পরিচালনা হল শৈল্পিক স্বত্বা, আভ্যন্তরীন প্রতিভা ও ব্যাতিক্রমী চিন্তাধারার সংমিশ্রন। যা পরিচালক ব্যাতীত করোর রক্তেই মিশে থাকে না । পরিচালনা করাও কিন্তু সকলে দ্বারা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এর জন্য আলাদাই এক প্রতিভা থাকা দরকার, কারন পরিচালনা হল মগজের খেলা, যে যত মগজ খাটিয়ে নতুন ভাবনার উন্মোচন ঘটিয়ে সঠিক ভাবে চিত্রায়িত করতে পারবে সেই আসল পরিচলক। নিজের চিন্তাধারা অন্যের মধ্যে দিয়ে অভিনয়ের দ্বারা ফুটিয়ে তোলা এক কথায় অসাধ্য সাধন, কারন পরিচালক যেটা চায় যতক্ষণ না অবধি তার প্রাপ্তি ঘটে ততক্ষণ কোন সিনামেই প্রানের সঞ্চার হয় না। পরিচালকের সমার্থক শব্দ অধিকর্তা, পথপ্রদর্শক, নির্মাণকর্তা, উপদেষ্টা। তার নির্দেশনা এক বিরাট বড় ভূমিকা বহন করে চলচ্চিত্রে। পরিচালনায় ঘাটতি থাকলে সেই সিনেমা মুখ তুবড়ে পড়ে সাথে পরিচালক ও আর দ্বিতীয় বার উঠে দাড়াতে পারে না হ্যাঁ কিছু ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে। কারন চিত্র জগতে চলে সেরার লড়াই তুমি সেরা হলে টিকে যাবে নয়তো ফুটে যাবে।
এই সেরার লড়াইয়ে শিরোপা জিতে আসছে এক বাঙ্গালী চিত্র পরিচালক। ফিল্ম ইন্ড্রাস্টিতে পদার্পনকলীন বয়স ১০ বছর, এই ১০ বছর তিনি গোটা দর্শককুলকে উপহার দিয়েছেন কিছু অসাধারন মনে দাগ কেটে দেওয়ার মতো সিনেমা। কারন তার কাছে আছে একটা দামী মগজ, আর সেই মগজে আছে ভুরি ভুরি অভিনব কল্পকাহিনীর সম্ভার । আর সেই কাহিনী নিদারুণ পরিচালনায় শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর পর্যায় ফুটিয়ে তোলে। আর সেই সনামধন্য ব্যক্তিত্ব হলেন সৃজিত মুখার্জি।এই পরিচালক শুধু ভারতীয় বাঙ্গালী সেরা চলচিত্র পরিচালক হিসেবে পরিচিত হলেও একধারে তিনি অভিনেতা, চিত্র্যনাট্যক্র, অর্থনিতিবীদ। ২০১০ সালে অটোগ্রাফ সিনামার হাত ধরে তার পরিচালনা স্বত্বার জন্ম হয়। তার পর থেকে তাকে পিছন ফিরে দেখতে হয় নি। নদীর স্রোতের মতো ধবমান গতিতে যে বয়ে চলছে আজও সে বাধাহীন চলমান।
দক্ষ পরিচালনস্বত্তা প্রমানের ৫ সেরা সিনেমা
২২ শে শ্রাবণ
২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমা প্রশংসার ঝড় তুলেছিল চলচ্চিত্র মহলে, বাংলা গতধরা স্টেরিওটাইপ স্ক্রিপ্ট থেকে বেরিয়ে সম্পুর্ন আলাদা আঙ্গিকে তৈরি হয়েছিল এই সিনেমা। এটি বাংলা মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারভিত্তিক সিনেমা। গোটা সিনেমা জুড়ে রয়েছে শুধু সাসপেন্স, কোনসময় ডি মোটিভেট হওয়ার যো নেই। এই চলচিত্ত্রের মূল সারাংশ হল মানষিক ভারসম্যহীন খুনির বিরুদ্ধে তদন্ত করা, যে খুনি কবিতার লাইন রেখে খুন করে, নিজের হারানো আভিজাত্য, প্রাপ্তি, নাম ফিরে পাওয়ার উচ্চ আকাঙ্খার লোভে, পুলিশের উপর তীব্র প্রতিশোধের আগুনে জ্বোলে খুনির এই খুনের ছক কষার মোটিভ । আর তার খুনের দিনের মধ্যে আছে এক অদ্ভুদ রহস্য কারন খুন করার সকল তারিখ হিসেবে বাঙ্গলী কবিদের মৃত্যুবার্ষিকীকে বেঁছে নেয়। আর তাই এই সিনেমার নামকরনও হয়েছে ২২ শে শ্রাবণ।
হেমলক সোসাইটি
২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ডার্ক কমেডি চলচ্চিত্র । যার অন্তরালে লুকিয়ে জীবনের গভীর অর্থ। চলচ্চিত্রটি জীবনের আদিম অস্তিত্ব বিষয়ক এক মানষিক সঙ্কট নিয়ে তৈরি হয়েছে। আত্ম্যহতা জীবনের একমাত্র মুক্তির উপায় নয়। জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না বরং তার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই করে যেতে হয়। কিন্তু অনেকের পথে সেটি সম্ভব হয় না তখন তারা মনের অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে যায়। আত্ম্যহত্যা একটি রোগ মাত্র তা থেকে বিরত থাকার পন্থা কিছুটা অন্যরকমও হতে পারে এই সিনেমায় তার অভিনব পরিচালনার দ্বারা তুলে ধরা হয়েছে। কথায় আছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়, এটাও ঠিক তাই। আত্মহত্যার সেন্টারে আত্মহত্যার প্রশিক্ষন নিতে গিয়ে কিভাবে নিজের জীবনকে ভালোবাসা যায়, জীবন বড়ই রঙ্গীন তা অনুভব করা যায় সেটি হল এই হেমলক সোসাইটির আসল সারমর্ম।
রাজকাহিনী
১৯৪৭ সালের দেশভাগের কাহিনীর নিরিখে মুক্তি ঘটে এই চলচ্চিত্রটি। ভারত ও পাকিস্থান এই দুই দেশের সীমান্তের ঠিক মাঝ বরাবর রয়েছে একটি বাড়ি যাতে বাস কিছু পতিতার। র্যাডক্লিফ লাইন টানা হবে যে মার্গ দিয়ে, সেখানে পতিতালয় উপস্থিত থাকায় হয় সমস্যার সূত্রপাত। পায়ের তোলার মাটি ও মাথার উপরের ছাঁদ কেড়ে নিলে যে কেউ গর্জে ওঠে। আর এই বিভাজন, অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতে লড়াই করে পতিতালয়ের সকল নারী। কিন্তু এই সিনেমায় যেটা সবথেকে নজরকাড়া তা হল সৃজিতের পরিচালনায় জীবন্ত হয়ে ওঠা সেই নারীর লড়াই দৃশ্য যা দেশভাগের সময়কার ঘটনা মনে করিয়ে দেয়।
উমা
টার্মিনাল রোগে আক্রান্ত এক মেয়ের অসহায় বাবা। টাকা থাকা সত্বেও সে জীবন যুদ্ধে কাঙ্গাল। কলকাতার দুর্গাপুজা দেখা মেয়ের স্বপ্ন কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে সুইজ্যল্যন্ড থেকে কলকাতাটা এসে সেখানে নকল দুর্গাপুজা করার চেষ্ঠা করা এবং এর মাধ্যমে কিছু মানুষের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া, ও কিছু ঘটনার স্মৃতিচারন ঘটানো । চলচ্চিত্রটির মধ্যে রয়েছে আবেগ, যে কেউ এই চলচ্চিত্রের সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারবে। আসল মা ন হয়েও নিজেকে মা ভাবার অভিব্যাক্তি, সেই স্নেহ মমতার ছোঁয়া এই সিনেমার অন্তর্ভুক্ত , এছাড়া টুকরো টুকরো অনেক চরিত্রিক অস্তিত্ব বর্তমান এই চলচ্চিত্রে।
জাতিস্মর
‘এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধর’ যেমন এই সিনেমার গান দুর্দান্ত ঠিক তেমনই মন ছুয়ে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ার উপক্রম এই সিনেমা। আর আগে জাতিস্মরের গল্পের আঙ্গিকে কিছু সিনেমা হয়েছে বটে কিন্তু কিন্তু চিত্রনাট্যকে এই পর্যায়ে হয়তো কেউই নিয়ে যেতে পারে নি। আগের জন্মের স্মৃতিচারন করা, আর আগের জন্মের প্রেয়সীকে অন্যের হতে দেখে যে যন্ত্রনা উপভোগের দৃশ্য আছে তা অডিটরিয়ামের প্রতিটি দর্শকে কাঁদিয়েছে। এছাড়া রয়েছে দুই ভিন্ন স্বাদের গানের সমারোহ। কবিগান ঠিক কি তা বর্তমান প্রজন্মের কাছে নিখুদভাবে তুলে ধরতে সক্ষম। তাই সৃজিতের সকল সৃষ্ট সিনেমার মধ্যে এটা হয়তো শ্রেষ্ঠ সিনেমা। যা মানুষের গভীরে গিয়ে কড়া নেড়েছে।
ভিঞ্চি দা
একটি রমাঞ্চকতার মোড়কে আবৃত এই সিনেমা। এই সিনেমার মাধ্যমে প্রস্থেটিক মেকআপ বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়। এই মেকাপকের সাহায্যে বাহ্যিক মুখোশ তৈরি করে সেটিকে কিভাবে ঘৃন্যতম অপরাধ করার কাজে ব্যবহার করা যায় এই সিনেমার দ্বারা স্পষ্ট। অসাধারন পরিচালনা ও চিত্র্যনাট্যের মেলবন্ধনে সৃষ্ট এই সিনেমার দ্বারা সৃজিত মুক্ষার্জি নিজেকে আরও একবার সেরা প্রমান করেছেন।
the statesmen
বরাবরই সৃজিত মুক্ষার্জি অন্য স্বাদের সিনেমা পরিচালনায় বিশ্বাসী। আর সেই বিশ্বাসকে সে জয়ও করেছেন বারংবার। তিনি তার দক্ষ পরিচালনার ছাপ রাখেন প্রতিটি সিনেমায়, কিন্তু প্রতবারই ভিন্ন আঙ্গিকে। তার পরিচালিত একটি সিনেমা অপরটিকে ছাপিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে মত্ত থাকে। তিনি এই বাংলা চলচিত্ত্র জগতে প্রসংশিত পরিচালক। কিন্তু তিনি মাঝে বাংলা ছেড়ে পা বাড়িয়েছিলেন হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে। সেখানেও তার পরিচালনা সবাইকে এক প্রকার মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। তাই তার পরিচালনার ছোঁয়ায় যে কোন সিনেমা নতুন ভাবে প্রকাশিত তা বলার অবকাশ থাকে না।
তাহলে সৃজিত মুক্ষার্জির এই ৫টি দুর্দান্ত চলচ্চিত্রের মধ্যে কোনটি আপনার খুব কাছের। আর কোনটি সমন্ধে আপনার মতবাদ কি তাও আমাদের লিখে পাঠথান।যদি আপনি এখনও সবকটি সিনেমা না দেখে থাকেন তাহলে এখনই অব্যশই দেখে ফেলুন। নয়তো দারুণ কিছু মিস করবেন