মানুষের ইতিহাস একটা খুব মজার জিনিস । আর ভীষণ ইন্টারেস্টিংও বটে। রামায়ন মহাভারতের মতন মহাকাব্যের ঘটনা তাই আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। এই সব ইতিহাসের অনেকটা অংশই কল্পনা আর বাস্তবের মিশ্রণ বলে মনে করেন মানুষজন। কল্পনার মধ্যে মহাকাব্য, ধর্মগ্রন্থের অলৌকিক বিভিন্ন ঘটনা, দেবী দেবতা, রাক্ষস, ভূতপ্রেত, যুদ্ধবিগ্রহ , ঘৃনা আর ভালোবাসার নানান ওঠাপড়া এই সব কিছুই রয়েছে। আর একটা কথা অধিকাংশ মানুষই বোধহয় স্বীকার করতে চান, তা হল পৃথিবীতে সবরকম বড়সড় যুদ্ধের পিছনে একজন না একজন বিশেষ মহিলার উপস্থিতি অনিবার্য।

ভারতবর্ষের মহাকাব্যের বিখ্যাত সব যুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে ত্রেতাযুগে লিখিত মহাকাব্য ‘রামায়ন’ আজ একটা বিশেষ সংস্কারে পরিণত হয়েছে। এখানেও রয়েছেন বিশেষ এক মহিলা। নাম সীতা। রামরাবণের যুদ্ধ হয়তো হতই না যদি না সীতাকে রাবন অপহরন করতেন। এই গল্প তো এই দেশের আট থেকে আশি সবার মুখস্থ। কিন্তু আরেকজন মহিলার উপস্থিতি যেন আমরা ভুলেই যাই সবসময়, অথচ তাঁকে ঘিরেই কিন্তু এই সমস্ত গোলমালের সূচনা। সেই মহিলা এই মহাকাব্যের বিশেষ একটি চরিত্র হয়ে ওঠার দাবি রাখেন। কারণ আমাদের মেনে নিতেই হবে যে রামায়ন রাম-লক্ষ্মণ-সীতার চোদ্দ বছরের শান্তিপূর্ণ বনবাসের কাহিনীতেই শেষ হয়ে যেত, যদি না সিনে হঠাৎ এন্ট্রি নিতেন সূর্পনখা।

রামায়ন মহাকাব্যের সূর্পনখা
রামায়ন


রাবণের বোন সূর্পনখা এই মহাকাব্যে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। এঁর মায়ের নাম নিকষা এবং পিতা হলেন মুনি বিশ্রবা। জন্মের সময় কিন্তু তাঁর নাম ছিল মীনাক্ষী এবং দীক্ষা। খুব সুন্দর আকৃতির নখ ছিল এই মেয়েটির, অনেকে তাই তাঁকে চন্দ্রনখাও বলেছেন। দাদা রাবণকে লুকিয়ে দানবরাজপুত্র বিদ্যুজ্জিহ্বকে বিয়ে করেন এই মহিলা। একটু খেয়াল করতে হবে, সেই সময়ের এত প্রতাপশালী এক রাজার আদরের বোন নিজে নিজেই তাঁর দাদার বিপক্ষের একজনকে বিয়ে করে নিচ্ছে- এটা সেই সময় চিন্তারও বাইরে। ফলে সূর্পনখা যে প্রথম থেকেই যাকে বলে একটু ‘হটকে’, তা টের পাওয়া কঠিন নয়। আর রাবণের হাতে স্বামী বিদ্যুজ্জিহ্ব নিহত হলেও কিন্তু এই মহিলা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে পড়েননি। রাবণের প্রোভাইড করা দেহরক্ষী খর আর দূষণের সঙ্গে বনে বনে ঘুরছিলেন মনের সুখে। এই সময়েই ঘটল বিপত্তি।

লক্ষণের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে সোজা প্রপোজ করে বসেন সূর্পনখা। লক্ষণ প্রথমে মজা দেখার জন্য এই রাক্ষসীকে পাঠিয়ে দেন রামের কাছে। রাম এঁকে জানান তিনি বিবাহিত, ফলে সূর্পনখার ইচ্ছে পূরণ করতে পারবেন না তিনি। আবার সূর্পনখা এসে হাজির হন লক্ষনকে বিয়ে করার ইচ্ছে নিয়ে। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনায় একবার রাম একবার লক্ষণ এদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে রাজা রাবণের বোন রাক্ষসী সূর্পনখা শেষমেষ সীতাকে হত্যা করতে চান। এই সময়েই লক্ষণ ক্ষেপে গিয়ে খড়্গ দিয়ে সূর্পনখার নাক আর কান কচাৎ করে কেটে দেন। আর সেকাল হোক বা একাল, রাক্ষসী হোক বা মানুষের মেয়ে, চেহারা নিয়ে যুগে যুগেই বিশেষ রকম সেনসিটিভ সমস্ত মেয়েরাই। ফলে যা হবার তাই হল, সূর্পনখা নালিশ করলেন এসে রাবণকে।

https://detechter.com/ravanas-sister-surpanakha/

এখানে একটুখানি ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে আমরা জানতে পারব যে সূর্পনখার সম্পর্কে ঠাকুমা তাড়কা রাক্ষসীকেও কিন্তু হত্যা করেন রাম আর লক্ষ্মণ। এছাড়াও তাঁদের বেশ অনেক আত্মীয়ই ততদিনে নিহত হয়েছে এই দুই ভাইএর হাতে। রাক্ষসী সূর্পনখা কিন্তু তার পরও প্রথমে লক্ষ্মণ আর তার পর রাম, এই দুজনকেই প্রেম নিবেদন করেন। রাক্ষসজাতির সহজাত প্রতিহিংসার ঝলক এই পর্যায়ে তাঁর মধ্যে ফুটে ওঠেনি। কিন্তু লক্ষ্মণ নাক কান কেটে দেবার পর তাতে আহত এবং দুঃখিত হয়ে নিজের পরিবারের কাছেই ফিরে আসেন সূর্পনখা। রাবণ দেখলেন বোনের এই দুর্দশা, প্ল্যান করলেন সীতাকে অপহরণের।

এইবার এই পর্ব থেকে রামায়নের শেষ অব্দি সূর্পনখা গোটা মহাকাব্যেই প্রায় অদৃশ্য। তাঁকে সেভাবে আর দেখা যায়নি কোথাও। সীতার দুর্দশায় তিনি খুশি হয়েছিলেন কিনা, রাবণের মৃত্যুতে হাহাকার করেছিলেন কিনা, রূপ বদলে অন্য মায়ারূপ ধরতে অভ্যস্ত এই রাক্ষসী নাক-কান কাটা চেহারা বদলে অন্য সুন্দর কোনও চেহারায় নিজেকে বদলে নিয়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে রামায়ণের রচয়িতা আশ্চর্যরকম চুপ । কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যুদ্ধের শেষে সৎভাই বিভীষণের সঙ্গে লঙ্কাতেই থেকেছেন শেষ জীবনটা। সমুদ্রের গভীরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেন একদিন। https://banglakhabor.in/2020/11/10/%e0%a6%95%e0%a6%ae%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%b9%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%b8-%e0%a6%95%e0%a7%87/

এবার কথা হচ্ছে, রামায়ণের মতন বিশ্ববিখ্যাত একটা মহাকাব্যে সূর্পনখার মতন নারী চরিত্র কেন গুরুত্ব পাবে! অবশ্যই সূর্পনখার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ সে না থাকলে রাবণের সঙ্গে রামকে এতবড়ো একটা সংগ্রামে জড়িয়ে যেতে হত না যার রেশ আজও ভারতীয় সংস্কৃতিতে ভীষণভাবে চোখে পড়ে। আর নারী হয়েও পুরুষকে গিয়ে সরাসরি নিজের মনের কথা বলবার আত্মমর্যাদাবোধ সবার আগে এই রাক্ষসী সূর্পনখার মধ্যেই ফুটে উঠেছে। সামাজিক বিধিনিষেধের পরোয়া না করেই এই মেয়েটি বারবার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে শেষমেশ বড়সড় অনেকগুলো ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হয়নি। কিন্তু তবুও তাঁর মধ্যে যে আত্মসচেতন সত্তা ছিল তা এই রাক্ষসীকে মাথা নোয়াতে দেয়নি কখনও। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রচিত এমন এক কালোত্তীর্ণ মহাকাব্যে এমন নারী-চরিত্র ভীষণ দুর্লভ। আর সেই জন্যেই সূর্পণখার গুরুত্ব রামায়ণে অসীম!