শীতের কাঁথা ভারতের প্রাচীনতম শিল্প, যা আজও দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ মহিলা অনুসরণ করছেন। বিশেষত বাঙালির জীবনে কথার গুরুত্ব অপরিসীম। এই শিল্পের উৎপত্তি হয়েছিল খুবই সহজ ও সরল ভাবে। গ্রামবাংলায় জন্ম নেয়া এই শিল্পটি উনিশ শতকের শুরুর দিকে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল, পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পর কাঁথা শিল্প একটি মূল্যবান ও চাহিদাসম্পন্ন শিল্প মাধ্যম হিসেবে নবজন্ম লাভ করে।বাংলায় দীর্ঘসময় ধরে চলে বর্ষাকাল। যখন গ্রামের দিকে মাঠ ঘাট থৈ থৈ বর্ষায়, নারীরা তখন সন্ধে তে একটুখানি অবসরের সন্ধান পায় তারা। বাঙালী নারীদের এই অবসর সময়ে পান আর সুপারির আড্ডায় সুঁই সুতো হাতে কাঁথা সেলাই এক চিরাচরিত অভ্যাস।

শীতের কাঁথা
উইকিমিডিয়া কমন্স

যাইহোক, আমরা বাঙালিরা শীত পরলেই মোটামুটি আলমারি থেকে কাঁথা বের করতে থাকি।বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি, সাথে বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া- এ সময়ে বাঙালীর ঘুমোতে যাওয়ার আগে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটির কথা মনে পড়ে থাকে সেটি হল কাঁথা। সে যেমনি কাঁথা হোক না কেন, হতে পারে বাহারি নকশাদার কিংবা নকশা ছাড়াই। কাঁথা বাংলার লোকসংস্কৃতি আর গ্রামীণ কুটির শিল্পের একটি বড় জায়গা দখল করে আছে ।

বাংলার আবেগ কাঁথা :

সংস্কৃত শব্দ ‘কন্থা’ থেকে উদ্ভুত কাঁথা শব্দের অর্থ জীর্ণবস্ত্র রচিত আস্তরণ বা শীতবস্ত্র বিশেষ।আমাদের বাংলায় বাড়িতে সন্তান জন্ম নেওয়ার সময়ে তার জন্য নতুন কাঁথা তৈরির রেওয়াজ এখনও বেশ কিছু পরিবারে টিকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এমনকি বাড়িতে বিয়ে কিংবা পার্বণের মতো সামাজিক ও অতিথিদের নতুন কাঁথা দিয়ে বরণ করার রেওয়াজ ও দেখা যায় এই বাংলায়। বিয়ের পরে মেয়েকে শ্বশুরালয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় উপহারের তালিকায় অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল নকশী কাঁথা। সেই কাঁথা বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে।তবে এখনো অনেক গল্পে গ্রামীণ নারীরা দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নকশী কাঁথার কাজ করে যান। সেই নকশি কাঁথা বিক্রি করে তাদের সংসার চালায়। নিপুন দক্ষতায় কাঁথার জমিতে ফুটে উঠে গাছ, পাখি কিংবা লতাপাতার ছবি কিংবা কোন মানুষ । কোনোসময় কাঁথায় উঠে এসেছে দুঃখ আর সুখের কাহিনী, আবার কখনো লন্ঠনের নিয়ন আলোয় শোনা পুঁথির গল্পই সূচ দিয়ে কাঁথায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

image

মূলত নকশা আঁকা কাঁথাগুলিকে নকশিকাঁথা বলা হলেও সেলাইয়ের প্রকারভেদের জন্য এই বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন— সুজনি কাঁথা, কদমফুল কাঁথা, ঝাড়ফুল কাঁথা,বিলাইপাউটি কাঁথা, আঙুর খোপা কাঁথা, গোলকধাঁধা কাঁথা, ব্লেড বর্ডার কাঁথা, রুটি কাঁথা, মুরাফাঁস কাঁথা,পাঙ্খা কাঁথা। একটি কাঁথায় আবার নানা ধরনের সেলাইয়ের মিশ্রণ থাকে— ভাল স্টিচ, চিকোন, চেন বা জিজির স্টিচ, টালিফাঁস মাছকাঁটা, যবশীষ, খেজুরপাতা, হেম, রান, ভরাট ইত্যাদি।

ASPVa1txAykAebgs Nakshi kantha ff
www.textiletoday.com.bd

কাঁথার প্রচলন মোটামুটি দুই বাংলা জুড়েই জনপ্রিয় ভাবে আছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনাসহ সারা বাংলার গ্রামে গঞ্জেই ছিটিয়ে আছে কাঁথা বানানোর সংস্কৃতি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহারেও দেখা যায় বৈচিত্রপূর্ণ কাঁথার সমাহার। খানিকটা ছিড়ে যাওয়া, পুরাতন হয়ে যাওয়া শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি কিংবা চাদরকেই সাধারণত কাঁথা বানানোতে কাজে লাগানো হয়, তবে কাঁথা বানাতে শাড়ির আছে আলাদা কদর। প্রথমে পুরাতন কাপড়কে ধুয়ে, এতে মাড় (ভাত রান্নার সময় অবশিষ্ট তরল) দেওয়া হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। পুরুত্বের দিক থেকে ক্ষেত্রবিশেষে একটি কাঁথায় তিনটি থেকে সাতটি শাড়িও ব্যবহার করা হয়।

শীতের কাঁথা তৈরি করতে সময় কত লাগে ?

সাধারণ নকশী কাঁথা অথবা খুব জটিল কাঁথা কি করতে সাধারণত এক মাসের বেশি সময় লাগে। দীর্ঘ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এতে কারুকার্য ফুটিয়ে তোলে বাংলার নারীরা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এটি একসময়ে বাংলার নারীদের অবসরের অনুষঙ্গ ছিল। তাই পূজা, পার্বণ কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে নারীরা এটা দিত । মাঝারি আকারের কাঁথা তৈরিতে সাত থেকে পনের দিন সময় লেগে যায়। বড় কাঁথা এবং জটিল নকশা করতে এক মাসেরও বেশি সময় লাগতে পারে। তাছাড়া, কোনো পুরাতন কাপড়কে জোড়া দিয়ে কাঁথা তৈরি করা যায় বলে মধ্যবিত্ত থেকে গরীব সবার কাছেই ছিল এর খুব কদর। মা কিংবা ঠাকুমার তৈরি নরম কাঁথায় শুয়ে শিশু মায়ের কোলের উষ্ণতা পায়। কিন্তু বর্তমানে কাঁথাকে দূরে ছুড়ে ফেলে শৈশবের বাজার দখল করেছে বিদেশি কায়দায় তৈরি করা রকমের ন্যাপি। দরিদ্র জনতার কথা বাদ দিলে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত— যাঁদেরই আর্থিক সামর্থ্য আছে, কেউ আর কাঁথা ব্যবহার করতে চাইছেন না । ন্যাপি ব্যবহারের ফলে মায়েদের বহু সুবিধে হয়েছে। বারবার কাঁথা পাল্টানো, কাচা, শুকোনোর ঝামেলা পোহাতে হয় না। তাই আস্তে আস্তে বাংলার ঐতিহ্য কাঁথা কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

HUAqzoXT4ULSVs6M alamy
alamy.com

আরো পড়ুন : https://www.banglakhabor.in/10-টি-নামী-ফোর-হুইলা্র/amp/?