ভারতের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের প্রধান হলেন গৌতম আদানি। তার এই উত্থান খুব একটা সহজ ছিল না। ভারতের এই প্রথম সারির শিল্পপতি স্কুল ড্রপ আউট। গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হলেও তিনি পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেননি, তার আগেই কর্মজীবন শুরু করে দেন। প্রথমে তার বড় দাদা মন্সুখভাই আদানির প্লাস্টিক ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব পেলেও পরবর্তীকালে সেই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে পলিভিনাইল বা পিভিসি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। এটা ১৯৮৫ সালের গোড়ার দিকের কথা।
পলিমারের রপ্তানি ব্যবসায় সাফল্য লাভের পর ১৯৮৮ সালে তিনি “আদানি এক্সপোর্ট লিমিটেড” নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন। সেই পথ চলা শুরু আদানি গ্রুপের। এরপর গৌতম আদানি নেতৃত্বাধীন এই কোম্পানিটি ধীরে ধীরে একটি বহুজাতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। গৌতম আদানি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, বন্দর ব্যবস্থাপনা, বিমানবন্দর পরিচালনা, স্পেশাল ইকোনমিক জোন পরিচালনা, খনি, ভোগ্যপণ্য, কৃষিপণ্য সহ একাধিক ক্ষেত্রে তার কোম্পানির বিস্তার ঘটান। এমনকি আদানি গ্রুপ বর্তমানে এরোস্পেস এবং ডেটা ম্যানেজমেন্টের ব্যবসাতেও পা রেখেছে।
ভারতের গন্ডী ছাড়িয়ে বিশ্বের একাধিক দেশে গৌতম আদানি নেতৃত্বাধীন আদানি গ্রুপের বিস্তার ঘটেছে। এই মুহূর্তে রিলায়েন্স এবং টাটা গোষ্ঠীর পর আদানি গোষ্ঠীকেই ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম বহুজাতিক গ্রুপ অফ কোম্পানিজ বলে মনে করা হয়। আদানি পাওয়ার হলো ভারতের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী এবং সংবহনকারী সংস্থা। সেইসঙ্গে তারা ভারতের সর্ববৃহৎ এয়ারপোর্ট এবং পোর্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা হিসাবেও স্বীকৃত। এফএমসিজি ক্ষেত্রে আদানিদের বৃদ্ধির হার দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বলে জানা গিয়েছে।
ভারতের বাইরে অসংখ্য দেশে আদানিদের ফরচুন ব্র্যান্ডের ভোজ্য তেল, মুদিখানা দ্রব্য, মসলাপাতির বাজার আছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, বাংলাদেশ এবং আফ্রিকার একাধিক দেশে হু হু করে তাদের এই সমস্ত খাদ্যপণ্যের বাজার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসঙ্গে কসোভো, নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সংবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আদানি পাওয়ার। কসোভোর প্রধান বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাটির সম্পূর্ণ মালিকানা বর্তমানে আদানিদের হস্তগত। এছাড়াও একাধিক দেশের বন্দর ব্যবস্থা ম্যানেজমেন্ট করার ব্যবসাতেও তারা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।
দেশের মধ্যে কয়লা উত্তোলন ব্যবসায় দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে আদানি গোষ্ঠী। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই উন্নত মানের বিটুমিন কয়লা পাওয়ার আশায় তারা নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের কারমাইকেল কয়লা খনির খননকার্যের স্বত্ত লাভ করে। সেইসঙ্গে তারা ঠিক করে উত্তোলন করা কয়লা রপ্তানি ব্যবস্থা সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য ওই অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণ করবে।
• কারমাইকেল কয়লা খনি বিতর্ক :
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের কয়লা উত্তোলন এবং রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। এই বিতর্ক দ্রুত বড় আকার ধারণ করে একটি আন্তর্জাতিক ব্যাবসায়িক ইস্যুতে পরিণত হয়। কারমাইকেল কয়লা প্রকল্পের বিরোধিতায় সরব হয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়ার মানুষজন এবং পরিবেশ কর্মীরা। তাদের দাবি এই কয়লা উত্তোলন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ব্যাপক পরিমাণে পরিবেশ দূষণ ঘটবে, স্থানীয় অঞ্চলের জীব বৈচিত্র সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বৃহৎ কয়লা প্রকল্পের আশেপাশে বসবাসকারী মানুষরা বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত পরিবেশ সংগঠন অস্ট্রেলিয়ান কনসারভেশন ফাউন্ডেশন এই প্রকল্পটির ক্ষতিকারক দিকটি তুলে ধরে সেই দেশের পরিবেশ আদালতে মামলা করে। তার ফলে দীর্ঘদিন প্রকল্পটির কাজ থমকে আছে।
এই প্রকল্পের বিরোধিতা এই বছর সরব হন আন্তর্জাতিক পরিবেশ কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী পরিবেশ কর্মীরাও এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের দাবি কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের তীরবর্তী সমুদ্রের দুটি বন্দর হে পয়েন্ট এবং অ্যাবট পয়েন্টের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করার জন্য যে নির্মাণ কাজের কথা বলা হয়েছে তার ক্ষতিকারক প্রভাবে গ্রেট ব্যরিয়ার রিফের প্রবাল প্রাচীর সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ প্রবাল প্রাচীর একটি সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চল। এমনিতেই বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষতিকারক প্রভাবে এই প্রবাল প্রাচীর অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এরপর তার কাছ দিয়ে নির্মাণকার্য চালানো হলে তার আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না বলেই মনে করছেন পরিবেশবিদরা। সেইসঙ্গে তারা দাবি করেন কারমাইকেল কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ফুটপৃন্ট উৎপন্ন হবে যা পৃথিবীর পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়ার আদালতে মামলা চলার পর সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়া আদালত আদানি গোষ্ঠীকে খননকার্য শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। যদিও এই প্রকল্পের মূল্যমানকে কেন্দ্র করে এরপর আবার বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অভিযোগ ওঠে ওই প্রকল্পের আর্থিক লাভ যতটা হবে তার থেকেও বেশি দেখানো হয়েছে অতিরিক্ত লোন পাবার আশায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশ এবং বিদেশের আর্থিক সংস্থাগুলির কাছে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়ে যায় এই ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী।
কারমাইকেল কয়লা খনির জন্য স্টেট ব্যাংকের বিদেশি শাখা লোন দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা তারা পুনর্বিবেচনা করবে বলে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। এই প্রকল্পের বিষয়ে গৌতম আদানি একসময় দাবি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল খনির উন্নত মানের কয়লা তিনি দেশেতে এনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করবেন। যার ফলে এই দেশের বিদ্যুৎ শিল্পের প্রভূত উপকার হবে। যদিও বর্তমানে জানা যাচ্ছে আদানি গোষ্ঠীর দাবিমতো কারমাইকেল কয়লাখনির কয়লার গুণমান ততটাও উন্নত মানের নয়। ভারতে প্রাপ্য কয়লার থেকে গুণমানে মানে তা খুবই সামান্য এগিয়ে আছে। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আদানি গোষ্ঠীর বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে।
যদিও কারমাইকেল কয়লা খনি বিতর্কই একমাত্র নয়, এই দেশেতে এর আগে ও পরে একাধিকবার নানান বিতর্কে জড়িয়েছেন গৌতম আদানি ও তার পরিচালিত শিল্পগোষ্ঠী। তাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়। বিজেপি ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে আদানিরা দ্রুতগতিতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছেন, এই অভিযোগ ভারতের ব্যবসায়ীক দুনিয়ায় একটি প্রচলিত ব্যাপার। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বারবার দাবি করেছে আদানি গোষ্ঠীর সুবিধা করে দেওয়ার জন্য দেশের একের পর এক বিমানবন্দর তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নামমাত্র মূল্যে।
কৃষি আইন বিরোধী মে বিক্ষোভে এই মুহূর্তে দেশ উত্তাল তাতেও বারবার সামনে এসেছে আদানি গোষ্ঠীর নাম। আন্দোলনরত কৃষকদের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়েছে আদানি রিলায়েন্সের মতো খাদ্যপণ্যের ব্যবসা করা বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে মুনাফার পথ করে দেওয়ার জন্যই কেন্দ্রীয় সরকার এই নতুন তিনটি কৃষি আইন বলবৎ করেছে।
গৌতম আদানির সংস্থার বিরুদ্ধে বারে বারে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রীয় অর্থ দপ্তরের অধীনস্থ তদন্তকারীরা একাধিকবার অভিযোগ করেছেন বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সংবহনের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে কম দামে কেনার পর তার দাম বেশি করে দেখায় এই শিল্পগোষ্ঠী। তার ফলে খরচ বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয় আদানিরা। এর ফলে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে তারা। সেইসঙ্গে গোষ্ঠীর অন্তর্গত বিভিন্ন সংস্থা পরস্পরকে ধার দেওয়ার মাধ্যমে মুনাফার পরিমাণ ইচ্ছে করে কম দেখানোর অভিযোগ উঠেছে এই বহুজাতিক সংস্থার বিরুদ্ধে।
গৌতম আদানি ও তার পরিচালিত আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বারেবারে অভিযোগ উঠেছে তারা বেআইনি পথে অর্জন করা মুনাফার একটা বড় অংশ কর ফাঁকির সাম্রাজ্য মরিসাসে তার দাদা বিনোদ আদানির ট্রাস্টে পাচার করে। প্রসঙ্গত ফাঁস হয়ে যাওয়া পানামা পেপারের তালিকায় গৌতম আদানি ও তার এই ট্রাস্টের নাম ছিল।
মাত্র ৩২ বছরের শিল্পগোষ্ঠী হলেও ইতিমধ্যেই সাফল্যের একাধিক শিখর আদানি গ্রপ স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে তাদের এই চলার পথ প্রতিমুহূর্তেই বিতর্কে বিদ্ধ হয়ে এগিয়ে গিয়েছে। অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞই মনে করেন মুনাফা অর্জনের জন্য আদানি গোষ্ঠী নৈতিক পর থেকে যেকোনো মুহূর্তে সরে আসতে রাজি আছে!