মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে তার সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮-২৯ সালে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অন্তর্গত অযোধ্যার রামকোট হিলের ওপর বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। বাবরের নামানুসারে বাবরি মসজিদ নামে বিখ্যাত হয় এটি। পরবর্তীকালে উনিশ শতকে এই মসজিদটিকে হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক চরিত্র রামের জন্মস্থান বলে দাবী করতে শুরু করে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। তাদের দাবি ছিল প্রাচীনকালে এই রামকোট হিল‌ই ছিল ভগবান রামের জন্মভূমি। ওই স্থানে পরবর্তীকালে একটা রাম মন্দির গড়ে তোলা হয়েছিল, সেই মন্দিরটি ভেঙেই নাকি  মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট বাবর।

images 6 8
Kafila.online

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি তখন থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিল যে বাবরি মসজিদের জায়গা তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে, তারা সেখানে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। অন্যদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই দাবি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। তাদের দাবি বাবরি মসজিদের জায়গায় পূর্বে কোনো মন্দির ছিল না। মসজিদকে হস্তান্তর করা হবে না বলে জানিয়ে দেয় তারা। এই দাবিকে কেন্দ্র করে ইংরেজ শাসনে বেশ কয়েকবার হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে যায় অযোধ্যায়। অনেক সময় সেই অশান্তির আঁচ তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তো। যদিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সেই সময় ঘটতে দেখা যায়নি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে উভয় সম্প্রদায়ের দাবি পাল্টা দাবির মধ্যে গোটা ঘটনায় নতুন মোড় আসে। একদিন হঠাৎ রাতের অন্ধকারে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কয়েকজন কর্মী তাদের আরাধ্য দেবতা শ্রী রামচন্দ্রের একটি মূর্তি বাবরি মসজিদের ভেতরে রেখে দিয়ে আসে। পরের দিন সকালে গোটা ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসলে ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা। তারা এই ঘটনাকে ইসলাম ধর্মের অবমাননা বলে দাবি করে। অন্যদিকে এই ঘটনার পরেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সহ অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি দাবি জানাতে শুরু করে তারা মসজিদে ঢুকে রামের পুজো করবে।

images 7 8
Swarajya Image

প্রশাসন বুঝতে পারে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা প্রায় অবশ্যম্ভাবী। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শে রাজ্য প্রশাসন বাবরি মসজিদ এবং তৎসংলগ্ন চত্বর সিল করে দেয়। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেয় হিন্দু এবং মুসলিম কোনো সম্প্রদায়ের মানুষই ওই চত্বরে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না বিতর্কের মীমাংসা হবে। এরপর বাবরি বিতর্কে নানা ঘাত-প্রতিঘাত দেখা যায়। কখনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো কিছু দাবি জানিয়েছে আবার তার পাল্টা হিসাবে ইসলামিক সংগঠনগুলি নতুন কোনো সত্যকে সামনে এনে খাড়া করেছে।

কিন্তু ১৯৮৬ সালে স্থানীয় আদালতের রায়ের পর হিন্দু ভোটের হাওয়া নিজের দিকে টানতে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেন রাজীব গান্ধী, এরকমই অভিযোগ ভারতের একাধিক রাজনৈতিক দলের। এর কয়েক বছর পর ১৯৮৯ সালে বাবরি মসজিদে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির পূজার অনুমতি বজায় রাখার অনুমতি দেয় আদালত। এরপরই রাজীব গান্ধী প্রশাসন বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে রাম মন্দির শিলান্যাসের অনুমতি প্রদান করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ঘটনা ঘটে দেশের নানা প্রান্তে। এরপরই প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাবরি মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

বাবরি মসজিদ চত্বর তালা বন্ধ থাকলেও মন্দির-মসজিদ এই দুই দাবিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনীতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। রাম মন্দির স্থাপন করতে হবে ওই বিতর্কিত জমিতে, এই দাবিকে সামনে রেখে একে একে জোট বাঁধতে শুরু করে দেশের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এবং একাধিক রাজনৈতিক দল। বিজেপির তৎকালীন সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানি অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির তৈরি দাবি নিয়ে রথ যাত্রায় বের হন। তার সেই রথযাত্রাকে ঘিরে একাধিক রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব আদবানির রথ আটকে তাকে গ্রেফতার করেন।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যার বিতর্কিত জমির কাছে রাম মন্দির স্থাপনের দাবি জানিয়ে কর সেবার ডাক দেয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দল। ওইদিনই অযোধ্যায় উপস্থিত লাক্ষাধিক জনগণ বাবরি মসজিদকে ভেঙে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। সেই দিন ওই স্থানে উপস্থিত হয়ে লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর যোশী সহ একাধিক বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতারা উত্তেজক বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে মসজিদ ভাঙায় ইন্ধন জুগিয়ে ছিলেন বলে পরবর্তীকালে অভিযোগ ওঠে। দীর্ঘদিন আদালতে মামলা চলার পর ২০১৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ওই বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির নির্মাণ করার রায় দেয়! সেইসঙ্গে সরকারকে নির্দেশ দেয় অযোধ্যার মধ্যেই সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ একর জমি দিতে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে কেন্দ্র করে যথেষ্ট বিতর্ক ছড়িয়েছে ভারতীয় রাজনীতিতে।

images 8 10
New Humanist

বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং পরবর্তীকালে বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত যে চূড়ান্ত রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে তার একাধিক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ভারতীয় জনজীবনে সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। আমরা সেই প্রভাবের দিকগুলি আলোচনা করে দেখি-

১) চিরস্থায়ী সাম্প্রদায়িক বিভাজন

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে এদেশের হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিভাজন খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সেই বিভাজন এই দেশে চিরস্থায়ী রূপ পেয়ে গিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ শিবির যতই চেষ্টা করুক হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে চলা সাম্প্রদায়িক বিভাজন কমিয়ে আনার, তা আজ আর সফল হওয়ার নয়। কারণ দুপক্ষই পরস্পরকে আজ আর বিশ্বাস করে না।

images 9 9
India Today

২) বিচার ব্যবস্থার প্রতি সংশয়

বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় জড়িত থাকা প্রত্যেককে বিশেষ আদালতের নির্দেশে নিরাপরাধ ঘোষণা করা, এই দুই রায়কে কেন্দ্র করে এই দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর দেশবাসীর একাংশের ভরসা চলে গিয়েছে। যার ফলস্বরূপ ভারতীয় বিচারব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে।

৩) মৌলবাদী শক্তির ক্রমবর্ধমান উত্থান

বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণকে যেমন হিন্দু মৌলবাদী শক্তি তাদের জয়লাভ বলে মনে করছে, তেমনি মুসলিম মৌলবাদীরা এ ঘটনায় তাদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে বলে মনে করছে। যার ফলস্বরুপ ভারতীয় রাজনীতির পরিসরে ক্রমান্বয়ে হিন্দু এবং মুসলিম মৌলবাদী শক্তিগুলি ক্রমশ নিজেদের শক্তি বাড়াতে সফল হচ্ছে। যে প্রবণতা দেখে বলাই যায় আগামী দিনে ভারতীয় রাজনীতি কোনো মধ্যপন্থি দলের দ্বারা নয়, মৌলবাদী শক্তিদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত হবে।

বাবরি,
News 18 Bangla

৪) যুক্তির থেকে বিশ্বাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ

বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত যাবতীয় ঘটনা এবং প্রতিক্রিয়া খুব সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ভারতবাসীদের একটা বড় অংশ স্রোতের বিপরীতে হেঁটে যুক্তিকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এরা কিন্তু আধ্যাত্মিকতাবাদ বা সমর্পণের নীতিতে বিশ্বাসী নন। ধর্ম নির্বিশেষে এই শ্রেণীর মানুষরা কিছু সংখ্যক গোঁড়া ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাৎক্ষণিক মনে হওয়াকেই সত্যি বলে ধরে নিচ্ছেন। যার ফলে সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদীতার জায়গা ক্রমশ পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে।

৫) ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার মুখে

সংবিধান অনুযায়ী ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তাছাড়া স্বাধীনতার সময় থেকেই এই দেশকে খুব সচেতনভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কারণ অসংখ্য ধর্মের মানুষ সুদূর অতীতকাল থেকেই এই দেশে বসবাস করতেন। তাদের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলতে গেলে কোনো একটি ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়ার জায়গা ছিল না। তাই রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবেনা, এটাই ছিল তৎকালীন দেশ নেতাদের মনোভাব। কিন্তু বাবরি মসজিদ পরবর্তী পর্যায়ে নানা ঘটনাক্রম থেকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে দেশের সেই চরিত্রে বদল ঘটেছে।সাংবিধানিকভাবে এখনো পর্যন্ত এটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও তার অন্তরাত্মায় ইতিমধ্যেই যে বদল ঘটে গিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতিতে বাবরি মসজিদ পরবর্তী পর্যায়ে যে প্রভাব পড়েছে তা হয়তো বিশেষ বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থের সহায়ক হতে পারে, কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে এবং প্রগতিশীলতার দিক থেকে দেখতে গেলে খুবই পরিষ্কার বোঝা যায় এই বদলের ফলে সুমহান ঐতিহ্যের ভারত আজ সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছনের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে !