পশ্চিমবঙ্গের ভোট পর্ব এবার সমাপ্তির দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। ২২ এপ্রিল ষষ্ঠ দফার নির্বাচন। এই দিন উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, উত্তর দিনাজপুর এবং পূর্ব বর্ধমান জেলা মিলিয়ে ভোট হবে। বাকি সমস্ত দফার মতো এই দফাতেও কতগুলি আকর্ষণীয় কেন্দ্র আছে। বিশেষ করে এবারে যে অঞ্চলে ভোট হচ্ছে তার একাংশকে বিজেপির অধুনা ঘাঁটি বলা গেলেও বেশিরভাগ কেন্দ্রে যুযুধান তিন পক্ষের মধ্যে তুল্যমূল্য লড়াই চলছে। তাই ষষ্ঠ দফার ভোটে কারা এগিয়ে কারা পিছিয়ে সেটা বলাটা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। তাই আমরা সেই বিচারের না গিয়ে ষষ্ঠ দফার নির্বাচনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছ’টি কেন্দ্রের দিকে নজর রাখব।
১) চাকুলিয়া-
উত্তর দিনাজপুরের একেবারে বিহার সীমান্তঘেঁষা কেন্দ্র চাকুলিয়া। দীর্ঘদিন ধরে বামফ্রন্টের শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের দখলে এই কেন্দ্রটি। বলা যেতে পারে পরিবর্তনের জানাতেও সিংহ শিবির এই কেন্দ্রটি নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক তরুণ প্রজন্মের ইমরান আলি রমজকে প্রার্থী করেছে ফরওয়ার্ড ব্লক। ইমরান অবশ্য স্থানীয় মানুষজনের কাছে ভিক্টর নামে সুপরিচিত। বিধানসভাতেও তার বাগ্মিতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। তৃণমূল সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর বিধানসভার ভেতরে দাঁড়িয়ে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চোখা চোখা প্রশ্নে বিদ্ধ করতে ছাড়েননি এই তরুণ বিধায়ক।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটিতে এগিয়ে গিয়েছিল তৃণমূল। তবে বিধানসভার লড়াই যে সম্পূর্ণ অন্য তা চাকুলিয়া সাধারণ মানুষজনই বলছেন। এই কারণেই কেন্দ্রটির নজর কেড়ে নিয়েছে রাজনৈতিক মহলের। সবাই গভীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে এই তরুণ বিধায়ক নিজের গড় ধরে রাখতে পারেন কিনা। তাকে হারাতে অমিত শাহ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই সভা করেছেন চাকুলিয়াতে। এখানে তৃণমূল প্রার্থী করেছে মিনহাজুল আফরিন আজাদকে। অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থী করেছে শচীন প্রসাদকে। চাকুলিয়া দখলে আনার জন্য বিজেপি সরাসরি ধর্মীয় মেরুকরণের উপর আস্থা রাখছে।
২) কৃষ্ণনগর উত্তর-
একুশের নির্বাচনী লড়াইয়ে অন্যতম হাইভোল্টেজ কেন্দ্র নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রটি। এখানে মুখোমুখি লড়াই হচ্ছে তৃণমূল প্রার্থী তরুণ প্রজন্মের টলিউড অভিনেত্রী কৌশানী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্য বিজেপির চাণক্য হিসেবে পরিচিত মুকুল রায়ের।
২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে অবনী জোয়ারদার কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে জয়লাভ করেন। কিন্তু ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে দেখা যায় এখানকার মানুষের মন সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়েছে। বিজেপির থেকে এই কেন্দ্রে তৃণমূল ৫০ হাজারেরও বেশি ভোটে পিছিয়ে পড়ে। বলা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে নিরাপদ কেন্দ্রগুলির একটি হল কৃষ্ণনগর উত্তর। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে দীর্ঘদিন পর আবার ময়দানি রাজনীতির ভোট যুদ্ধে সামিল হয়েছেন মুকুল রায়। এই কেন্দ্রে তিনি যে অনেকটাই অ্যাডভান্টেজ অবস্থায় থেকে লড়াই শুরু করেছেন তা এক বাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছে সকলে। যদিও তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী সিলভি সাহা এই কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে মূল লড়াইয়ের ট্যাগ লাইন হল মুকুল বনাম কৌশানি।
৩) হাবরা-
উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অন্যতম হাই ভোল্টেজ কেন্দ্র হাবরা। এই কেন্দ্রে যুযুধান দুই শিবিরের দুই প্রার্থী রাজ্য রাজনীতির হেভিওয়েট। তৃণমূলের পক্ষ থেকে এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন গত দু’বারে জেতা বিধায়ক তথা রাজ্যের বিদায়ী খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থী করেছে তাদের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহাকে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রায় ২০ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিল বিজেপি।
এমনিতেই উত্তর চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোম তুঙ্গে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে উপর থেকে রাহুল সিনহার জয় সুনিশ্চিত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তার বিপক্ষে চলে যাচ্ছে হারের রেকর্ড। তার মত এত বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এর আগে কেউ বোধহয় হারেননি। স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছেন তিনি এবারেও জিতে দেখিয়ে দেবেন। তবে তৃণমূল এবং বিজেপির কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষ প্রবল ক্ষুব্ধ। তাদের আশ্রয় হতে পারেন সিপিআই(এম) প্রার্থী রিজি নন্দন বিশ্বাস। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে লড়াই শুরু করলেও তিনিও বেশ ভালোমতোই প্রতিযোগিতায় টিকে আছেন।
৪) ব্যারাকপুর-
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুর কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে অর্জুন সিং এর জয়লাভের পর ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল বিজেপির একরকম গড়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ব্যারাকপুর বিধানসভা কেন্দ্রে অ্যাডভান্টেজ অবস্থাতেই তারা লড়াই শুরু করেছে। এখানে বিজেপি প্রার্থী করেছে প্রয়াত মণীষ শুক্লার বাবা চন্দ্রমণি শুক্লাকে। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হচ্ছে মণীষ শুক্লার মৃত্যুর ঘটনায় সহানুভূতির ভোট বিজেপি নিজেদের ঝুলিতে নিয়ে আসতে পারবে।
তৃণমূল অবশ্য ব্যারাকপুর দখলে রাখতে একজন তারকাকে প্রার্থী করেছে। টলিউড পরিচালক রাজ চক্রবর্তী জোড়া ফুল প্রতীকে এই কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। স্বাভাবিকভাবেই রাজের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তৃণমূলের ভরসার অন্যতম জায়গা। সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে সিপিআই(এম) এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে পরিচিত মুখ দেবাশীষ ভৌমিককে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুরের বাম সমর্থকদের ভোট বিজেপিতে চলে গিয়েছিল। সেটা যদি বামেরা পুনরুদ্ধার করতে পারে তাহলে এখানকার ফলাফল যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মতো হওয়া সম্ভব।
৫) দমদম উত্তর-
২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে অভাবনীয়ভাবে দমদম উত্তর কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্যর কাছে হেরে গিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। এবারে সিপিআই(এম) যেমন সেই তন্ময় ভট্টাচার্যকে প্রার্থী করেছে তেমনি তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন চন্দ্রিমা দেবী। স্বাভাবিকভাবেই দমদম উত্তরের লড়াই জমজমাট।
তন্ময় ভট্টাচার্যর ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন। তিনি এলাকায় দাপুটে নেতা হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত। তাই তার সঙ্গে মহিলা তৃণমূলের পরিচিত মুখ চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যর লড়াই যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিজেপি এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে অর্চনা মজুমদারকে। তিনিও যথেষ্ট পরিচিত মুখ। যদিও এই কেন্দ্রে মূল লড়াই সিপিআই(এম) বনাম তৃণমূল।
৬) বিজপুর-
উত্তর চব্বিশ পরগনার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের আরেকটি বিধানসভা কেন্দ্র হল বিজপুর। এই কেন্দ্রে কোনও হেভিওয়েট প্রার্থী নেই। তবু রাজ্য রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত কেন্দ্র এটি। কারণ এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী শুভ্রাংশু রায় সম্পর্কে মুকুল রায়ের ছেলে। বলা যেতে পারে বাবার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা শুভ্রাংশুর জয়-পরাজয়ের সঙ্গে মুকুল রায়ের ব্যক্তিগত মান-সম্মান জড়িয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই এই কেন্দ্রটি ষষ্ঠ দফার নির্বাচনে যথেষ্ট আকর্ষণ কেড়ে নিচ্ছে।
শুভ্রাংশু রায় ২০১৬ এর নির্বাচনে তৃণমূলের প্রতীকে জয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মুকুল রায় দল ছেড়ে বিজেপিতে গেলেও তিনি তৃণমূলেই ছিলেন। কিন্তু এক সময় বাবার পথ অনুসরণ করেন কাঁচরাপাড়ার রায় পরিবারের ছেলে। স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূল বীজপুরে শুভ্রাংশুকে হারিয়ে মুকুলকে বিশেষ বার্তা দিতে চাইছে। এই কেন্দ্রে তারা প্রার্থী করেছে সুবোধ অধিকারীকে। সংযুক্ত মোর্চার পক্ষ থেকে সিপিআই(এম) এখানে প্রার্থী করেছে সুকান্ত রক্ষিতকে। বলা যেতে পারে এই ভোটে বিজপুরের লড়াই সম্পূর্ণভাবে ত্রিমুখী।