রামায়ণ, দুই ভারতীয় মহাকাব্যের মধ্যে একটি । রামায়ণ এর গল্পকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত নৃত্য বা নাট্যধারার কথা বলতে গেলেই আমাদের সবার আগে মনে আসে যেই নাম সেটা হল ‘রামলীলা’ । ভারতবর্ষের বহু জায়গায় বিজয়া দশমী বা দশেরার পূর্বের দশ রাত্রিতে রামলীলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই নাট্যশৈলীর উদ্ভব এই দেশেই। তবে ভারতবর্ষের বাইরে ‘রামায়ণ’ কে কেন্দ্র করে ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত হয়ে আসছে একটি অভূতপূর্ব নৃত্য, ‘কেচাক’। এই নৃত্যটির প্রচলনের ইতিহাস, শৈলী এবং নৃত্যটির বৈশিষ্ঠতার কথা জানতে হলে অবশ্যই পড়ুন এই আজকের প্রচ্ছদটি।
পরিচ্ছেদসমূহ: |
1. ভারতবর্ষের বাইরে ‘রামায়ণ’ |
2. ‘কেচাক’ নৃত্যের উৎপত্তি |
3. ‘কেচাক’ নৃত্যের শৈলী |
4. রামলীলা বনাম কেচাক |
5. বিশ্বদরবারে ‘কেচাক’ র স্থান |
1. ভারতবর্ষের বাইরে ‘রামায়ণ‘:
রামায়ণ এ বিভিন্ন সম্পর্কের পারস্পরিক কর্তব্য বর্ণনার পাশাপাশি আদর্শ ভৃত্য, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ বন্ধু, আদর্শ স্ত্রী ও আদর্শ রাজার চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে মানবসমাজের আদর্শ ব্যাখ্যা করার চেষ্ঠা করা হয়েছে । ‘রামায়ণ’ এ ভারতের সংস্কৃতি চেতনার মৌলিক উপাদানগুলিই প্রতিফলিত হয়েছে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, হনুমান ও রাবণ চরিত্রগুলির মধ্যে। হিন্দুধর্মের বাইরে ও বহির্ভারতেও রামায়ণের কয়েকটি পাঠান্তর প্রচলিত রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখনীয় বৌদ্ধ রামায়ণ দশরথ জাতক ও জৈন রামায়ণ এবং রামায়ণের থাই, লাও, ব্রহ্মদেশীয় ও মালয় সংস্করণ। এছারা ইন্দোনেশিয়া তে এই মহাকাব্যের গল্পের প্রভাব লক্ষ্যনীয় । ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র । অতীতে ভারত এবং চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেরে ওঠার দরুন এই দেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিস্তার শুরু হয় । ক্রমে ষোড়ষ শতাব্দীতে দেশটির প্রধান ধর্ম হয়ে ওঠে ইসলাম ।
তবে ইসলামের প্রভাব থাকা সত্তেও সনাতন ধর্মের উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির ছাপ ইন্দোনেশিয়ায় এখনও বিরাজমান । ইন্দোনেশিয়ার অন্তগত বালি দ্বীপ র মধ্যে অবস্থিত অসংখ্য হিন্দু মন্দির গুলি দেখতে আজও বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের ভীড় চোখে পরার মত । ইন্দোনেশিয়ায় এই শহরটিতে ইসলামের থেকে হিন্দুর সংখ্যা বেশী ।এখানের স্থানীয় মানুষেরা তিন হিন্দু দেবতা, শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু কে নিয়মিত পূজো করে আসছেন । প্রাচীন ও আধুনিক নৃত্যকলা, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, চামড়া, ধাতবশিল্প ও সঙ্গীতের ন্যায় উচ্চ পর্যায়ের শিল্পকলা এ শহরে বিশেষ গুরুত্বতা পেয়েছে। এখানকারই একটি অসামান্য নৃত্যশৈলী হল ‘কেচাক’ । এই বিশেষ ধরনের নৃত্যটি প্রত্যেকদিন বালির বিভিন্ন মন্দির সংলগ্ন জায়গায় মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় । এই নৃত্যটিতে রামায়ণ র মূল গল্পটিকে কয়েকটি পর্যায়ে পরিবেশন করা হয় ।
2. ‘কেচাক’ নৃত্যের উৎপত্তি:
রামায়ণ র গল্পের ওপর এই নৃত্যটি আধারিত হওয়ার জন্য এই নৃত্যকে ‘Ramayana monkey chant’ বলে অভিহিত করা হয় এবং ‘Fire Dance’ নামেও অনেক জায়গায় এই নৃত্যের বর্নণা দেওয়া হয়ে থাকে। বালির ইতিহাসনুসারে ‘সঙ্গাইয়ংগ্ন’ নামক প্রাচীন নৃত্য থেকে এই নৃত্যটির উৎপত্তি । অতীতে এই বিশেষ নৃত্যটি তন্ত্র সাধনার জন্য ব্যবহার করা হত । 1961 থেকে কেচাক নৃত্যে রামায়ণ র গল্প জুরে দেওয়া হয় । প্রথমদিকে কেবলমাত্র পুরুষেরাই এই নৃত্যে অংশগ্রহন করত কিন্তু 2006 থেকে কিছু কিছ স্থানে মহিলা রাও অংশগ্রহন করে থাকেন ।
3. ‘কেচাক’ নৃত্যের শৈলী:
রামায়ণ কেন্দ্রিক কেচাক নৃত্যটি পরিবেশনের আগে যে স্থানে নৃত্যটি পরিবেশিত হবে তার মাঝামাঝি নারকেল তেলের বাতি এবং সুগন্ধি ধূপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান প্রারম্ভ হয় । এই নৃত্যে কলাকূশলীকে দুটি দলে ভাগ করা যেতে পারে । এক দল একই রকমের চেক্ কাটা পোষাক পরে কানে ফুল গুজে, কপালে সাদা টীকা পরে সমগ্র নৃত্য সম্পাদনা টির মধ্যে একটি মন্ত্র জপ করে যান এবং সেই মন্ত্র জপের সাথে সাথে অপর দলের শিল্পীরা রাম, সীতা, হনুমান, রাবন ইত্যাদি রূপে নৃত্যটি মঞ্চস্থ্য করেন । সঙ্গীতের ব্যবহার এখানে হয় না।
পুরো নৃত্যটি জুরে ‘চাক্ চাক্’ মন্ত্রের জপ চলতে থাকে এবং এর মধ্য একজন শিল্পী জপ মন্ত্রটির ছন্দ বজায় রাখার জন্য ‘পো পো’ করে একটি সুরের সৃষ্টি করেন । মঞ্চের বাইরে থেকে আরেকজন শিল্পী যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘দালাঙ্’ বলে সে নৃত্য শৈলীর সাথে সাথে রামায়ণ এর বিভিন্ন অধ্যায় গুলি বর্ণনা দিয়ে দর্শকদের গল্পটি বুঝিয়ে দেন । বালির উলুয়াত্তু মন্দিরের মঞ্চে খোলা আকাশের নীচে কেচাক নৃত্যটি মোট 5 টি অধ্যায়ে পরিবেশিত হয় । এরমধ্যে চতুর্থ অধ্যায়ের হনুমানে লঙ্কা কান্ডের দৃশ্যটিতে মঞ্চে অগ্নি সংযোগ ঘটানো হয় এবং আগুনের মাঝে কোনো এক হনুমান রূপী কেচাক শিল্পী তার নৃত্য পরিবেশন করেন ।
4. রামলীলা বনাম কেচাক:
রামায়ণ এ বর্ণিত রাম রাবণের সংঘাতের ওপরে ভিত্তি করে ভারতবর্ষে প্রচলিত নৃত্য শৈলীর নাম ‘রামলীলা’ । রামলীলার উপজীব্য ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ রামের জীবন, সময় ও মূল্যবোধ। রামায়ণ এর কাহিনি ভারতে এতটাই জনপ্রিয় যে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ধারায় ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে রামলীলার বিচরণ। কেচাক র মত এই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় একটি অস্থায়ী মুক্তমঞ্চে । সংলাপ হয় তাৎক্ষণিক, অনেক সময় দর্শকের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সংলাপ বলা হয়। ঢোল ও অন্যান্য বাদ্যকাররা সেই সঙ্গে বাদ্য পরিবেশনা করে থাকেন। কেচাকে কোনোরূপ বাদ্যের প্রয়োজন হয় না । এই দুটি নৃত্য শৈলীর মূল পার্থক্যটি হল, রামলীলা পুরোপুরি রামায়ণ র গল্পটি অনুসরণ করে, সেখানে রাম ই নায়ক কিন্তু কেচাক নৃত্যে প্রাধান্য দেওয়া হয় হনুমান কে । কেচাক নৃত্যের শেষ অধ্যায়ে হনুমানের হাতে রাবণের বধ দেখানো হয় ।
ভারত ব্যাতিত নেপাল, ফিজি, মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, গায়ানা, সুরিনাম, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে রামলীলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। 2008 এ রামলীলা কে ইউনেসকো (United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization) ‘মানবতার অবর্ণনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ বলে ঘোষনা করেছে । কেচাক নৃত্যটি এখনও অব্দি কোনোপ্রকার রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক সম্মান পায়নি ।
5. বিশ্বদরবারে ‘কেচাক’ র স্থান:
রামায়ণ র রামলীলা সমগ্র বিশ্বে ছরিয়ে গেলেও কেচাক নৃত্য টি র কথা অনেকরই অজানা । তবে বিভিন্ন দেশের মানুষ যারা বালি ঘুরে এসেছেন তারা একবার হলেও কেচাক নৃত্যের কথা নিশ্চয়ই শুনে বা দেখে থাকবেন । আজও বালিতে বহু মানুষের জীবিকা নির্ভর করে এই কেচাক নৃত্যটিকে কেন্দ্র করে । ভারতে এই নৃত্য শৈলীর নাম না শোনা গেলেও ইউরোপীয় দেশ গুলির কিছু প্রবন্ধে এবং কিছু চলোচিত্রে এই নৃত্যের উল্লেখ লক্ষ্যণীয় । কিছু বছর আগেও বালি জায়গাটি সেইভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেননি তবে 2017 থেকে বালিতে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে । বহু দেশের পর্যটক কেচাক নৃত্য দেখে অভিভূত হন । কিন্তু বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির জন্য পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার দরুন বিপাকে পড়েছে এই সব নৃত্য শিল্পিরা ।
The West or the central power adopts, transforms, and consumes non-Western or peripheral cultural elements, while making ‘art,’ which was once embedded in the culture as a whole, into a separate entity”.
– James Clifford
আজকের লেখাটি কেমন লাগল অবশ্যই কমেন্ট করে জানান আর আপনি নিজেও যদি এরকম কোনো নৃত্য শৈলীর কথা শুনে অথবা দেখে থাকেন সেটাও অবশ্যই উল্লেখ করুন ।
আরও পড়ুন:
[…] […]
[…] মন্দির গাত্রেই অলংকৃত আছে রামায়ণ, মহাভারত, দূর্গা, শিব, বিষ্ণু, কালী […]