পরিচিত এক সমাজতাত্ত্বিকের গলায় রীতিমতো উষ্মা ঠিকরে বেরোয় ফোনে, ‘আপনারা সাংবাদিকরা তো সবাই সন্ত্রাস নিযে ছেলেখেলা শুরু করে দিয়েছেন। বাংলা ভাষার সর্বনাশ করছেন। সমাজেরও।‘
বিনীতভাবে জানতে চাই, সন্ত্রাস নিযে ছেলেখেলাটা হল কোথায়?
ভদ্রলোকের যুক্তিতে আগুন ঠিকরোয়, ‘আপনারা সব বাংলা সংবাদমাধ্যম এখন সব কিছুতেই সন্ত্রাস জুড়ে দিচ্ছেন। ভোটের সন্ত্রাস, নির্বাচন পরবর্তী সন্ত্রাস, কোভিড সন্ত্রাস, এমনকি ব্যাটিং সন্ত্রাস, টিভি রেটিংযে সন্ত্রাস, পেনাল্টি বক্সে সন্ত্রাস,’ ঈষৎ থেমে ক্রোধ ছাপিয়ে জেগে ওঠে ব্যঙ্গ, ‘মশাই, এটাই আসলে ভাষা সন্ত্রাস। সন্ত্রাস কি এত সহজ, এত সরল? আসল সন্ত্রাস সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই আপনাদের। আফগানিস্তানের সঙ্গে ইথিওপিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, সুদান, সোমালিয়া, প্যালেস্টাইন, ইউক্রেন, বেলারুশে কী হচ্ছে, খোঁজ নিন।‘
৯/১১-র কুড়ি বছর পূর্তির আগের দিন, ফোন রেখে পৃথিবীর সাম্প্রতিকতম মানচিত্র কল্পনা করতে থাকি। পৃথিবীর ম্যাপ থেকে রক্তক্ষরণ ঘটতে থাকে নিঃশব্দে। মানচিত্র হয়ে যায় যুদ্ধের মানচিত্র। মনে ভাসে শিহরন জাগানো, স্তব্ধ করে দেওয়া ছবি সব। সন্ত্রাস য়দি বলতে হয়, তাহলে ওই ছবিগুলোই সন্ত্রাস। লিখতে লিখতেই ভাবি, পৃথিবীর কোনও না কোনও প্রান্তে এই মুহূর্তে হয়তো একদল মানুষ প্রাণভয়ে পালাচ্ছেন। জঙ্গলে, মরুভূমিতে, নদীতীরে। হঠাৎ একটা শব্দ। এবং লুটিয়ে পড়ল অনেকে।
ইয়েমেনে হাউথি বিদ্রোহী উপজাতির সঙ্গে মারাত্মক যুদ্ধ চলছে সরকারের। হাউথিদের পাশে ইরান। ওদিকে সৌদি আরব। দশ বছর ধরে ইরান-সৌদির ছায়াযুদ্ধের শেষ নেই। কোনও ছবিতে দেখি, গণকবর খোঁড়া চলছে। কোথাও গোটা দশ শিশু খেলছে ফেটে যাওয়া বোমার অংশ নিয়ে। যেন এক কবিতার লাইন, ‘বাতাসে বারুদ গন্ধ ভালোবাসে বালক/ পরিত্যক্ত ট্যাঙ্কে সে আর্মি আর্মি খেলবে।‘
ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলের পশ্চিমে সুদান, উত্তরে এরিট্রিয়া। সেখানে তিন দেশের যে যুদ্ধ গত বছর শুরু হয়েছে, তা থামার লক্ষণ নেই। গুলিগোলা থামে না, থামে না নারী ও শিশুদের যন্ত্রণা। সেখানকার দুটো ছবি দেখে কবিতা ভাবতে ইচ্ছে করে, ‘ধ্বংসমাখা কবরখানায় বসে এক বৃদ্ধা/ দূরে নারী সৈন্যদের প্যারেড মুছে দিচ্ছে লাবণ্য নামক শব্দটি।‘
এত যুদ্ধের কথা, এত সন্ত্রাসের কথা, এত রক্তপাতের কথা লিখতে ভালো লাগে কার? পাঠকও কিছুক্ষণ পড়ার পর অনেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারেন। এই পোড়া পৃথিবীতে কোনও গুপী গাইন বাঘা বাইনও নেই যে যুদ্ধবিরোধী গান গাইবে ‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?’ সম্মোহিত হয়ে শান্তির মোডে চলে যাবে পৃথিবী। বাহান্ন বছর হয়ে গেল ছবিটার, গুপী-বাঘাও যে বৃদ্ধ হয়েছেন!
এমনিতে যে কোনও ম্যাপ দেখতে ভালো লাগে খুব। সে বইযে পাতাই হোক, হোক নেটে। বা দোকান থেকে কিনে আনা গ্লোব। সেটা ঘোরালেই অধিকাংশ জায়গায় লাল দাগ। রক্তমাখা গ্লোব দেখে একটা সিদ্ধান্তে চটজলদি আসাই য়ায়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা বিন লাদেন মুছে গেলেও মুছবে না সন্ত্রাসের ছায়াছবি।
দিন দুই আগে কাবুলে ফোনে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের পরিচিত আন্তর্জাতিক ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ মৃদুলকান্তি বিশ্বাসের সঙ্গে। ভদ্রলোক সাহস করে সেখানে রযে গিয়েছেন হোটেলে। দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেননি। আফগান সরকারের গ্রামীণ ও নারী উন্নয়ন দপ্তরের উন্নয়নে পরামর্শদাতা। এখন কী অবস্থা? মৃদুলের ঘরে দুবার তিন তালিবান নেতা দেখা করতে এসেছিলেন অন্তত চল্লিশ অনুগামীকে নিয়ে। স্বাভাবিক গলায় শোনালেন, ‘হোটেল থেকে আমার অফিস দেড় কিলোমিটার। কাবুলের রাস্তায় লোক কম, কিন্তু খুব স্বাভাবিক। গুলিগোলা নেই। যে নেতারা এসেছিলেন, তাঁদের একজন মন্ত্রী হয়েছেন পরে। তাঁরা কিন্তু আন্তরিকভাবেই পরামর্শ চাইলেন। নেতারা একজনই কথা বলছিলেন। বাকিরা শ্রোতা। এখানে কৌতূহল, মহিলা উন্নয়ন দপ্তরে আগের মতো মহিলা মন্ত্রী থাকবেন কি না।‘ তালিবান তাঁকে চিঠি লিখে দিতে রাজি, য়াতে কেউ বিরক্ত না করে পথে। এমনও তথ্য দিলেন, ‘হোটেলে আগের মতোই মেয়েরা ঘরদোর পরিচ্ছন্ন করছে। হোটেলে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে অনেক আফগান রয়েছেন। দেশ ছাড়ার অপেক্ষায়। তালিবান ওদের কিছু বলেনি।‘
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার সময় ভদ্রলোকের বয়স ছিল এগারো। ওই যুদ্ধের পরিবেশ চোখে লেগে আজও। দুটো পরিবেশের সঙ্গে ফারাক কোথায় দেখছেন? মৃদুলের বিশ্লেষণ, ‘আকাশপাতাল ফারাক। কোনও তুলনাই হয় না। সেখানে একটা দেশের জন্য লড়াই করছিল মানুষ। কত আবেগ সেখানে। এখানে তো সবাই দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তা ছাড়া এখানে দেশ নয়, ধর্মই বড় ব্যাপার হয়ে উঠেছে।‘
ধর্ম, জঙ্গিয়ানা, রাজনীতি এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। বিশ্বে সব ঝামেলার সূত্রেই আপাতত চারটি অঙ্ক। আফগানিস্তানে যেমন তালিবান চায়নি মন্ত্রীসভায় হাক্কানিরা থাকুক। যে কোনও মুহূর্তে ঝামেলা অনিবার্য। নাইজিরিয়ায় বোকো হারাম গোষ্ঠীর নাম পৃথিবী প্রথম শোনে ২০০৯ সালে। মানুষ মারার বিচারে বোকো হারাম শুনি আল-কায়দা, আইএস, তালিবানদের থেকেও হিংস্র। নাইজিরিয়ান সরকারের সঙ্গে ক্যামেরুন, চাদ, নাইজার, বেনিনের মতো দেশ হাত মিলিয়েছে। তবু বোকো হারামদের বোকা বানানো য়াচ্ছে কই? তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আইএস, তালিবান, আল-কায়দার নানা গোষ্ঠী। নাইজিরিয়া ও চার দেশের কিছু জঙ্গি সংগঠন রয়েছে, একবার তো আমেরিকাও সৈন্য পাঠাল ক্যামেরুনে। তাতে লাভ হয়নি।
আফ্রিকার মাটি রক্তাক্ত হয়ে চলেছে কঙ্গোতেও। সেখানে দুটো এথনিক গোষ্ঠীর সংঘর্ষ চলছে ১৯৭২ সাল থেকে। আলজিরিয়ায় আবার মাহগ্রেব অঞ্চলে গৃহযুদ্ধে জড়িযে গিযেে আল-কায়দা, বোকো হারামের নাম। সেখানে আলজিরিয়ার পক্ষে কত দেশ দেখুন- তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মালি, নাইজার, চাদ, মরক্কো, মরিটানিয়া এমনকি ফ্রান্স। তবু জঙ্গিরা অকুতোভয়। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধও যেমন কল্পনার বাইরে। দক্ষিণ সুদান, গিনি, লিবিয়া এবং মালি- কত শৈশব মুছে গিয়েছে গৃহযুদ্ধে।
এশিয়ায় ফিরে এলে, ইরাক, সিরিয়া- গৃহযুদ্ধের সন্ত্রাসে প্রায় প্রতিদিনই আকাশে ধোঁয়া ও আবহে বোমার শব্দ। ইরাকে আইসিলের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে ২০১৭ থেকে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দশ বছর হল থামছে না। আমেরিকা, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান যেভাবে দুটো পক্ষের সঙ্গে জড়িযে গিয়েছে, তা কল্পনার অবিশ্বাস্য। প্রশ্ন উঠবে, ৯/১১-র কুড়ি বছর পরেও আমাদের কোনও হুঁশ ফিরল না?
মায়ানমারের গল্প সবাই জানেন। আজেরবাইজান-আর্তশাকের সঙ্গে ঝামেলা থেমেও থামছে না। আজেরবাইজানের দিকে একবার দেখা গেল তুরস্ককে, একবার রাশিয়াকে। উলটো দিকে আর্মেনিয়া কোমর বেঁধে নেমেছে আজেরবাইজানের বিরুদ্ধে। ১৮ বছর ধরে যুদ্ধ চলছে সুদানে। সুদানকে সমর্থন করছে রাশিয়া, চিন, বেলারুশ। সুদান বিপ্লবী ফোর্সের দিকে দক্ষিণ সুদানের সঙ্গে মাঝে মাঝে হাত মেলায় উগান্ডা, লিবিয়া, চাদ। মেক্সিকান ড্রাগ ওয়ার চলছে তো চলছেই। গত দুবছরে মৃতের হিসেব ৪৩ হাজার। বেলারুশে চার বছরের যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে ২৬ হাজার প্রাণ।
বিশ্বজুড়ে খুচখাচ সংঘর্ষ ধরলে সে সব বহু পুরোনো। আমাদের কাশ্মীর রয়েছে। পাকিস্তানে খাইবার পাখতুন। রাশিয়া বনাম ইউক্রেন। ইরান বনাম কুর্দিশ, কোরিয়া বনাম উত্তর কোরিয়া। দেশ ধরলে প্যারাগুয়ে, পেরু, তিউনিসিয়া, সেনেগল… আরও হয়তো বাকি থেকে গেল। ৯/১১ চোখের সামনে দেখে ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ, যুদ্ধের জন্য বিতষ্ণা মানুষের জাগেইনি বোঝা যাচ্ছে। নেতারাই সেই বিতৃষ্ণা জাগতে দেন না। মিশিয়ে দেন ধর্ম।
ভাবনার রেলগাড়িটা বাংলায় ফিরিয়ে আনলে ওই নেতাদের কথা মাথায় ঘোরে। তাদের ভাইয়েরাই য়াবতীয় উত্তেজনার ছবি তৈরি করেন দিনহাটা, গিতালদহ থেকে মেদিনীপুর, বীরভূমে। ত্রাসে তাদের আনন্দ, সন্ত্রাসেও। এ সবে দাদারা প্রশ্রয়ই দেন। চটজলদি প্রচারের বিশ্বে ৯/১১ এই দাদা-ভাইদের কাছে অনেক দূরের গ্রহ। সত্যজিতের ‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল’ তাঁরা ভুলে গিয়েছেন।
৯/১১-র সময় ভারতের ছবিটা কেমন ছিল? অফিসে খরচ কমাতে একটা ডেস্কটপেই থাকত ইন্টারনেট। অরকুট, রিডিফ মেল, ইয়াহু মেল ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কাগজের অফিসের একমাত্র নেট ডেস্কটপ পড়েই থাকত ফাঁকা। পিছনের দরজার কোণে, অনাদরে। সেখানে বসে, সে আমলের সবচেয়ে সক্রিয় ও.য়েসাইট রিডিফ ডট কম দেখতে দেখতেই এক সাংবাদিক চিৎকার করে উঠেছিল, ‘দ্যাখো, দ্যাখো, প্লেন কীভাবে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার।‘ চিৎকার শুনে ছুটে এসে বিবিসি টিভি চালিয়ে সবাই দেখল, হাড়-হিম করা দৃশ্য।
কুড়ি বছরে অরকুট, রিডিফ মেল, ইয়াহু মেলের ধরিত্রী পালটে গিয়েছে অনেক। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই পালটাতে পারেনি। সব দেশ, সব গ্রাম একাকার সন্ত্রাসের প্রশ্নে, রক্ত মেখেটেখে।
সন্ত্রাসের একটাই রং- লাল। যা একদা শুধু বিপ্লবের রং ছিল। সন্ত্রাস, সন্ত্রাস, সন্ত্রাস- আর কি কোনও শব্দ নেই, হে পৃথিবী তোমার? খোঁজো, তুমি খুঁজতে থাকো চরাচরে।