হাস্যকৌতুক রসবোধ কম বেশী সব মানুষের মধ্যেই থাকে, হাস্যরস ব্যতীত জীবন পুরোটাই বিষাদময়। হাস্যরসের ভূমিকা প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই ভীষনভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে এই হাস্যরস বস্তুটি কোথায় পাওয়া যায় কোথায় ? দোকানে ? আজ্ঞে না! এই বস্তুটির খোজ মেলে বিভিন্ন যায়গা থেকে। যেমন কোনও গল্প পরে, চুটকি পরে, মজার কোনো আড্ডায় কিংবা কোনো হাস্যরসপূর্ণ চলচ্চিত্রে র মধ্যে। এই প্রকার চলচ্চিত্র গুলির মধ্যে মূল ভূমিকাই থাকে একজন কৌতুক অভিনেতার। প্রত্যেকটি কৌতুক অভিনেতা শুধুমাত্র কয়েকটি সংলাপের সাহায্যেই নয়, হাস্যরস তারা সৃষ্টি করেন তাদের অঙ্গ ভঙ্গিমার দ্বারাও। সেরকমই 10 জন কিংবদন্তি কৌতুক অভিনেতার কথা আমরা জানবো যাদের কৌতুকাভিনয় দেখে বাঙালী আজও হাস্যরসের স্বাদে পরিতৃপ্ত হন।
হাস্যকৌতুক অভিনেতা হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে নক্ষত্রের অন্ত নেই। বহু অভিনেতারা আছেন যারা বিভিন্ন সময়ে তাদের কৌতুকাভিনয় দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছেন, সেই অভিনেতাদের তালিকা অনন্ত, কিন্তু এমন 10 কিংবদন্তি বাঙালী কৌতুক অভিনেতা আছেন যাদের চলচ্চিত্র দেখে এখনও বাঙালী হেসে কুটোপাটি হন। কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও আজও সেইসব অভিনেতাদের সিনেমা সমস্ত বয়সী দর্শকদের কাছে অতিপ্রিয়। এই অভিনেতারা প্রমাণ করেছেন যে হাসি সত্যই মানব চেতনার সর্বোত্তম এবং চিরন্তন ওষুধ। তাহলে এক গাল হাসি নিয়ে অবশ্যই পড়ে ফেলুন আজকের বিশেষ প্রতিবেদনটি।
Comedy is a serious business. A serious business with only one purpose–to make people laugh.
W. C. Fields
1. উৎপল দত্ত:
হাস্যকৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন উৎপল দত্ত। 29 শে মার্চ 1929 এ বরিশালে তার জন্ম, গ্রূপ থিয়েটার দিয়ে অভিনয় জগতে আগমন। শুধুমাত্র বাংলা সিনেমাতেই নয় সমানতালে তিনি অভিনয় করেছেন হিন্দী সিনেমাতেও। রাগী বাবা, খলনায়ক জমিদার, ভ্রমনপিপাষী মামা কিংবা বেনারসের শেঠজী সব চরিত্রেই তিনি অনবদ্য। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় তৈরী চলচ্চিত্রের মধ্যে উৎপল দত্ত অভিনিত তিনটি চরিত্র হীরক রাজ, মঘনলাল মেঘরাজ এবং মনোমোহন (আগন্তুক মামা) চরিত্র গুলি এখনও বিখ্যাত। তরুন মজুমদার পরিচালিত মেঘমুক্তি এবং ভালোবাসা ভালোবাসা ছবিতে কড়া বাবার চরিত্র উৎপল দত্তের অভিনয়, গম্ভীর হাস্যরসের একটি অসাধারন উদাহারণ। তিনি তার অভিনয়ের জন্য 1970 এ জাতীয় পুরষ্কার পান।
2. ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়:
হাস্যকৌতুক অভিনয়ের অন্যতম দিকপাল হলেন এই ভানু বন্ধ্যোপাধ্যায়। ‘মাসিমা মালপো খামু’ র মত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সংলাপ আজও বাঙালীর ঠোতস্থ। 26 শে অগষ্ট 1920 সালে মুন্সীগঞ্জে বিক্রমপুর জেলায় তিনি জন্মগ্রহন করেন। 1947 এ ‘জাগরণ’ ছবির মাধ্যমে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ। 1953 সালে উত্তম-সুচিত্রা এবং ভানু অভিনিত ‘সারে চুয়াত্তর’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিসন্টেট’,’ভানু পেল লটারী’, ‘৮০তে আসিও না’ র বিখ্যাত হাস্যরস পরিপূর্ণ ছবি গুলি আজও দর্শকের মন জয় করে। তার সহজ সরল মুখটি বাঙালীদের কাছে চিরস্মরনীয়।
3. নবদ্বীপ হালদার:
হাস্যকৌতুক অভিনেতা হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিরিশ দশকের বিখ্যাত অভিনেতা ছিলেন নবদ্বীপ হালদার। 1911 সালে বর্ধমান জেলার সোনাপলাশটা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছায়াছবি ছারাও বিভিন্ন শ্রুতি নাটকেও কন্ঠদান করেছেন তিনি, তার ভাঙ্গা গলার স্বরই একক ভাবে হাস্যরসের সৃষ্টি করত। ‘সারে চুয়াত্তর’ ছবিটির তার অভিনিত মদন চরিত্র টি আজও বিখ্যাত। এছারা ‘যুদ্ধ বিভ্রাট’, ‘হুলো বেড়াল’, ‘লুচি বিভ্রাট’ ইত্যাদি শ্রুতি নাটক গুলিতে দেওয়া তার কন্ঠস্বর এখনও তাকে জীবিত রেখেছে কিছু বাঙালীদের মনে।
4. জহর রায়:
হাস্যকৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে জহর রায় হলেন ভানু বন্ধ্যোপাধ্যায়ের সমসাময়িক, একসাথে তারা একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তারা বিশিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। 1919 সালের 19 শে সেপ্টেম্বর বরিশালে তার জন্ম, 1947 এ পুরবাঘ ছবিটি দিয়ে তার চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা শুরু। বাংলা ছবিতে ‘সিরিয়াস কমেডি’ র প্রবক্তা ছিলেন জহর রায়। সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে তিনি হল্লা মন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করে সবস্তরের দর্শকের কাছে বিশেষভাবে প্রশংশিত হন। এছারা ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিন্টেট’, ‘ছদ্মবেশী’ ছবি গুলিতে জহর রায়ের কৌতুকাভিনয় অন্যমাত্রা এনে দেয়।
5. তুলসী চক্রবর্তী:
হাস্যকৌতুক চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য অভিনেতা হলেন তুলসী চক্রবর্তী। 1899 সালের 3 রা মার্চ গোয়ারি নামক এক ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহন করেন তিনি, সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘পরশ পাথর’ চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি খ্যাতির শিখরে পৌছান। সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় পাত্র ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী, ‘পথের পাঁচালী’ ছবির পর সাংবাদিককে দেওয়া একটি সাখাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন,’ তুলসী চক্রবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করে থাকলে তাকে অভিনয় দক্ষতার জন্য অস্কার পুরস্কার প্রদান করা হত’। সত্যি যেকোনো চরিত্রে তিনি ছিলেন অনবদ্য। সারে চুয়াত্তরের বোর্ডিং মালিক রজনীবাবুকে কিন্তু বাঙালী দর্শক এখনও ভোলেননি।
6. নৃপতি নাথ চট্টোপাধ্যায়:
হাস্যকৌতুক জগতের আরেকটি নাম হল নৃপতি নাথ চট্টোপাধ্যায়। 1907 সালে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলায় তিনি জন্মগ্রহন করেন। বাংলা কৌতুক সিনেমা গুলিতে তার অবদান অনেক থাকা সত্ত্বেও এই প্রজন্মের অনেকেই তাকে চেনেন না। ‘মিস প্রিয়ংবদা’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘চিরিয়াখানা’ ইত্যাদি বিখ্যাত ছবি গুলিতে তার অবদান বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।
7. রবি ঘোষ:
হাস্যকৌতুক জগতের সর্বোতম হলেন এই রবি ঘোষ। 24 নভেম্বর 1931 সালে কলকাতায় জন্মনেন এই প্রতীভাশালী অভিনেতা, তার পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। বাংলা কৌতুক চলচ্চিত্র গুলিতে এনার অবদান অপরিশীম। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে তাকে বহুবার অভিনয় করতে দেখা গেছে। তপন সিনহা পরিচালিত ছবি ‘গল্প হলেও সত্যি’ রবি ঘোষের ফিল্ম কেরিয়ারের প্রধান মাইলস্টোন হিসেবে ধরা যায়। অগনিত চলচ্চিত্রে তিনি বার বার হাস্যরসের বাধ ভেঙেছেন। আবাদের সবার প্রিয় এই ‘বাঘা দা’ কে বাঙালী কোনও দিনই ভুলবে না। তিনি চলচ্চিত্রের সাথে সাথে নাট্য জগতেরও অন্যতম নক্ষত্র হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন।
8. অনুপ কুমার:
বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম অভিনেতা, আইকনিক কৌতুক শিল্পী হলেন এই অনুপ কুমার। 1930 সালের 17 ই জুন কিংবদন্তি নজরুল গীতি শিল্পী ও সুরকার ধীরেন্দ্রনাথ দাসের পুত্র হয়ে তিনি জন্মগ্রহন করেন, তার আসল নাম ছিল সত্যেন দাস। ধীরেন গাঙ্গুলির চলচ্চিত্র ‘হালকাঠা’ (1938) তে শিশু শিল্পী হিসাবে প্রথম অভিনয় শুরু। 1964 সালে, তিনি ‘পলাতক’ ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করার জন্য সেরা অভিনেতার পুরষ্কারে পান। অনুপ কুমার ‘বসন্তো বিলাপ’, ‘মৌচাক’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘প্রতিসোধ’ এবং অন্যান্য ছবিতে কৌতুক অভিনয়ের জন্য বাঙালী দর্শকদের কাছে প্রশংসিত হন। পরবর্তী সময়ে সন্দীপ রায় পরিচালিত ফেলুদার ছবিতে তাকে জটায়ুর ভূমিকাতেও অভিনয় করতে দেখা যায়।
9. চিন্ময় রায়:
এত হাস্যকৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে বাঙালীদের প্রিয় ‘টেনিদা’ কে কি ভোলা যায় ? 1940 সালের 16 ই জানুয়ারি বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্মগ্রহন করেন ‘টেনিদা’ খ্যাত চিন্ময় রায়। ‘মৌচাক’, ‘হাটেবাজারে’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘বসন্ত বিলাপ’ ইত্যাদি ছবিতে তার অভিনয় দর্শকের মন জয় করে। সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতেও একটি ছোট্ট চরিত্রে তাকে দেখা গিয়েছিল, যেখানে তিনি হাল্লা মন্ত্রীর জন্য কাজ করা একজন গুপ্তচর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তবে চারমূর্তী ছবিটিতে তার অভিনিত ‘টেনিদা’ চরিত্রটি আজও বাঙালীদের মধ্যে জনপ্রিয়।
10. সন্তোষ দত্ত:
হাস্যকৌতুক অভিনেতাদের আলোচনায় অবশেষে আশা যাক বিশিষ্ট কৌতুকভিনেতা বাঙালীর প্রিয় জটায়ুর কথায়। 2 ডিসেম্বর 1925 সালে জন্ম নেন সন্তোষ দত্ত। ভিন্নস্বাদের ছবিতে অভিনয় করলেও দর্শক তাকে মনে রেখেছে জটায়ু কিংবা অবলাকান্ত হিসেবে। সত্যজিৎ রায়ের কাছে জটায়ু চরিত্রটির জন্য তিনি ছিলেন ‘Perfect match’, তাই সন্তোষ দত্ত মারা যাওয়ার পর জটায়ুর ভূমিকায় তিনি আর কাওকেই ভাবতে পারেননি।
সন্তোষ দত্ত পেশায় ছিলেন উকিল কিন্তু ছবিতে অভিনয় ছিল তার নেশা। ফেলুদা সিরিজ ছারাও তিনি সত্যজিৎ রায়ের অনান্য ছবি যথা ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনেও রসিক মানুষ ছিলেন। শোনা যায় জয় বাবা ফেলুনাথে বিখ্যাত ছুরি প্রর্দশন দৃশ্যের শুটিং র আগেরদিন রাত্রে তিনি তার লাইফ ইন্সোরেন্সের কাগজ নিয়ে দেখতে বসেছিলেন। আরও এরকম বহু মজার গল্প সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সাখাৎকারে পাওয়া যায়।
আজকের প্রচ্ছদটি কেমন লাগলো অবশ্যই আমাদের লিখে যানান।
আরও পড়ুন: