কংগ্রেসের পথ চলা শুরু হয় ১৮৮৫ সালে অ্যানি বেসান্তের হাত ধরে। এটা আমরা সবাই জানি। প্রথমদিকে কংগ্রেস রাজনৈতিক সংগঠনের বদলে অনেক বেশি পরিমাণে আলাপ-আলোচনার মঞ্চ ছিল। কিন্তু সেখান থেকে দ্রুত ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে গিয়ে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রধান নেতৃত্বে দানকারী সংগঠনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কংগ্রেস।

সেই থেকে আজও ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের সরব অবস্থানের ধারাবাহিকতা চলছে। অনেক শক্তি ক্ষয়ের পরেও দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আজ‌ও কংগ্রেস অবস্থান করে। তবে তা বর্তমানে বিজেপির থেকে অনেক দূরের সেকেন্ড বয়ে পরিণত হয়েছে। এই ১৩৫ বছরের দীর্ঘ পথ চলায় অজস্র ভাঙনের সম্মুখীন হয়েছে শতাব্দী প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি। এরমধ্যে ১৯৬৭ সালের ভাঙ্গনটি ছিল সবচেয়ে বড়।

৬৭ সালের ভাঙ্গনে কংগ্রেস দলের প্রতীক পর্যন্ত পাল্টে যায়, আগে ছিল জোড়া বলদ তার বদলে হল কাটা হাত। যদিও কংগ্রেস অনুগামীরা বলে এই হাত নাকি আশ্বাসের! এই হাত বহন করে মানুষের পাশে থাকার, সঙ্গে থাকার বার্তা। আসলে এই ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন ধারাটিই বর্তমানে মূল কংগ্রেসে পরিণত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, জহরলাল নেহেরুর আদি কংগ্রেসের কোনো অস্তিত্বই আজ বজায় নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ সভ্যতা যেমন এগিয়ে চলে তেমনি তা সর্বদা নতুনের ‘হাত’ ধরে।

১৯৬৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী দলের বয়স্ক এবং আঞ্চলিক নেতাদের নিয়ে গড়ে ওঠা ‘সিন্ডিকেটের’ প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে দল ভেঙে দিয়ে ‘ইন্দিরা কংগ্রেস’ গঠন করেন। যদিও পরের নির্বাচনেই দেখা যায় সিন্ডিকেট পরিচালিত পুরানো কংগ্রেসের জাবতীয় অস্তিত্ব মুছে গিয়েছে, দেশের মানুষের কাছে মূল দল হয়ে উঠেছে ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস। খুব দ্রুত সেটি মূল ধারার কংগ্রেস হিসাবে মানুষের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকেও স্বীকৃতি লাভ করে,তবে প্রতিকটা বদলে যায়।

20210102 095134
একে অ্যান্টনি

স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের রাজনীতির কথা ইন্দিরা গান্ধীকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই হতে পারে না। দেশের একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রীর শাসনকাল কখনোই শুধু সাফল্য বা ব্যর্থতা রাস্তা ধরে হাঁটেনি। তা চলেছে সাফল্য এবং ব্যর্থতা একই সঙ্গে হাত ধরাধরি করে। আসলে ব্যর্থতা নয়, কিছু কিছু পাপ অন্যায়কে আমরা হালকা করে দিতে ‘ব্যর্থতা’ বলে চিহ্নিত করি। কিন্তু জরুরি অবস্থা জারি করে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। আবার অপারেশন ‘ব্লু স্টার’ ছিল তার হঠকারী এবং অবিবেচক সিদ্ধান্তের একটি নমুনা।

তবে কেবলমাত্র দেশ শাসনের ক্ষেত্রেই অটোক্রাট হয়ে উঠছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, তা কিন্তু নয়। সমস্ত একনায়কতন্ত্র শাসকদের উদাহরণ মেনেই তিনি নিজের রাজনৈতিক দল অর্থাৎ কংগ্রেসেও একনায়কতন্ত্র শুরু করেন। ১৯২০ সালে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশন থেকে দলের কার্যকরী কমিটি বা ওয়ার্কিং কমিটির পথ চলা শুরু হয়। সেই সময় থেকে জহরলাল নেহেরুর সময় পর্যন্ত কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণ এবং দল পরিচালনার ক্ষেত্রে এই ওয়ার্কিং কমিটিই ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। এই সময়ে দলের কার্যকারী সভাপতি অনেক বেশি সক্রিয় থাকতেন সভাপতির তুলনায়। তখন দলের সভাপতির পাশাপাশি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদরা কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হতেন। এর ফলে দলের ভেতর যেমন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল থাকত তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বা দলের হাল ধরার জন্য নেতারা খুব স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়ে যেতেন।

কোন নেতাদের প্রতি দলের সাধারণ কর্মী সমর্থকদের আস্থা এবং সমর্থন সবচেয়ে বেশি সেটা স্বাভাবিকভাবেই দলের অভ্যন্তরে নির্বাচন হলে তবেই বুঝতে পারা সম্ভব। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী দলের যাবতীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেওয়ার পর ওয়ার্কিং কমিটির একাধিক সদস্য মনোনীত করতে শুরু করেন। যদিও তখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের অভ্যন্তরে নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। তার ফলে শরদ পাওয়ার মতো নেতারা কংগ্রেসের প্রথম সারিতে উঠে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের হাল ধরার পর ১৯৯৮ সাল থেকে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচন করা নিয়ে কংগ্রেসের ভেতর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

সোনিয়া গান্ধী বরাবরই তার পছন্দ মতো ব্যক্তিদের দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে জায়গা দিয়ে গিয়েছেন। দীর্ঘদিন দলের অভ্যন্তরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না করে মনোনয়নের ভিত্তিতে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটি খুব স্বাভাবিকভাবেই তার গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা হারিয়েছে। তারা কেবলমাত্র দলীয় সভাপতির হ্যাঁ তে হ্যাঁ  মেলানো দাসে পরিণত হয়েছে! তবে কংগ্রেস যতদিন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় ছিল ততদিন এই সমস্যা খুব একটা প্রকট হয়ে দেখা দেয় নি। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ দীর্ঘ ৬ বছর দল কেন্দ্রের ক্ষমতার বাইরে থাকার ফলে এবং বিজেপি তাদের ক্ষমতা যখন আরো ধীরে ধীরে সংহত করে তুলছে তখন কংগ্রেসের সর্বোচ্চ স্তরে নেতৃত্বহীনতা ও দক্ষতার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। এর মূল কারণ বংশবদ ওয়ার্কিং কমিটি!

এরকম সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যের কারণে সোনিয়া গান্ধীও আর দলের সভাপতির দায়িত্বে থাকতে চাইছেন না। অন্যদিকে রাহুল গান্ধীও সভাপতি হতে এখনো পর্যন্ত রাজি নন, বরং তিনি বলছেন এবার সময় এসেছে গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে কাউকে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত করার।সে ক্ষেত্রে রাহুল এবং প্রিয়াঙ্কা যদি কংগ্রেসের সভাপতি না হন তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই দলের হাল তুলে দিতে হবে গান্ধী পরিবারের বাইরের অন্য কোনো নেতার হাতে। ঠিক এই জায়গাতে এসেই হোঁচট খাচ্ছে কংগ্রেস নেতৃত্ব। তারা বুঝে উঠতে পারছে না গান্ধী পরিবারের বাইরের কোন নেতার হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিলে তিনি দলকে অখন্ড রেখে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।

ঘটনা হল দীর্ঘদিন ধরে গান্ধী পরিবার যেমন কংগ্রেসের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে তেমনই শতাব্দী প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলের সাধারন নেতাকর্মীরা গান্ধী পরিবারের দিকে তাকিয়েই মূলত দল করেন। সেক্ষেত্রে দলের বাইরের কাউকে দায়িত্বভার তুলে দিলে কংগ্রেসকে ঐক্যবদ্ধ রাখাটাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেটাতো কংগ্রেসের নিজেদের সমস্যা, আমরা বরং নতুন বছরের শুরুতেই দেখে নিই গান্ধী পরিবারের বাইরের কোন নেতারা কংগ্রেস সভাপতি হতে পারেন।

১) এ কে অ্যান্টনি

কেরলের এই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গান্ধী পরিবারের বিশেষ আস্থাভাজন বলেই পরিচিত। সেইসঙ্গে দীর্ঘদিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করায় তার সঙ্গে অন্যান্য দলগুলির নেতাদের বেশ ভালই সম্পর্ক আছে। অত্যন্ত ভদ্র এবং ঠান্ডা মাথার একে অ্যান্টনি কংগ্রেসের সভাপতি হলে গান্ধী পরিবারও অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকবে। কারণ সে ক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরে তাদের প্রভাব নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।

এই দক্ষিণ ভারতীয় নেতার সঙ্গে কংগ্রেসের সমস্ত শিবিরের নেতাদেরও সুসম্পর্ক আছে বলেই শোনা যায়। এছাড়াও তিনি দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। তাই অ্যান্টনির সভাপতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি।

20210102 095004
গুলাম নবি আজাদ

২) গুলাম নবি আজাদ

এই কাশ্মীরি নেতা বর্তমানে রাজ্যসভায় কংগ্রেস দলনেতার ভূমিকা পালন করছেন। গুলাম নবি জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও বটে। তার সঙ্গে গান্ধী পরিবারের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক ছিল। ছিল, কারণ কিছুদিন আগে যে ২৩ জন নেতা দলের কাজকর্ম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখেছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ওই চিঠির পর‌ই গুলাম নবি আজাদের সঙ্গে গান্ধী পরিবারের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। সে দিক থেকে দেখতে গেলে দলের সভাপতি পদে বসার সম্ভাবনা তার যথেষ্ট কম।

তবে এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক যদি গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তাঁর তৈরি হওয়া দূরত্ব মিটমাট করে নিতে পারেন তাহলে অন্যতম সংখ্যালঘু মুখ হিসাবে শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেসের সভাপতি পদে তাকে দেখা যেতেই পারে। তবে গুলাম নবি আজাদ যদি কংগ্রেসের সভাপতি হন সেক্ষেত্রে কাশ্মীর ইস্যুতে কংগ্রেসকে আরো বেশি বিপাকে ফেলার চেষ্টা করবে বিজেপি।

৩) মল্লিকার্জুন খার্গে

এই কর্ণাটকী নেতা অতীতে কর্নাটকের রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সেইসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে এবং লোকসভার কংগ্রেস দলনেতা হিসাবেও তিনি দীর্ঘদিন ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার বিষয়টি সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট দক্ষ। সেইসঙ্গে গান্ধী পরিবারের বিশেষ আস্থাভাজন হওয়ার বিষয়টি তাকে পরবর্তী কংগ্রেস সভাপতি পদের দৌড়ে রেখেছে।

৪) অশোক গেহলট

দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অশোক গেহলট বর্তমানে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী পদে আছেন ।সেই সঙ্গে তিনি গান্ধী পরিবারের খুব কাছের একজন বলে মনে করা হয়। এই বর্ষীয়ান রাজনীতিককে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি করে রাজস্থানের দায়ভার তরুণ নেতা শচীন পাইলটের হাতে তুলে দিতে পারে কংগ্রেস। এর ফলে রাজস্থানের কুর্সি নিয়ে দ্বন্দ্ব যেমন দূর হবে তেমনি দলের সভাপতি পদে তাদের ঘনিষ্ঠ একজন নেতাকেই বসাতে পারবে গান্ধী পরিবার।

কংগ্রেস,
শশী থারুর

৫) শশী থারুর

এই তালিকার সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং জনপ্রিয় নাম বোধহয় এটিই। তরুণ প্রজন্ম এবং শিক্ষিত জনসমাজের প্রতিনিধি হিসাবে শশী থারুরের হাতে দলের দ্বায়িত্ব তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্তমানে কেরল থেকে লোকসভার সদস্য হিসাবে কাজ করা থারুর অতীতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সহকারি মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তার সঙ্গে গান্ধী পরিবারের সম্পর্ক সবসময়ই নরমে-গরমে চলেছে। তিনি যেমন চিরাচরিত প্রথা মেনে গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ট হয়ে ওঠেননি, তেমনি একাধিক ইস্যুতে গান্ধী পরিবারকে ডিফেন্ড করতেও এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে এই দক্ষিণ ভারতীয় রাজনীতিককে।

থারুরের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হল তার পরিচিতি, তার দেশের কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। সেই সঙ্গে তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন বিজেপির নেতারাও। এর ফলে দলকে যদি সত্যিই সামনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কংগ্রেস নেতাদের উদ্দেশ্য হয় তাহলে তারা শশী থাররের ওপর নিশ্চিন্তে দলের দায়িত্ব তুলে দিতে পারেন তারা।

এই সম্ভাবনার তালিকায় থাকা পাঁচজন রাজনৈতিক নেতার বাইরে থেকেও আরো কাউকে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত করতেই পারে কংগ্রেস। যেমন কোনো উপায় না দেখে কাজ চালানোর জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাতেও দলের দায়িত্বভার সাময়িক ভাবে তারা তুলে দিতে পারে। তবে তা পিছনের পথে হাঁটার সম্মুখীন হবে। এই মুহূর্তে কংগ্রেসকে চাঙ্গা করতে হলে নতুন প্রজন্মের চাহিদা বুঝবে এবং সেই অনুযায়ী কর্মসূচি নির্ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে এরকমই নেতার হাতে দলের যাবতীয় দায়িত্বভার তুলে দেওয়া উচিত।