কিন্নর হল তারা যারা না পুরুষ না নারী যাদের লিঙ্গের সুপষ্ট কোন আঁকার নেই। পাতি কথায় আমরা যাকে বলি হিজড়া। এরা আমাদের  সমাজে আজও ব্রাত্য। সুপ্রিমকোর্টে এরা  সমাজের একজন হিসেবে স্বিকৃতী পেলেও আমাদের সমাজের  একজন বলে এরা  নিজের অস্তিত্বের সিলমোহোর গাঁথতে পারে নি।

কিন্নর
টেকটিউনস

তো এই যে কিন্নর বা চলতি কথায় হিজড়া এরা কি সত্যি জেনেটিক ডিসর্ডারের কারন  মাত্র , এদের জন্ম কি হালেই হয়েছে? না সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকেই তাঁদের অস্তিত্ব বর্তমান যখন থেকে নর-নারীর  জন্মলগ্ন।  সাধারণ মানুষের ন্যায় এরাও বহু নামের অধিকারী।    হিজড়া ব্যতীত অন্যান্য নাম  খোউজা সিরা , নপুংসকা , থিরুনাঙ্গাই ,আরাভানি, বৃহ্নন্নলা, প্রভৃতি।  বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ,বিভিন্ন ভাষায় এদের নামের তারতম্য। বর্তমানে চির অবহেলিত সমাজের এই তৃতীয় সত্তার গড়ে উঠেছে নিজস্ব অস্তিত্ব , নিজস্ব সংস্কৃতি  রয়েছে তাদের নিজস্ব গোপন ভাষা – হিজড়া ফার্সি বা ‘কোটি’।

কিন্নর

আজ থেকে নয় হাজার হাজার বছর ধরে লোকগাথায়, পুরানের পাতায় নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করেছে ও জাহিরের ইতিহাস  আজও বর্তমান। ইতিহাসের পাতা উল্টালে পুরনো  হলুদ কাগজের মোড়কে গাঁথা একের পড় এক কাহিনী ভেসে উঠবে।

পৌরানির তত্ববাদ

কিন্নররা না ছিল মানুষ , না ছিল দেবতা।  গ্রীস দেশের সেন্টারদের সাথে তাদের মিল পাওয়া যায়, অর্ধেক ঘোড়া অর্ধেক মানব। কোথাও বলা হয় তাদের মাথা ছিলো ঘোড়ার, কোথাও বলা হয় তাদের দেহের নিম্নাংশ ছিলো ঘোড়ার মতোন।

9k=
Wikipedia

প্রাচীন ভারতের পুরাণ অনুসারে ধীমান পুলস্ত্য’র সন্তান কিন্নররা হিমালয়ের গভীর কোন এক অঞ্চলে, দেবতা, অসুর, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্বদের সাথে বাস করত।  চন্দ্রবংশের প্রতিষ্ঠাতা  দেবতা ইলের সেনা ছিলেন এইসকল  কিন্নরগন ।  ইল  পার্বতীর নিষিদ্ধ কুঞ্জবনে ঢুকে পরলে পার্বতী দ্বারা অভিশাপপ্রাপ্ত হয় এর সেই  অভিশাপে তার লিঙ্গান্তর ঘটে।  দেবতা ইল থেকে  পরিনত হয় ইলাদেবীতে। এরপর দেবতা বুধ’র সাথে ইলাদেবী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে বুধ কিন্নরদের সেনাকুঞ্জ থেকে মুক্তি দিয়ে গায়কে রূপান্তর করেন।  পুরাণমতে এরা দেবলোকের দেব দেবীদের সুকন্ঠী গায়কজতি বিশেষ। অসাধারণ কন্ঠে মোহভুত করার ক্ষমতা ছিল তাঁদের।  তাই বর্তমানে কিন্নর-কিন্নরীদের কৃতকর্ম অনুসারে কারো কণ্ঠ ভালো হলে তাকে বলা হয় কিন্নরকণ্ঠ।

Budhadeva
Wikipedia। ইলাদেবী ও বধুর বিবাহের মুর্তি

শুধু হিন্দু ধর্মীয় পুরাণেই নয়  কিন্নর-কিন্নরীদের  অস্তিত্বের সন্ধান মেলে বৌদ্ধধর্মীয় পুরাণেও। কিন্নরদের কথা পাওয়া যায় মহাযান পদ্ম সূত্রে। বার্মিজ পৌরাণিক উপকথা অনুসারে মহামতি বুদ্ধ পূর্বজন্মে যে ১৩৬টি প্রাণির বেশে ছিলেন, তার মধ্যে চারটি রূপ ছিলো কিন্নর। আর বুদ্ধের পায়ের ছাপে যে ১০৮টি প্রাণির চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে একটি হলো কিন্নরী। এছাড়া কোন কোন পুরাণে তাদের গন্ধর্বদের উপজাত বলা হয়েছে।

fLzwrtzLx rIVg tAfXd1FkDlUEERHIlvDoEikEQDwAeuv3rSlWMTwn 2x chxOxwmAyWCJL040A0cEF5yHf35sDyOZlV0bovOaW64RehntJZU1BxuPdikrAmonlA841zFMG6FtZ 4EvR2EnBFtT34eFP K5nGd0LN9SJY 0
Future Point – blogger

ভিন্ন দেশের ভিন্ন পুরানগ্রন্থে অর্থাৎ বার্মিজ, থাই, কম্বোডিয়ান, শ্রীলঙ্কান সহ দক্ষিন-পূর্ব ভারতের পুরাণেও কিন্নর – কিন্নরীদের কথা স্বর্নাক্ষরে খোদিত রয়েছে। শুধু কি তাই!! কিন্নরদের  স্ত্রী-লিঙ্গের অস্তিত্বের সন্ধান মেলে দক্ষিন-পূর্ব ভারতের পুরাণসমূহে। এই স্ত্রী লিঙ্গ জাতীয় কিন্নরদের বলা হত কিন্নরী যাদের  শরীরের ঊর্ধাংশ ছিলো মানবাকৃতির, নিম্নাংশ হাঁস আকৃতির।

tumblr oot8b1AiQ81vw5i2lo1 400
কাল্পনিক কিন্নরীর ছবি Tumblr থেকে


ধর্মগ্রন্থে তাঁদের অস্তিত্ব

মহান কাব্যগ্রন্থসমূহে এদের নানাবিধ পর্যালচনা রয়েছে।

“আমরা জন্ম-জন্মান্তরে মানবের ভালোবাসা পেয়ে যাবো, ভালোবেসে যাবো… আমরাই নর, আমরাই নারী, তবে কখনো কারো পিতা অথবা মাতা হতে পারবো না… আমাদের জীবন অনন্ত সুখের জীবন।”

মহাভারতের আদি পর্বে এভাবেই নিজেদের পরিচয় দিয়েছে কিন্নরগন। মহাভারতে কিন্নরদের আবির্ভাব হয় শিখণ্ডীর হাত ধরে। কাহিনী পরিপেক্ষিতে তাকে কিন্নর হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যে কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে ভীষ্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়াই করে।  দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীষ্ম নারী ও ক্লীবলিঙ্গের বিপরীতে অস্ত্রধারন করবে না, সেই সুত্রকে কাজে লাগিয়ে শিখণ্ডী ভীষ্মের মৃত্যুর কারন হয়ে পূর্বজন্মের অম্বার প্রতিশোধ নেয়। শিখণ্ডী পূর্বজন্মে অম্বা হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন এবং আগের জন্মের প্রতিশোধের স্পিহায় পরজন্মে দ্রুপদ কন্যা শিখণ্ডিনী হয়ে জন্মান এবং স্থুণাকর্ণ নামে এক যক্ষের সাথে লিঙ্গ বিনিময় করে পুরুষ হন। ।কথিত আছে  -সেই পৌরাণিক চরিত্র অম্বার অভিশাপই বয়ে চলেছে তাঁর উত্তরসূরিরা অর্থাৎ আজকের হিজড়ারা ।

DmabY8zX4AIOPME
Twitter

রামায়নেও রয়েছে  কিন্নরদের গল্পগাঁথা। রামচন্দ্র যখন ১৪ বছরের বনবাস কাঁটিয়ে অয্যোধ্যায় ফিরে আসেন তিনি দেখেন নদীর ধারে বহু মানুষের বাস, দুঃখ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছে, তাঁদের প্রশ্ন করলে তারা বলেন প্রভু আপনি বনবাস যাওয়ার আগে আদেশ দিয়েছিলে নর নারী গৃহে ফিরে যাও কিন্তু আমরা না নর না নারী, তাই আপনার আদেশ রক্ষা করে আমরা ১৪ বৎসর এই নদীর ধারে আপনার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছি, আপনার আদেশ অবজ্জা করার সাহস আমাদের জন্মায় নি। সেই শুনে রামের দু চোখ দিয়ে অশ্রু গঙ্গা বইতে থাকে। আর তারা হয়ে ওঠে রামের প্রিয়।

image
Anandabazar

ধর্ম

কিন্নরদের আরাধ্য ভগবানের তথ্য উঠে এসে ইতিহাসের পান্না থেকে। উল্লেখ্য আছে বাহুছাড়ামাতার কাহিনী। কিন্নর সমাজের পুজ্জিত দেবী ইনি।

79240482 2549466805312134 3351950485350252544 n
Mayiliragu

 এছাড়া রয়েছেন অর্ধনারীস্বর। শিব-পার্বতী বা শক্তির ‘অর্ধনারীশ্বর’ রূপ যা কিনা নারী ও পুরুষের পরিপূরকতা ও যুগ্ম অস্তিত্বের প্রতীক।

gDxLv DBdNoQ0Fkg1WNPECr6vSbT ALI8lVEA4JgjqEfRSm R7fKC2
HomeRoam

বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ

পুরান ও ধর্মের দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে বিজ্ঞানের পর্যালচনায় ঢোকা যাক।

বৈজ্ঞানিক মতানুসারে হিজড়ার প্রকারভেদ কত ??

প্রকারভেদ তিনঃ  প্রকৃতহিজড়ে(True Hermaphrodite), অপ্রকৃত পুরুষ হিজড়ে (Male Pseudo Hermaphrodite), এবং অপ্রকৃত নারী হিজড়ে (Female Pseudo Hermaphrodite)।

হিজড়া জন্মের মূল কারন হিসেবে মানব শরীরের ক্রোমোজোমের ভূমিকাকে কাঠগোড়ায় তোলা হয়। মানব শরীরের স্বাভাবিক ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম অর্থাৎ ৪৬ টি ক্রোমোজোমের সংখ্যাগত ত্রুটি থাকলে এরকম ঘটনা ঘটে । এমনকি ক্রোমোজোম সংখ্যা স্বাভাবিক থাকলেও গোনাডের ত্রুটিতেও যৌন বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে সমাজ তাঁদের মানতে নারাজ তাই ক্রোমোজোমকে দায়ী করাই স্বাভাবিক তাছাড়া উপায় কি, তারা তো দোষ চাপিয়ে দিতে পারলেই দায়মুক্ত।

gender logo 041 hizra
etcnewsbd – WordPress.com

তাই বর্তমান সমাজ যতই বাহ্যিকভাবে নিজেদের শিক্ষা জাহির করলেও আভ্যন্তরীন দৃষ্টিভঙ্গিতে তা নয়। তাঁদের সম্মুখে লক্ষ লক্ষ প্রমানসাপেক্ষ নথি আনলেও হিজড়াদের  অস্তিত্ব মানতে তারা নারাজ। আজও সমাজ মানে না হিজড়ারা আমাদের সমাজের এক অঙ্গ, মানুষ যেমন যে কোন একটি অঙ্গব্যতীত প্রতিবন্ধী সমাজও তাই, হিজড়া নামক অঙ্গ সমাজ থেকে ছেঁটে ফেললে সমাজ প্রতিবন্ধী।

images 12
Mohini Ki Almari – WordPress.com

বইয়ের পড় বই রচনা হবে, তাঁদের জীবনবৃতান্ত ফুটে উঠছে সিনেমার পর্দায়, হাজার শিক্ষামূলক তথ্যের পাঠ পড়ানো হবে তাও কি বদলাবে সমাজ ??????  ওয়েব সিরিজের পর্দায় প্রিয় নায়ককে সেই হিজড়ার চরিত্রে অভিনয়য় করতে দেখে বুক কাপবে, ভাবনার পরিবর্তনের কড়া নাড়বে কিন্তু বদল কি আসবে?? মতামত, বাদানুবাদ,পর্যালোচনা, মতামত চলতেই থাকবে, শেষের কিনারা পাওয়া বড় দায়। তাও  অপেক্ষায় রইলাম সেই সর্বশেষ কিনারার, সমাজ বদলের , হিজাড়াদের আসল সামাজিক স্বিকৃতির মেকি নয় ।

দেহব্যবসা,  অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে লিপ্ত বেশীরভাগ হিজড়েদের জীবন। তাঁদের ও যে পেটের দায় রয়েছে। হ্যাঁ ব্যতিক্রমী রয়েছে যারা গোটা জীবন ধরে লড়াই করে সাফল্যের মুখ দেখেছেন, কিন্তু সবার ভাগ্য এক নয়, বিশেষ করে এদের সমাজে বাচঁতেও দেয়  না আবার অপবাদও দেয়। তো আপনাদের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লাম ওদের যাবার পথ কোথায় ? আপানারা বলে দিন এদের কি করনীয় ? অপরাধে লিপ্ত হওয়া নাকি সাধারণ মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচা ???

1 COMMENT