‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’…

ক্ষমতায় থাকা চিরাচরিত শাসক শ্রেণির প্রতি এক চিরন্তন প্রশ্ন। ‘উলঙ্গ রাজা’ ও থাকবে, স্তাবক, উমেদার, প্রবঞ্চক ও থাকবে, কোথাও কোন ভীড়ের আড়ালে বা পাহাড়ের নীচে লুকিয়ে থাকবে শিশুটি। সবারই খোঁজা খুঁজিতে বেরিয়ে আসবে, আর সাহসী কণ্ঠে হয়তো আবার বলে উঠবে…
‘রাজা তোর…”
হয়তো বা শিশুটির কথায় পোশাক চাপাবেন রাজা। কিন্তু তার স্রষ্টা…কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সব প্রশ্নের উপরে গিয়েছেন? শুধু থেকে গিয়েছে চিরন্তন সেই প্রশ্ন…

নীরেন্দ্রনাথের জীবনী:-

নীরেন্দ্রনাথ
কালি ও কলম

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী….১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশবের পুরোটাই কেটেছে পূর্ববঙ্গে যা বর্তমান বাংলাদেশ, ঠাকুরদা আর ঠাকুমার কাছে। কবির ঠাকুরদা লোকনাথ চক্রবর্তী কর্মজীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়, কর্মজীবন শেষে ৫০ বছর বয়সে কলকাতার পাট চুকিয়ে বাংলাদেশের ফরিদপুরে ফিরে যান। তাঁর পিতা জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন কলকাতার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস প্রিন্সিপাল, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। কবির দুই বছর বয়সে তাঁর মা প্রফুল্লনলিনী দেবীও কলকাতায় চলে আসেন, তিনি একজন পরিপূর্ণ গৃহবধূ।


কবি থেকে যান তাঁর ঠাকুরদা কাছে। গ্রামের স্বাধীন পরিবেশে ইচ্ছেমতো দৌড়ঝাঁপ করে, কখনো গাছে উঠে, কখনো আপন মনে গ্রামের এই প্রাপ্ত থেকে অন্যপ্রাপ্তে ঘুরে কাটে তাঁর শৈশব।
তিনি যখন মাত্র চার, কবিত্বের স্ফুরণে বিস্মিত হয়েছিলেন তাঁর কাকিমা। মুখস্থ করে ফেলেন কবিগান, রামায়ণ গান। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের ছত্রছায়ায় প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ১৯৩০ সালে কলকাতায় আসেন তিনি।

‘মিত্র ইনস্টিটিউশনে’ স্কুলের পড়াশোনা করেন, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে “প্রবেশিকা পরীক্ষা”য় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গবাসী কলেজ’ থেকে আই. এ পাশ করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ‘সেন্টপলস্ কলেজ’ থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি. এ পাশ করেন।
ছাত্রাবস্থায় “শ্রীহর্ষ” পত্রিকার সম্পাদনা করে সংবাদপত্রের প্রতি তাঁর নিবিড় ও গভীর অনুরাগের সূত্রপাত হয়। “দৈনিক প্রত্যহ” পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। “সত্যযুগ” পত্রিকার সাংবাদিক রূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একে একে “মাতৃভূমি”, “স্বরাজ”, “ভারত”, “ইউনাইটেড প্রেস অফ্ ইন্ডিয়া” প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করা শুরু করেন।
১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি “আনন্দবাজার” পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। “বার্তা বিভাগ”, “রবিবাসরীয় বিভাগ”-এ বেশ কিছুদিন কাজ করার পর তিনি “আনন্দবাজার” পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধকার হন।

১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিশু ও কিশোর পত্রিকা “আনন্দমেলা”র সম্পাদক হন…তিনিই ছিলেন প্রথম সম্পাদক।
‘আনন্দমেলা’র জন্যই বাংলাভাষায় প্রথম ‘টিনটিন’ অনুবাদও তাঁর। কবি সত্তাটির সঙ্গেই তাঁর মধ্যে ছিল আরও বহু শৈল্পিক সত্তার অবস্থান। রোমান্টিকতা, প্রেম, প্রকৃতি, মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-বেদনা, স্পষ্টবাদী ও স্বদেশপ্রেমের কবি, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, গোয়েন্দা গল্পাকার, শিশুসাহিত্যিক, ভ্রমণ কাহিনীর লেখক, বানান-বিশেষজ্ঞ এবং অবশ্যই দক্ষ সম্পাদক।

কবিতা তাঁর রক্তের সম্পদ:-

কবিতা তাঁর রক্তের সম্পদ। কবি প্রতিভার বিকাশ তাই ঘটতে শুরু করে ছেলেবেলা থেকেই। যা দেখে তাঁর কাকিমা বলেন… তুই তো দেখছি কবিদের মত কথা বলছিস। মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। কিন্তু সেটা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ১৬ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখে এসেছেন। ১৬ বছর বয়সেই “শ্রীহর্ষ” পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্যে দিয়েই সাহিত্যজগতে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়।
তিনি মোট ২৯ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি উপন্যাস, ১ টি আত্মস্মৃতি, ১ টি কাব্যনাট্য, কয়েকটি আলোচনা গ্রন্থ, ভ্রমণকাহিনী, রহস্যকাহিনী, ছোটদের ছড়া ও কবিতা, কবিতাসমগ্র ও নির্বাসিত কবিতা এবং ৩ টি রহস্যকাহিনী সমগ্র রচনা করেন।
৩০ বছরের যুবক কবি নীরেন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘নীল নির্জনে'(১৯৫৪)। এরপর একে একে …
“অন্ধকার বারান্দা” (১৯৬১),
“প্রথম নায়ক” … এটি একটি কাব্যনাট্য (১৯৬১),
“নিরক্ত করবী” (১৯৬৫),
“নক্ষত্র জয়ের জন্য” (১৯৬৯ ),
“কলকাতার যীশু” (১৯৬৯),
“উলঙ্গ রাজা” (১৯৭১),
“খোলা মুঠি” (১৯৭৪),
“কবিতার বদলে কবিতা” (১৯৭৬),
“আজ সকালে” (১৯৭৮)
“পাগলা ঘন্টি” (১৯৮১), “ঘর-দুয়ার” (১৯৮৩)
“সময় বড়কম” (১৯৮৪) “রূপ-কাহিনী” (১৯৮৪)
“যাবতীয় ভালবাসাবাসি” (১৯৮৬)
“ঘুমিয়ে পড়ার আগে” (১৯৮৭),
“জঙ্গলে এক উন্মাদিনী” (১৯৮৯)
“আয় রঙ্গ” (১৯৯১)
“চল্লিশের দিনগুলি” (১৯৯৪)
“সত্য সেলুকাস” (১৯৯৫)
“সন্ধ্যারাতের কবিতা” (১৯৯৭)
“অন্য গোপাল” (১৯৯৯)
“জলের জেলখানা থেকে” (২০০০)
“সাকুল্যে তিনজন” (২০০০)
“কবি চেনে সম্পূর্ণ চেনেনা” (২০০১)
“দেখা হবে” (২০০২)
“ভালবাসা মন্দবাসা” (২০০৩)
“মায়াবী বন্ধন” (২০০৪)
“জ্যোৎস্নায় একেলা” (২০০৬)
তাঁর একটি উপন্যাস “পিতৃপুরুষ” (১৯৭৩) এবং একটি আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ “নীরবিন্দু ১” (১৯৯৩)। তিনটি ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন তিনি…”গঙ্গাযমুনা” (১৯৮২),”বাইরে দূরে”
(১৯৯২),”আট ঘাটের জল” (১৯৯৩)।
লিখেছেন কয়েকটি রহস্যকাহিনীও “শ্যামনিবাস রহস্য” (১৯৯০), “মুকুন্দপুরের মনসা” (১৯৯১),”বিষাণগড়ের সোনা” (১৯৯২) “চশমার আড়ালে” (১৯৯৩), “রাত তখন তিনটে” (১৯৯৪), “লকারের চাবি” (১৯৯৫)
“বরফ যখন গলে” (১৯৯৫) “একটি হত্যার অন্তরালে” (১৯৯৭) “আড়ালে আছে কালীচরণ” (১৯৯৮)”পাহাড়ি দিছে” (১৯৯৮)
“আংটি রহস্য” (২০০০) “জোড়া ভাদুড়ি”
(২০০১) “শান্তিলতার অশান্তি”(২০০২),
“কামিনীর কণ্ঠহার” (২০০৩)। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রের নাম হল “ভাদুড়ী মশাই”। “ভাদুড়ি সমগ্র ১ম” (২০০৬),
“ভাদুড়ি সমগ্র ২য়” (২০০৬),
“ভাদুড়ি সমগ্র ৩য়” (২০০৬)।
আবার কিছু আলোচনা মূলক গ্রন্থও তার সঞ্চয়ে আছে… “কবিতার ক্লাস” (১৯৭০)
“কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা” (প্রথম সংস্করণ – ১৯৭৬ , দ্বিতীয় সংস্করণ – ১৯৯২)
“কবিতা কী ও কেন” (১৯৮২),
“সমাজ সংসার” (১৯৮৮),
“বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন” (১৯৯১)
“রবীন্দ্রনাথ ও আমরা এবং অন্যান্য রচনা” (২০০১)।
বাদ যায়নি ছোটদের ছড়া ও কবিতাও… “সাদা বাঘ” (প্রথম সংস্করণ – ১৯৭৯ , প্রথম সৃষ্টি সংস্করণ – ২০০১)
“বিবির ছড়া” (১৯৮২)
“বারো মাসের ছড়া” (১৯৮৮)
“ও কলকাতা ” (১৯৯১)
“ডাইনোসর” (১৯৯১)
“ভোরের পাখি” (২০০০)
“নদীনালা গাছপালা” (২০০১)
“ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” (২০০২)
“বারো পাখির ছড়া” (২০০৩) “খোকনের খাতা” (২০০৩)”ছোটদের ছড়া” (২০০৩)
“বারো পুতুলের ছড়া” (২০০৪)”মায়ের কাঁথা” (২০০৫) “পাঁচ বছরের আমি” (২০০৫)
“ছেলেবেলা” (২০০৬)”দাশুর কথা” (২০০৬)
“রাত-পাহাড়া” (২০০৬)।
পুরস্কার যে তিনি কত পেয়েছেন, সেই হিসেবে নাই বা গেলাম। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে “উল্টোরথ পুরস্কার”, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে “তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার”।১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে : “উলঙ্গ রাজা” (১৯৭১) কাব্যগ্রন্থের জন্য “সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার”। এছাড়াও এই একই খ্রিস্টাব্দে তিনি লাভ করেন “বর্ষশ্রেষ্ঠ পুরস্কার”। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে “আনন্দ শিরমণি”।
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে “স্বর্ণাঞ্চল পুরস্কার”।
২০১০ খ্রিস্টাব্দে : কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য “বিদ্যাসাগর পুরস্কার”। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে : পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে কবি সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী “বঙ্গবিভূষণ” সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
তাঁর কবিতার ভাষা আধুনিক কবিদের মতো দুর্বোধ্য নয়। কবিতার মাঝে মাঝে তাঁর গল্প বলার প্রবণতা দেখা যায়। বিষয় উপস্থাপনার মাধ্যমে কবিতাকে অন্যমাত্রা দিয়ে ভাবগত ব্যঞ্জনাকে অক্ষুণ্ণ রেখে কবিতায় বর্ণিত চরিত্রকে উচ্চারণের দ্যোতনায় অর্থময় করে তুলতেন তিনি। যেমন “অমলকান্তি” , “কলকাতার যীশু” ইত্যাদি।
তাঁর কবিতা সহজ ভাষার টান টান চেতনার স্পর্ধিত উচ্চারণে উজ্জ্বল। এই চেতনা কবির পরিপার্শ্বের চেতনা। কবিতার নির্মিতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য…কবিতায় থাকে ছবি আর কারিগরি। কিন্তু কবিতা তাঁর কাছে কল্পনালতা ছিল না, কবিতায় মিথ্যা কখনো লেখেননি। এ বোধ থেকেই তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিল দায়বদ্ধতার বোধ। কিন্তু তা কখনো উচ্চকিত ছিল না, ছিল না আত্মমগ্ন প্রতিভাসও। নিজেই জানিয়েছেন, একজন কবি তাঁর নিজের কথা লিখছেন, তা পড়ে অন্যরাও মুক্তি অনুভব করছে। কবির দায়বদ্ধতা থাকে তাঁর নিজের প্রতি। সাহিত্যের শর্ত তাঁকে মানতে হয়। খুবই স্পষ্টকথন। কবিকে দায়বদ্ধ হতেই হয়; কিন্তু তাঁর কবিতাকে কবিতাও হয়ে উঠতে হবে।
তিনি ঠিকই জানতেন, কবিতা কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক বা আত্মগত বিবৃতি নয়, অবিরল কথন নয়, কবিতা হচ্ছে স্বগত সংলাপ। নিজেই বলেছেন, আ পোয়েট টকস্ টু হিমসেল্ফ। কিন্তু এই যে কবিকথন, তা কিন্তু পৌঁছে যাবে অন্যের কাছে, যাঁরা কবির চোখে দেখবেন পারিপার্শ্বিক জীবনের আবিলতা আর অসংগতিকে। আত্মগত ভাবনা থেকে সামাজিক অভিভবে বেজে উঠবে কবিতা।
স্পষ্টবাদী কবি আত্মসমীক্ষায় ব্রতী হয়ে “কলকাতার কড়চা” কবিতায় লিখেছেন, “তুমি তিলোত্তমা হওনি, আমরাই তিলে তিলে ছোট হয়ে গেছি।” কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ঘৃণা করতেন মেকি দেশপ্রমকে।
এ হেন ‘কলকাতার যীশু’ যীশু খ্রিস্টের জন্মদিনে পাড়ি দিলেন রোদ্দুরের দেশে। চারিদিকে উৎসবের আমেজ। সবার সব চাহিদা পূরণ করতে উপস্থিত সান্তা। কত ইচ্ছেই তো কত জনের পূরণ হলো আজ…..বিনিময়ে সান্তা নিয়ে গেলেন তাঁকে অজানা সেই দেশে।।
কলকাতার যীশু বিষয়ে তিনি বলেন…’এক বার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু।’
কিছু পেলে কিছু দিয়ে দিতে হয়, তা নইলে যে পৃথিবী চলে না, শিখিয়েছিলেন তো তিনিই…. সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে গেলেন তিনি।
‘অমলকান্তি’ ছিল, আছে আর থাকবেও
….কেবল থাকলেন না তার স্রষ্টা। রোদ্দুর হতে পারে নি অমলকান্তি, কিন্তু রোদ্দুরের দেশে যাওয়াটা আটকানো গেল না তাঁর।
অমলকান্তি’….
শুধু একটা নাম নয়, নয় শুধু কবিতা, নয় শুধু কবির পরিচায়ক, নয় শুধু সাহিত্য….একটা এমন শব্দ, যা একই আঙিনায় নিয়ে আসে সাহিত্য জগৎ ও বাস্তব জগৎকে, একই সাথে মেলবন্ধন ঘটায় কবি ও সাধারণ মানুষের, একই সূত্রে বাধা পরে বাউন্ডুলে ও কর্মপরায়ন মানব প্রকৃতি, একই আয়নায় প্রতিচ্ছবি দেখি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও উচ্চাশাহীন ব্যক্তিত্বের।
রোদ্দুর হতে চেয়েছিল সে…. ভিজে, স্যাৎস্যেতে, আলো-বাতাস-রোদ্দুর হীন বস্তির ছেলে অমলকান্তি, একটু রোদ্দুরের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তাই জীবনে ডাক্তার, মাষ্টার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল সব কিছু ছেড়ে সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
আপাতদৃষ্টিতে তার চাওয়াটাকে খুব পাতি মনে হতে পারে অনেকেরই…. নিজেকেও বাদ দিচ্ছি না। কিন্তু যদি একটু গভীরে গিয়ে ভাবি, রোদ্দুর হওয়া কি যার তার দ্বারা হতে পারে? রোদ্দুর হতে গেলে সূর্যের তীব্র দহনে নিজেকে পোড়াতে হয়, তারপর রোদ্দুর হওয়া যায়, সে কম্ম সবার নয়।
সম্ভাবনা সব সময় ক্লাসের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীর আসে না, ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের শিক্ষার্থীর মাঝেও সম্ভাবনা থাকে। সে হয়তো শব্দ রূপ পারে না…কিন্তু বিকেলের লাজুক রোদ্দুর হয়ে অনেকেরই আনন্দের কারণ হতে পারে।
গতানুগতিকতায় গা ভাসানো মানুষের অভাব নেই পৃথিবীতে, জন্মের আগেই সন্তানকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করার বাসনা মনে হয় সব মা বাবাই মনে মনে পোষণ করে। কিন্তু সেখানে অমলকান্তি মূর্তিমান ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রমদের এ সমাজে আলাদা জায়গা করে নিতে অত্যন্ত বেগ পেতে হয়। ‘উঠি তাহলে’ বলে তাকে দোরে দোরে ফিরতেই হয়। এটাই ট্র্যাজেডি।
বললেই সমাজ বলবে, তোকে রোদ্দুর হতে কে বলেছিল? ডাক্তার, মাষ্টার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল…সব ছেড়ে রোদ্দুর হতে গিয়েছিলিস। তুই ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবি না তো ,কি আমি বেড়াবো?
বাস্তবিক ইচ্ছে পূরণ ক’জনের হয়? অমলকান্তি তোমারও হয় নি? আফসোস কোরো না। সবাই তোমার মত সাহস রাখে না, সাহস করে তুমি রোদ্দুর হতে চেয়েছো…
….এগিয়ে যাও। একদিন সব্বাই তোমায় অনুসরণ করবে।
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী…. অমলকান্তি আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে, কেবল আমরা বলার সাহস করতে পারি না। আপনিও আমার হৃদয়ের মনি কোঠায় একই ভাবে রয়ে যাবেন সারাজীবন।

নিজের চারপাশে যা ঘটছে তা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরতেন কবিতার ছন্দে। কলমের খোঁচায় উঠে আসত শহরের ফুটপাথবাসী উলঙ্গ শিশুর কান্নার কথা, জ্যামে ফেঁসে থাকা কলকাতার বাস চালকের বিরক্তিকর দাঁত ঘষটানি…আসলে উঠে আসত এক আস্ত হাসি-কান্না-রাগ-বিষণ্ণতা মেশানো
জীবনের গল্প। যা আনুষ্ঠানিকভাবে থেমে গেল আজ।
এ বছরের ২৯ জুলাই মারা গিয়েছিলেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী। বন্ধুর স্মৃতিচারণায় ‘দেশ’ পত্রিকায় নীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন…. ‘আমারও আর দেরি নেই। রমাপদকে বেশি দিন একা থাকতে হবে না।… ও খুব শিগগিরই কথা বলার লোক পেয়ে যাবে।’ সেই লেখার শেষে নীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এখন একদম শয্যাশায়ী অবস্থায় আছি। আর ক্রমাগত এই কথাটা ভাবছি, আমি শিগগিরি যাব…।’

সে চলে গেল বলে গেল না….

নীরেন্দ্রনাথ
The wall


৯৪ বছর বয়সে উৎসবের আমেজের মাঝেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ৷ বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেলেন তিনি, বেশ কিছু দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন।