিড নাহুমের সময়ে ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ জিওফ্রে ফিশার এসে কেক খেয়ে বলেছিলেন- তিনি জীবনের সেরা ফ্রুট কেক নাহুমে খেলেন। নিয়মিত খদ্দের ছিলেন অভিনেতা সুচিত্রা সেনও। সৌরভ গাঙ্গুলি এখনও নাহুম থেকে কেক অর্ডার করেন। আর যাঁরা নিউমার্কেটে শপিং-এ গেলেই নাহুমে পেস্ট্রি খেয়ে সঙ্গে ব্রাউনির মাসকাবারি স্টক নিয়ে ফেরেন তাঁদের জন্যই নাহুম আজ মহীরুহ।
নাহুমের বর্তমান কর্ণধার আইজ্যাকের কথায় “I am now the standard-bearer for something that my grandfather started. I am trying to live up to those legends and maintain the principles that we’ve always had. We have been a bakery of the masses while never compromising on quality. The rich and famous and the not-so-rich and famous, they all come here,” (আমার ঠাকুরদা যে কাজটি শুরু করেছিলেন আমি এখন সেই আদর্শেরই বহনকারী। আমি এই কিংবদন্তীদের সাথে বেঁচে থাকার এবং আমাদের যে নীতিগুলি বরাবর ছিল তা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আমরা কখনই গুণমানের সাথে আপস করিনি, সেইসঙ্গে জনসাধারণের বেকারি হয়ে উঠেছি । বিখ্যাত ধনী ব্যক্তিরা যেমন এখানে আসেন, তেমনি মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষরাও আসেন। )
তিনি আরও বলেন – হোক হিন্দু , মুসলিম, ইরানীয়ান, ইহুদী বা চীনে, নাহুম জনগণের বেকারিশপ। কলকাতার মানুষ খেতে ভালোবাসেন। নতুন নতুন খাবার খেতে তাঁরা সবসময় আগ্রহী। নাহুম এতবছর ধরে কলকাতার জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং চরিত্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রসনা তৃপ্তির মধ্যে দিয়েই নিজেদের সমৃদ্ধ করে চলেছে।
নাহুমের সর্বাধিক জনপ্রিয় খাবারগুলির মধ্যে ফ্রুটকেক, লাইট পাম কেক, চকোচিপ ব্রাউনি, চিকেন প্যাটিস, আমন্ড কেক, ওয়ালনাট কেক প্রভৃতির নাম সকলেই জানেন, এছাড়াও ক্রিসমাসের সময় কুকি, ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক আরও নানা উপাদেয় সম্ভার বিশেষ আকর্ষণ হয়ে ওঠে। সবকিছুর দামই আয়ত্তের মধ্যে। ক্রিসমাস থেকে নিউ ইয়ার প্রতিবছরই ভিড় উপচে পড়ে দোকানে। তবু এবছরটা অন্যরকম। সতর্কতা মেনে, সামাজিক দূরত্ম বজায় রেখেই এবছর কেক সরবরাহ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন নাহুমের কর্মচারীরা।
কলকাতার এত বছরের ইতিহাসের ওঠাপড়ার সাক্ষী নাহুম এই করোনাকালেও জোরকদমে প্রস্তুত। ২০২০-র ক্রিসমাস কিছুটা বিধ্বস্ত হলেও তা নাহুমের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে পারেনা। কর্মচারীদের কথায়, তাঁদের কেক ফ্রিজে না রাখলেও এক সপ্তাহ টাটকা থাকে। অতএব, ক্রিসমাসে নাহুমের কেক খেতে হলে এখুনি কিনতে বেরিয়ে পড়ুন! নাহলে সেই শয়ে শয়ে মানুষের পেছনে আগেরদিন লাইন দিতে হবে আপনাকেও।
আপনার পছন্দের নাহুম কেক কোনটি? নীচের কমেন্ট বক্সে জানান, আর পড়তে থাকুন বাংলা খবর।
[…] Source: IMDB নাহুমের কেকে জমে উঠুক বছর শেষের আনন্দ […]