প্রেম পৃথিবীতে একবার মাত্র রূপ গ্রহণ করিয়াছিল , তাহা বাঙ্গালাদেশে।
দীনেশচন্দ্র সেন
শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর জন্ম :
শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর আগমন বাংলায় তথা বিশ্বে প্রভাব ফেলেছিল এক গভীর আলোড়ন। তিনি প্রেম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মানুষের মধ্যে।চৈতন্যের আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতির চরম দুর্দিনে চৈতন্যচন্দ্রোদয় ঘটেছিল – যা বাঙালির জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর আবির্ভাব ষোড়শ শতকে বাংলায় নিয়ে এলো এক নবজাগরণ।শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে ১৮ ই ফেব্রুয়ারী ফাল্গন মাসে দোল পূর্ণিমায় নদীয়া জেলার নবদ্বীপধামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র ও মাতা শচীদেবী। তাঁর দাদা বিশ্বরূপ ১২ বছর বয়সেই গৃহ ত্যাগ করে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু -র নাম ছিল বিশ্বম্ভর ও তাঁর ডাক নাম নিমাই।
শৈশব ও বিবাহ :
আজানুলম্বিত বাহু ,উজ্জ্বলবর্ণ শ্রীচৈতন্য শৈশব থেকেই ছিলেন মেধাবী ও চঞ্চল। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু নবদ্বীপে গঙ্গাদাস পন্ডিতের কাছে অধ্যয়ণ করে পণ্ডিত হন। এমনকি মাত্র ২০ বছর বয়েসে তিনি নবদ্বীপে টোল স্থাপন করেন। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠ এবং জ্ঞানার্জন করা। পরবর্তী কালে তাঁর সাথে লক্ষীপ্রিয়ার বিবাহ হয়। বিবাহের কিছু দিন পরে তিনি পূর্ববঙ্গে ভ্রমণের জন্য যান আর সেই সময় সর্পদংশে তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনায় শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ভীষণভাবে মর্মাহত হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর স্ত্রী কে ভীষণ ভাবে ভালোবাসতেন। নিমাইয়ের এই অবস্থা দেখে তাঁর মা শচীদেবী তাকে পুনর্বার বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব দেয়। আপত্তি সত্ত্বেও তিনি মায়ের প্রস্তাবকে খন্ডাতে পারেননি। মায়ের পীড়াপীড়িতে তাঁর সাথে দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় বিষ্ণুপ্রিয়ার।
দীক্ষাগ্রহন ও হরিনাম প্রচার :
শ্রীচৈতন্যদেব দ্বিতীয় বিবাহের পর তাঁর পিতার পিন্ডদান করতে যায় গয়াতে। সেখানে গিয়ে বিরহকাতর চৈতন্যদেবের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে ঈশ্বরপুরীর। সেখানেই তাঁর শুরু হয় নতুন জীবনের। ঈশ্বরপুরীর নিকট তিনি শ্রীশ্রীগোপাল অস্টাদশক্ষর মহামন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই ঘটনায় শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনে এক গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর তিনি হয়ে উঠলেন ভক্তিমার্গের মানুষ। কৃষ্ণভাবময় ভক্ত রূপে বৈষ্ণব তথা গোটা সমাজ তাঁকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
হিন্দুধর্মের সমস্ত জাতিভেদকে উপেক্ষা করে তিনি নিম্নবর্ণের মানুষদের বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন।হরিনাম প্রচার -ই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। তাঁর প্রভাবে জগাই মাধাই অত্যাচার ছেড়ে দিয়ে হলেন হরিভক্ত। তাঁর প্রভাবে যবন হরিদাস সনাতন ধর্ম ও বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেন।ভগবৎ প্রেমে পাগল হয়ে শ্রীচৈতন্যদেব গোটা নবদ্বীপকে কৃষ্ণ নামে মাতোয়ারা করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাস। তাঁর সহচরেরা তাঁকেই আরাধ্য অবতাররূপে সাধনার লক্ষ্য রূপে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।তিনি হরিনাম প্রচার করলেন-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে
সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ :
এরপর মাত্র ২৪ বছর বয়েসে কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করে নিমাই হলেন’ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত হয়ে সব মায়া ত্যাগ করে তিনি পুরীতে চলে গেলেন সেখান থেকে তিনি তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন।প্রথবার তিনি মহারাষ্ট্র,দাক্ষিণাত্য,ও গুজরাট ভ্রমণ করে বৃন্দাবনে যান। বৃন্দাবন থেকে তিনি রামকেলি ,গৌড়,শান্তিপুর হয়ে ফিরে আসেন।
এই তীর্থ পর্যটনের ফলে ভারতবর্ষের বৃহত্তর জনজীবনের সাথে পরিচয় তাঁর পরিচয় ঘটল এবং বাঙালিকে জীবনকে তাঁর প্রেমধারার মধ্যে দিয়ে অনুপ্রাণিত করে তুলল। জীবনের শেষ ১৮ বছর তিনি পুরীতে জগন্নাথ ধামে অতিবাহিত করার পর ৪৮ বছর বয়েসে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ শে জুন তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। তবে তাঁর প্রয়াণ রহস্যাবৃত। তাঁর জীবনাবসানকে নিয়ে নানা জনের নানারকম মত।
সমাজে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব :
ষোড়শ শতাব্দীতে তিনি যে নতুন যুগের উন্মোচন করলেন সেইসময় বাংলায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি তেমন ভালো ছিল না।এই শতাব্দীতেই পাঠান আমলের চুড়ান্ত বিকাশ , অবক্ষয় এবং মোঘল শাসনের প্রতিষ্ঠা হলো। এই সময় বাঙালির স্বাতন্ত্র্রের বিকাশ ঘটল। সামন্ততন্ত্রের শক্তিক্ষয় এবং মুঘল সম্প্রদায়ের আগ্রাসী শাসননীতি চলতে থাকে। ফলত দেশ প্রচন্ডভাবে শাসন ও শোষণের সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে সামাজিক অবস্থা ছিল বিপন্ন। জাতিতে জাতিতে ছিল হিংসা, হিন্দু মুসলমানের বিরোধ , ধর্মান্তরিতকরণ , ভূস্বামীদের প্রভাব প্রভৃতির মধ্যে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব হয়েছিল ।
এই কারণেই মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও জীবনকে শ্রীচৈতন্যদেব প্রেম ও আধ্যাত্মলোকের আলোকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্রত্যেক মানুষদের দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ মর্যাদা এবং মনুষ্য জাতিকে প্রেমধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন।প্রচার করলেন – জন্ম বড় কথা নয় , কর্মই বড়। তিনি শিক্ষাষ্টক নামে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। জাতিভেদ ভুলে , উচ্চ- নিম্ন ভেদাভেদ ভুলে তিনি জাতিকে শিখিয়েছেন আলিঙ্গন করতে। তাঁর জীবনই বাংলার সমাজে বিরাট প্রভাব ফেলছিল।
অবতারত্ব :
গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু এক দেহে কৃষ্ণ ও রাধার যুগল মিলন রূপে এই ধরাতে আবির্ভূত।