সেই ছোটো থেকে ডিসনি ল্যান্ডের বেশিরভাগ গল্পেই আমরা রাজকুমার রাজকুমারীর গল্প দেখেছি।কিন্তু রাজকুমার ছাড়া শুধুই রাজকুমারীর গল্প বেশ কম।যাইহোক,লি জিকি হলেন বাস্তবের রাজকুমারী,যাঁর হাতে আছে জাদু।কি পারেন না তিনি! চীনের সিচুয়ান প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামীণ পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করেন তিনি।তিনি ভিডিও ব্লগার আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন ইন্টারনেট সেলিব্রিটি।
তিনি ভিডিওর মাধ্যমে মূলত খাদ্যপ্রস্তুত ও হস্তশিল্পের কাজ দেখিয়ে থাকেন।বর্তমানে তাঁর চ্যানেলটি ২.৩ কোটি মানুষ দেখেছেন এবং তাঁর সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা হলো ১৫.৭ লক্ষ(১১ই জুলাই,২০২১ অনুসারে)।তাঁর চ্যানেলটি চীনা ভাষায় সর্বাধিক সাবস্ক্রাইবড হওয়ায় এটি গিনেস বুকেও নাম তুলেছে।এক অতি সাধারণ জীবন কিভাবে এত মানুষের ভালোবাসা পেল সেই গল্পই আজ আলোচিত হবে। লি ১৯৯০ সালের ৬ই জুলাই চীনের সিচুয়ান প্রদেশে জন্মান।তাঁর আসল নাম লি জিয়াজিয়া। অতি অল্প বয়সেই তিনি অনাথ হন।গোল্ডথ্রেডের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান,তিনি তাঁর সৎমায়ের অত্যাচারের কারণে বাড়ি ছেড়ে তাঁর দাদু,দিদার গ্রামের বাড়িতে এসে বাস করা শুরু করেন।পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় আরেক বিপদ আসে তাঁর জীবনে।তাঁর দাদু মারা যান।তাঁর দিদিমা তাঁর স্কুলের ফিজ দিতে না পারায় ১৪ বছরের লি স্কুলের পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।কাজের খোঁজে তিনি শহরে যান।সেখানে কখনো ওয়েট্রেস হিসাবে,কখনো গায়িকা হিসাবে,আবার কখনও কখনও মিউজিক ডিজে হিসাবেও কাজ করেন।২০১২ সাল নাগাদ তাঁর দিদিমা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি কাজ ছেড়ে ফের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন।প্রথমদিকে সংসার চালানোর জন্য তিনি কৃষি সামগ্রী বিক্রি শুরু করেন।
২০১৫ সালে লি চীনা প্ল্যাটফর্ম *মেইপাইতে* তাঁর ভিডিও পোস্ট করা শুরু করেন।শুরুর দিকে তিনি নিজেই তাঁর ভিডিও শুট করতেন।তাঁর কথায়,এইভাবে ভিডিও আপলোড করায় অনেকসময় তা তাঁর শিল্পীসত্তাকে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে পারতোনা।২০১৬ সালে তাঁর “বাড়িতে তৈরি পীচ ওয়াইন” শীর্ষক ভিডিওটি ওই প্ল্যাটফর্মের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের নজরে পড়ে,তিনি ওই ভিডিওটি ওই প্ল্যাটফর্মের ফ্রন্টপেজে রাখেন।এর ফলে লি এর ফলোয়ার্স সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়।২০১৭ সালে লি *ইউটিউবে* তার প্রথম ভিডিও পোস্ট করে – ” আঙ্গুরের খোসা থেকে জামা বানানো “। সেই শুরু, ২০২০ এর জুন মাসে তাঁর ইউটিউব ফলোয়ার্স ছিল ১১.৭ লক্ষ।প্রথম প্রথম তিনি একাই তাঁর ভিডিও এডিটিংয়ের কাজ করলেও বর্তমানে তাঁর তিন সদস্যের একটি টিম আছে যা তাঁকে ভিডিও ও এডিটিংয়ের কাজে সাহায্য করে। তাঁর মূল দর্শক হলেন শহরে বসবাস করা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মানুষরা।জনপ্রিয়তা বাড়ার আরেকটি কারণ হলো ‘ফুগু’ নামক এক সংস্থা,যা প্রাচীন চীনা সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেয়।যাইহোক,লি গোল্ডথ্রেডে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার ভিডিও বানানোর লক্ষ্য হিসাবে জানায়, যে,”আমি শহুরে মানুষদের জানাতে চাই যে খাবার কোথা থেকে আসে”। লি এর বেশিরভাগ ভিডিওই তৈরি হয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন খাবার এবং পুরানো আমলের জিনিস তৈরির উপর।খাদ্য এবং অন্যান্য জিনিস তৈরির ভিডিও ছাড়াও লি মেকআপ সরঞ্জাম তৈরি এবং বিভিন্ন সুন্দর প্রাচীন সেলাই দ্বারা তৈরি সুন্দর সুন্দর জামা তৈরীতেও সক্ষম।এছাড়া লি সুন্দর গান গাইতে ও বাজনা বাজাতেও পারদর্শী।কখনো কখনো আবার ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে বেড়াতেও দেখা যায় তাঁকে। এ ছাড়া কোদাল হাতে মাটি খুঁড়ে চাষবাস করেন,বাঁশ নিজে হাতে কেটে এনে তা দিয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সোফা বানান,নিজেই তুলো চাষ করে সেই তুলো দিয়ে ঠাকুমার জন্য কম্বল বানিয়ে দেন,বাড়তি তুলো দিয়ে পোষা বিড়ালের জন্য ও কম্বল বানাতে ভোলেন না।এক কথায়,তিনি প্রায় সবদিকেই পারদর্শী।লি তাঁর ভিডিওতে খুব কম কথা বলে।ভিডিওতে বেশিরভাগ সময়ই শোনা যায়,প্রকৃতির আওয়াজ,রান্নার আওয়াজ এবং শান্ত সুন্দর মিউজিক।এ ছাড়া থাকে লি এবং তার ঠাকুমার একে অপরের সঙ্গে ভালোবাসামাখা সামান্য কথাবার্তা।
এগুলো শুনতে শুনতে এবং লি এর অপরিসীম পরিশ্রম দেখতে দেখতে কখন যে অনেক ভিডিও দেখা হয়ে যায় খেয়ালই থাকেনা কারোর। ২০১৮ সালে লি নিজের নামে একটি ফুড ব্র্যান্ড তৈরি করে এবং সেখানে ই-কমার্সের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে।২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র *পিপলস ডেইলি* থেকে *পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড* দেওয়া হয়।২০২০ সালের আগস্টে তিনি *অল-চায়না ইয়ুথ ফেডারেশনের* সদস্য হিসাবে মনোনীত হন।এছাড়াও *চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন* তাঁর ভুয়সী প্রশংসা করে।পণ্ডিতরা যদিও তাঁর এই চ্যানেলটিকে চাইনিজ সরকারের সফট পাওয়ার হিসাবে দেখেন।লি এর ভিডিওগুলি চীনে ধীরে ধীরে গ্রামীণজীবন ছড়িয়ে দেবে বলে সমালোচকদের ধারণা।
পরিশেষে লি-এর মিউজিক ভিডিওর শেষে চীনা ভাষার সঙ্গে ইংরেজিতে দেওয়া কটা লাইনেই তাঁর ভিডিও বানানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ পায় – “Therefore,even the most ordinary life will grow toward the sun.There is no one in this world that is worth less.We all cheer together and live a good life life toward the direction of the light.”