২০২১-এর ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে প্রচার শুরু করেছে বিজেপি। হচ্ছে শক্তি প্রদর্শনের খেলা। দলবদল চলছে নিয়মিত। অমিত শাহ ঘনঘন বঙ্গ বিজেপির নেতাদের সঙ্গে দিল্লীতে বৈঠকে বসছেন। বাংলার কর্মীদের জন্য করছেন ভার্চুয়াল সভা।
এতকিছুর পরেও বঙ্গের গেরুয়া শিবিরে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। বামদের শেষ জমানার মতো ল্যাজে গোবরে দশায় ফেলতে পারছে না বাংলার শাসকদলকে। ভোটারদের মনেও কিছুটা হলেও পিছিয়ে থাকছে বঙ্গ বিজেপি। লোকসভা ভোটে এত ভালো ফলের পরেও সেই কারণে কিছুটা হলেও চিন্তায় থাকছে বাংলার গেরুয়া শিবির। এখানে বিজেপির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে এমন ৫ কারণ নিয়ে আলোচনা করলাম আমরা।
১। শক্তিশালী স্থানীয় মুখ নেই – ভারতের অন্যতম রাজনৈতিকভাবে স্বতন্ত্র রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। এখানকার নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত শক্তিশালী স্থানীয় মুখের প্রয়োজন হয়েছে। যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। দলের আপদে-বিপদে ঝাঁপাতে পারেন। শুধু মোদী হাওয়ায় ভর করে বাংলায় নির্বাচন জেতা যাবে না। জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বাংলায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মুখ ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। তাঁর একটা পৃথক সত্ত্বা ছিল। দলীয় হাইকমান্ডের উপর নির্ভরশীল না থেকে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন নিয়ে কাজ করেছিলেন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় – প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রীরই নিজস্ব জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু বিজেপিতে এমন কোনও মুখ এখনও পর্যন্ত নেই।
২। দিল্লীর নেতৃত্বের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা – মুকুল রায়-দিলীপ ঘোষরা থাকা সত্ত্বেও বাংলায় বিজেপির প্রচার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দিল্লী থেকে। কোনও বাংলার মুখ নয়, বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের সুর প্রথম বেঁধে দিলেন অমিত শাহ, তাঁর ভার্চুয়াল সমাবেশের মাধ্যমে। তারপর যুব মোর্চার ডাকে যদিও বা নবান্ন অভিযান হল, তার নেতৃত্বে ছিলেন বিজেপি যুব শাখার সর্বভারতীয় সভাপতি সংসদ সদস্য তেজস্বী সূর্য। আবার কংগ্রেসের পতনের পরে বাংলায় যখন বাম শাসন শুরু হয়, তখনও দেখা যায় বাম শরিকের প্রধান সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে পৃথক সত্ত্বা নিয়ে চলত। সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীন ছিল না বাংলা নেতৃত্ব। আর এখন ক্ষমতায় তৃণমূল। এটা তো পশ্চিমবঙ্গেরই দল। তাই বিজেপির দিল্লী-নির্ভরতা বাংলা কতটা মেনে নেবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
৩। গোষ্ঠীকোন্দল – মুকুল ও দিলীপ গোষ্ঠীতে বিভক্ত বঙ্গ বিজেপি। দুজনের মধ্যে যে নূন্যতম তালমিল নেই সেটা আর লুকনো যাচ্ছে না। তারওপর প্রতিদিন কোনও না কোনও জেলা থেকে গোষ্ঠীকোন্দলের খবর আসছে। আদি ও নব্য কর্মী-সদস্যে ভাগ হয়ে গেছে বিজেপি। রাহুল সিনহার মতো দীর্ঘকালের নেতা পদ না পেয়ে কার্যত মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। নবান্ন অভিযানে অংশ পর্যন্ত নেননি। এসব দ্রুত জোড়াতালি না দিতে পারলে আগামী ভোটে ভুগতে হতে পারে বিজেপিকে।
৪। সাম্প্রদায়িক তকমা – পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলা দখল করতে হলে মুসলিম ভোট পেতেই হবে। কিন্তু বিজেপির গায়েই সেঁটে গেছে মুসলিম-বিরোধী দলের তকমা। রামমন্দির আন্দোলন, ৩৭০ ধারা লোপ, তিন তালাকের মতো সিদ্ধান্তে স্পষ্টতই খুশি নয় মুসলিম সমাজ। বাংলাতেও তার প্রভাব পড়েছে। এসবের মোকাবিলায় সংখ্যালঘু সেল খুলেছে বিজেপি। ‘সবকা বিশ্বাস’ জয়ের কথা বলছেন মোদী। কিন্তু সেসব যথেষ্ট নয়। বাংলায় আবার আছে এনআরসি, সিএএ-র ভয়। সবমিলিয়ে বঙ্গে সংখ্যালঘুদের মন জয় করতে ব্যর্থ গেরুয়া শিবির।
৫। খাঁটি বাঙালি হয়ে উঠতে না পারা – গো-বলয়ের দল দল বিজেপি। একথাও প্রায়ই বলেন বিরোধীরা। আশ্চর্যজনক ভাবে এই অপবাদ ঘোচাতেও কিচ্ছুটি করেননি বিজেপির নেতারা। উল্টে বাংলা ভাষা নিয়ে অসংবেদনশীল মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে বিজেপি নেতা তরুণজ্যোতি তেওয়ারির বিরুদ্ধে। ট্রেডমার্ক ‘গো রক্ষা’র গেরুয়া রাজনীতিও এই অপবাদ পাওয়ার অন্যতম কারণ। যা কাটানো তো দূর-অস্ত। ‘উল্টে গরুর দুধে সোনা পাওয়া যায়’এর মতো বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন নেতারা।