এই বছর ভারতে অন্যান্য বছরের মতোই অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা এমন আছে যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ২০০১ এর নতুন বছর শুরু হওয়ার ঠিক আগের দিন আমরা ফিরে দেখব এবং জেনে নেব ভারতীয় রাজনীতিতে ২০০০ সালে কি কি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।

এই ঘটনাগুলিকে নিয়ে সীমিত পরিসরে বিশ্লেষণ যেমন আমরা করব তেমনি জনগনের কাছে এই ঘটনাগুলি কি বার্তা বা তাৎপর্য বহন করে নিয়ে গেল তাও খুঁজে দেখব। এক্ষেত্রে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মৃত্যু বা অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের মৃত্যুর মতো রাজনীতির মহীরুহদের চলে যাওয়ার ঘটনা আলাদা করে আলোচনা করব না। আমরা বরং এবার মূল তালিকাতে চোখ রাখি।

20201231 144905
মধ্যপ্রদেশের ‘কিংমেকার’ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া

১) বিজেপির মধ্যপ্রদেশ দখল

শিবরাজ সিং চৌহান দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে মধ্যপ্রদেশে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৮ সালে এই রাজ্যের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের কাছে পরাজিত হয় বিজেপি। বর্ষিয়ান কংগ্রেস নেতা কমল নাথের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে কংগ্রেস। যদিও মুখ্যমন্ত্রী পদের অন্যতম দাবিদার ছিলেন তরুণ নেতা এবং গ্বালিয়রের মহারাজ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। যদিও কংগ্রেস অভিজ্ঞ কমল নাথের ওপর ভরসা রাখে।

মুখ্যমন্ত্রী পদে বসার বাসনা পেয়ে বসেছিল মাধবরাও সিন্ধিয়া পুত্রকে, এর ফলে জ্যোতিরাদিত্যের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের। এই বছরের মার্চ মাসে ২৫ জন অনুগত বিধায়ক নিয়ে দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগদেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। এর ফলে ২৩০ আসনের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন কমল নাথ। কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটে এবং শিবরাজ সিং চৌহানের নেতৃত্বে মধ্যপ্রদেশের ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে আসে বিজেপি।

দেশের জনসাধারণ এবং রাজনৈতিক মহল বারবার দাবি করেছে টাকা এবং ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে কংগ্রেসের বিধায়কদের ভাঙিয়ে নিয়ে এসে সরকার গঠন করেছে বিজেপি। বিজেপি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম কালো অধ্যায় রচনা করে বলে দাবি করা হয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। অনেকে বলেন শিবরাজ সিং চৌহান পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতির পিছনের দরজা বেছে নিয়েছিলেন।

20201231 145218
যুযুধান দুই পক্ষ: অশোক গেহলট এবং শচীন পাইলট

২) ‘সিন্ধিয়া’ হতে গিয়েও হলেন না শচীন পাইলট

মধ্যপ্রদেশের এই ঘটনার পর দেশে লকডাউন চলার সময়েই রাজস্থানের কংগ্রেস সরকার পতনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। একসময় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল মধ্যপ্রদেশের মতোই রাজস্থান তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবে বিজেপি। ঘটনার সূত্রপাত সেই রাজ্যের তরুণ তুর্কি নেতা শচীন পাইলটের বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে।

২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশের পাশাপাশি রাজস্থানের ক্ষমতা দখল করে নেয় কংগ্রেস। ২০০ আসনের রাজস্থান বিধানসভায় কংগ্রেসের জয়ী হওয়ার পিছনে মূল অবদান তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শচীন পাইলটের ছিল বলে মনে করা হয়। নির্বাচনের পর সরকার গঠনের সময় তিনি দলের কাছে মুখ্যমন্ত্রী পদ চেয়ে বসেন। যদিও তাকে উপমুখ্যমন্ত্রী পদ দিয়ে এবং একই সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদে রেখে দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়।

রাজস্থানের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের সঙ্গে শচীন পাইলটের মতবিরোধ সরকার গঠনের প্রথম থেকেই দেখা দিতে শুরু করে। সেই বিরোধ অতিরিক্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে বিদ্রোহ করেন শচীন পাইলট। তিনি তার অনুগত বিধায়কদের নিয়ে হরিয়ানার একটি রিসর্টে ওঠেন। শোনা যাচ্ছিল জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতোই দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেবেন তিনি। যদিও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সহ একাধিক শীর্ষ স্থানীয় কংগ্রেস নেতার পরামর্শে শেষ পর্যন্ত দলত্যাগ করেননি শচীন। তার ফলে রাজস্থানের কংগ্রেস সরকার আপাতত টিকে গিয়েছে।

৩) বিহারে বিজেপির ছোট শরিকে পরিণত হল নিতীশ

নভেম্বর মাসে বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় সেই রাজ্যে এতদিনের ধারা বদলে এনডিএর প্রধান শরিক বিজেপির উত্থান ঘটেছে। তাদের অপর শরিক নিতীশ কুমারের জেডি(ইউ) সেই রাজ্যে তৃতীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভোট পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিতীশ কুমারকে বিহারের এনডিএ জোটের মুখ্যমন্ত্রী করা হলেও সংখ্যাধিক্যের জেরে প্রতি মুহূর্তে তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো শক্তি হারিয়ে বিজেপির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন সমাজবাদী শিবিরের এই দাপুটে নেতা। এরইমধ্যে কয়েকদিন আগে অরুণাচল প্রদেশের জেডি(ইউ) বিধায়ক দলের মধ্যে ভাঙ্গন ধরায় বিজেপি। নিতীশের দলের ৭ বিধায়কের মধ্যে ৬ জন‌ই বিজেপিতে যোগ দেয়। এর ফলে বিরোধী দলের স্বীকৃতি হারিয়ে মাত্র একজন বিধায়কের এসে ঠেকেছে জেডি(ইউ)। বিজেপির এই আচরণে নিতীশ প্রবল ক্ষুব্ধ। আদৌ নিতীশ তার দল টিকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা তা নিয়েই যথেষ্ট সংশয় আছে।

ভারত,

৪) কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীরের প্রথম নির্বাচন

২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য থেকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা হারায় জম্বু কাশ্মীর। একই সময়ে জম্মু-কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে তাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। লাদাখ অঞ্চলটিকে আলাদা করে নতুন একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে।জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকা নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।

এই সিদ্ধান্তের পর দীর্ঘদিন সেই রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করে রেখেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এই পরিস্থিতিতে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস মিলিয়ে মোট ৮ দফায় ভোট হয়। জম্মু-কাশ্মীরের ডিস্ট্রিক্ট ডেভলপমেন্ট কাউন্সিলের এই ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর পর দেখা যায় ওখানকার স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর গুপকার অ্যালায়েন্স সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও বিজেপির সাফল্য একেবারে ফেলে দেওয়ার মতন নয়। বিশেষত হিন্দুপ্রধান জম্মু উপত্যকায় বেশিরভাগ আসনেই জয়লাভ করেছে বিজেপি।

এই পরিস্থিতিতে বিজেপির পক্ষ থেকে যেমন বলা হচ্ছে তারা জম্মু-কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সেখানকার মানুষ স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলিকে আর বিশেষ পছন্দ করছে না বলেও দাবি করে তারা।

অন্যদিকে ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির মতো জম্মু-কাশ্মীরের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির জোট এই ফলাফলকে হাতিয়ার করে দাবি করে সেখানকার মানুষ ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত মানুষের এই জনমতকে সম্মান দিয়ে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া।

৫) হায়দ্রাবাদ পৌর নির্বাচন

হায়দ্রাবাদ পৌরসভার নির্বাচনে সেখানকার শাসকদল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতিকে ব্যাপক বেগ দিয়েছে বিজেপি। ১৫০ আসনের হায়দ্রাবাদ পৌরনিগমে তারা গতবারের ৪টি আসন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এবারে ৪৮ টি আসনে জয়লাভ করেছে। ঘটনা হল ২০২০ সালের আগে তেলেঙ্গানা রাজ্যে বিজেপির তেমন কোনো প্রভাব ছিল না। এই বছরেই বিধানসভা উপনির্বাচনে সেখানকার একটি বিধানসভা কেন্দ্র তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় বিজেপি।

তেলেঙ্গানায় তাদের এই অবাক করে দেওয়ার রাজনৈতিক সাফল্য বিজেপিকে ওই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। সে ক্ষেত্রে কর্নাটকের পর তারা আবার দক্ষিণের একটি রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

কেবলমাত্র এই পাঁচটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এরকম অজস্র গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা এই বছর ভারতে ঘটে থাকলেও আমাদের মনে হয়েছে এই পাঁচটি ঘটনা আগামী দিনে ভারতীয় রাজনীতির গতিপথ বদলে দিতে পারে। তাই আমরা এগুলির উপর এতটা জোর দিলাম। এই প্রসঙ্গে বলার কৃষক আন্দোলনের পরিণতি যেহেতু এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি তাই সে বিষয়টি আলোচনায় আনলাম না। ঘটনা হল ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ২০২০ এর কৃষক আন্দোলন সম্ভবত আগামী দিনে মাইলফলক তৈরি করবে।