রামানুজনের দেশে অঙ্কেরা কেমন আছে?

১৭২৯ নম্বর ট্যাক্সিতে চেপে অসুস্থ রামানুজনকে হাসপাতালে দেখতে গেছিলেন অধ্যাপক হার্ডি। শয্যার পাশে বসে কথাপ্রসঙ্গে রামানুজনকে বলছিলেন যে আজ একটা বিশেষত্বহীন সাধারণ নম্বরের ট্যাক্সিতে তিনি এসেছেন। শুনেই রামানুজন বললেন, সাধারণ কোথায়? এ তো চমৎকার এক সংখ্যা! বুঝিয়ে বললেন হার্ডিকে, ১৭২৯ ক্ষুদ্রতম সংখ্যা যেটি দুরকম ভাবে দুটি ঘনসংখ্যার সমষ্টি হিসেবে প্রকাশ করা যায়। চার অঙ্কের সেই অদ্ভুত ক্ষমতাবান সংখ্যাই আজ পৃথিবীতে ‘রামানুজন সংখ্যা’ হিসেবে খ্যাত।

রামানুজনের 133 তম জন্মদিনে  দেশ জুড়ে জাতীয় গণিত দিবস পালনের নির্দেশিকা। তবু আজকের ভারতবর্ষ রামানুজনকে কতটুকু চেনে?
source: Quora

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু…হ্যাঁ, এ এক অন্যমাত্রার আস্তিকতার গল্প। আজ আমরা উচ্চতর গণিতের অনেক ফর্মুলা জানি বলে ইন্টিগ্রেশন, ডিফারেন্সিয়েশন কিংবা ইলিপ্সের অঙ্কের দ্রুত সমাধান করে ফেলতে পারি।স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পাই ও থিটার মান ভগ্নাংশে প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু ১৯০০ সালের শুরুর দিক অবধি সেসবের অস্তিত্ব ছিলনা। সংখ্যাতত্ত্বের অনেকখানিই ছিল অধরা। তখনও বড় বড় গণিতজ্ঞরা জানতেন না আবৃত্ত দশমিক দ্বারা ভগ্নাংশের প্রকাশ সম্ভব। অসীমের সিরিজ কেউ কল্পনা করেন নি।কেউই বোঝেন নি যে সমস্ত সংখ্যাই আসলে অনন্ত সম্ভাবনাময়। যে সমীকরণ আপাতভাবে সমাধানযোগ্য নয় বলে মনে হত তা আসলে অসীমে গিয়ে বিলীন!

রামানুজনের 133 তম জন্মদিনে  দেশ জুড়ে জাতীয় গণিত দিবস পালনের নির্দেশিকা। তবু আজকের ভারতবর্ষ রামানুজনকে কতটুকু চেনে?
Source: Melbourne university

অসীমের রহস্য প্রথম ভেদ করলেন কে? তিনি শ্রীনিবাস রামানুজন।অনন্ত সম্ভাবনাময়, ধার্মিক এই দক্ষিণ ভারতীয় যুবক সংখ্যা নিয়ে খেলতে খেলতে এক-পৃথিবী সমাধানতত্ত্ব রেখে গেলেন।তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস, সংখ্যা আসলে ঈশ্বরেরই অংশ।ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেই সংখ্যাতত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করা যায়।কোন সংখ্যাই যে সাধারণ নয়। চতুর্দিকে থরে থরে সজ্জিত নানা ধাঁচের সংখ্যায় রয়েছে অসীমের হাতছানি, যেমন থাকে পদার্থের অনু-পরমানুতে। তাই তো এমন ফর্মুলা রেখে গেছেন রামানুজন যা দিয়ে ব্ল্যাক হোলের জটিল আঁধারেও দিশা মিলল এই কিছুদিন আগে। আরও কত রহস্যের কিনারা রয়েছে তাঁরই নোটবুকে, সেসব মানুষের বোঝার অপেক্ষায়। বিশ্ব তাঁকে ডেকেছিল ‘অসীমস্পর্শী মানব’ ( The man who knew infinity) কিন্তু রামানুজন তা শুনে যেতে পারেন নি। মাত্র ৩২ বছর বয়েসে যক্ষ্মা তাঁর প্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

Day1%2Bto%2B%2Bmadurai%2B2352
source: Travel Kumbakonam Tamilnadu

ভারতবর্ষ কোনোদিনই দেশের প্রতিভা লালন করেনি যতক্ষণ না বিদেশীরা বড় করে শংসাপত্র দেয়। পরাধীন ভারতবর্ষে রামানুজনের মতো একজন প্রথাগত শিক্ষাহীন, হতদরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তানের ভাগ্যেও পরিহাস ছাড়া অন্যকিছু জোটে নি শুরুতে।গণিত ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিলনা। প্রতিদিন স্নান আহ্নিক শেষ হলে মন্দিরের দেওয়ালে, চাতালে খড়ি দিয়ে অঙ্ক কষে যেতেন। রামানুজন আদরের জ্যেষ্ঠ সন্তান হলেও ভালো স্কুলে পাঠানো কিংবা কাগজ, কলম কিনে দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর পরিবারের ছিলনা। কাছেপিঠের একটা পাঠশালাতেই তিনি যেতেন। অঙ্কে আগ্রহ দেখে দশ বছর বয়েসে একজন বন্ধু তাঁকে বিদ্যালয় স্তরের একটি অঙ্কের বই উপহার দিয়েছিল- এস এল লোনি লিখিত ত্রিকোণমিতি। সেই বইয়ের ভিত্তিতেই প্রাথমিকভাবে তিনি নিজের মতো করে অঙ্ক ভাবতে শুরু করেন। ১২ বছর বয়েস হতে না হতেই তিনি সেই বইয়ের সমস্ত বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করলেন। আবিষ্কার করে চললেন একের পর এক উপপাদ্য।এমন অনেক সূত্র বানিয়ে ফেললেন যার অর্ধেক ভেবে বার করতেই ততদিনে অনেক অভিজ্ঞ গণিত বিশেষজ্ঞের গোটা জীবন কেটে গিয়েছে পশ্চিমে।

rs73536 add.ms .a.94 15065 verso scr
source: Trinity college library files

যদিও পনেরো বছর বয়েসে একটা পিয়োর অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড ম্যাথেমেটিক্সের দ্বিতীয় খন্ড হাতে পেয়েছিলেন, কিন্তু আধুনিক গণিতের প্রকৃতি ও গবেষণা সম্পর্কে রামানুজনের কোন ধারণা ছিলনা। নিজের মস্তিস্ক প্রসূত তত্ত্ব কবেই যে সেসবকে ছাপিয়ে আধুনিক গণিতের ধারাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে তা রামানুজনের জানার কথা নয়। সতেরো বছর বয়েসে রামানুজন বার্নোলির সংখ্যা ও অয়েলার-মাসেরনি ধ্রুবকের উপর ব্যক্তিগত গবেষণা শেষ করেন। এইসময়ে কিছুদিন একটা বৃত্তি নিয়ে কুম্বাকোটম সরকারি কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু গণিত ছাড়া অন্য সব বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় তাঁর বৃত্তি বাতিল হয়ে যায়।

মাদ্রাজে নিজের গ্রামের লোকেরা তখন রামানুজনকে নিয়ে হাসাহাসি করত। কেউই তাঁর হিসেবের খাতা দেখে কিছু বুঝতে পারতো না।ততদিনে রামানুজনের ব্যক্তিগত গবেষণা অনেক দূর এগিয়েছে যা তৎকালীন যেকোন দেশীয় গণিতের অধ্যাপকের ধারণার বাইরে। তাঁরা রামানুজনের পরিধির ব্যাপ্তিটুকুও অনুমান করতে পারলেন না। এদিকে চরম অভাবের মধ্যেও যথা নিয়মে ১৯০৯ সালে রামানুজনের বিবাহ হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই রামানুজন বুঝতে পারলেন তাঁর একটা চাকরির প্রয়োজন।কিন্তু স্কুল কলেজে না পড়া একটা ছেলেকে কে চাকরি দেবে! অবশেষে সহায় হল তাঁর গণিত প্রতিভা। রামচন্দ্র রাও নামের একজন দেশীয় সরকারি অফিসার তাঁর ওপরের সাহেবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাদ্রাজ বন্দরে হিসেবরক্ষনের কাজে রামানুজনকে চাকরি দিলেন। রাও ছিলেন গণিত অনুরাগী। রামানুজন যাতে গবেষণা চালিয়ে যেতে পারে সেদিকে সবসময় নজর রাখতেন। তাঁর আগ্রহ চরিতার্থ করতেই রামানুজনকে কাজের পর নিজের খাতা ভর্তি অঙ্কের সম্ভার ব্যখ্যা করতে হতো। কিছুই বোধগম্য নাহলেও রাও এটুকু বুঝেছিলেন যে এই তরুন নিছক ফেলনা নয়।পৃথিবীতে এমন পণ্ডিত নিশ্চয়ই আছেন যারা রামানুজনের অঙ্কের প্রকৃতি সনাক্ত করতে পারেন।

Ramanujan with his wife S. Janaki Ammal
source: Leonardo-newtonic.com

রামানুজনের কাছে স্ত্রী জানকী দেবী ছিলেন প্রিয় বন্ধুর মতো। স্বামীর প্রাণপাত পরিশ্রমের সময়গুলোয় তিনিই সবচেয়ে কাছ থেকে উৎসাহ এবং ভরসা জুগিয়েছেন। রামানুজন নিজের সুত্রগুলি প্রথম ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন স্ত্রীকেই। বুঝিয়েছিলেন মহাজাগতিক বিষয়ের তুলনা দিয়ে। গণিত বোধগম্য নাহলেও তাঁর প্রতি জানকীর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রামানুজনের মনোবল দ্বিগুন করেছিলো। জানকীর একমাত্র আকাঙ্খা ছিল রামানুজনের সাহচর্য, কিন্তু তার অবকাশ প্রায় হতই না। কেরানির চাকরি নেবার পর থেকে রাতেও বাড়ি ফিরতে পারতেন না রামানুজন। সারারাত সেই বন্দরের অফিসে বসেই গবেষণার কাজ এগিয়ে নিতেন। দুজনের নিবিড় ভালবাসার বন্ধন পরবর্তীকালেও রামানুজনকে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে স্বপ্নের পথে ভাসতে শিখিয়েছিল। সহস্র মাইল ভৌগোলিক দূরত্বেও তাঁরা পরস্পরের ছোঁওয়া অনুভব করতে পারতেন।


একদিন মাদ্রাজ বন্দরের অফিসার সাহেব দেখে ফেললেন রামানুজনের মোটা মোটা নোটবুক ভরা গণিতের নকশা। প্রতিক্রিয়া সামলাতে রাও বুঝিয়ে বললেন পুরোটা। সাহেব রামানুজনের গণিতের নমুনা পরীক্ষা করে জানালেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এক সুহৃদ, প্রোফেসর গডফ্রে হার্ডির কথা। হয়ত তিনিই পারেন রামানুজনের গবেষণার প্রকৃতি বিচার করতে। রামানুজন তৎক্ষণাৎ একটি চিঠি লিখলেন হার্ডিকে। সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন অল্প কিছু কাজের নমুনা।

এরপর দ্রুত বদলে যায় সবকিছু। টিকিধারী ব্রাহ্মণ রামানুজন চুল কেটে কোটপ্যান্ট পড়ে কালাপানি পেরিয়ে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। যেটুকু কাজের নমুনা সেই চিঠিতে ছিল তা কেমব্রিজের অধ্যাপকদের কাছে তখন অবিশ্বাস্য।চিঠিতে রামানুজনের প্রস্তাব ছিল তাঁর এযাবৎ গবেষণার কাজ ছাপার ব্যবস্থা করা হোক। এর কোন স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে হার্ডি রামানুজনকে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আগে তিনি চাক্ষুষ করতে চান এই বিস্ময় যুবককে। পরিবারের সকলে শুনে মূর্ছা গেলেও স্ত্রী জানকী আশায় বুক বেঁধে স্বামীকে বিদেশযাত্রার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।

image 20160421 26983 1bcf1xs.jpg?ixlib=rb 1.1.0&q=45&auto=format&w=1200&h=1200
source: the conversation.com


কেমব্রিজে যাওয়া মাত্রই উষ্ণ অভ্যর্থনা পান নি রামানুজন। একে কালো চামড়ার ভারতীয়, তায় আবার অশিক্ষিত একজন তরুন। কেমব্রিজে এমন অযোগ্য ব্যাক্তি এর আগে একজনও প্রবেশ করেনি।কোন ব্রিটিশ অধ্যাপকই তাঁকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। শুধুমাত্র হার্ডি ডেকে পাঠিয়েছেন বলে সরাসরি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া যাবেনা, তাই কেউ কেউ রাগে ফুঁসতে লাগলেন। রামানুজন হার্ডির সঙ্গে কথা বলেন সকালে, বাকি সময়টা হোস্টেল ঘরে থাকেন। টেবিলে সাজানো সুন্দর করে বাঁধানো বিলিতি কাগজ আর দোয়াত কালি। একবার অঙ্ক কষতে বসলে আর কিছু খেয়াল থাকেনা।সেই রাশি রাশি নতুন হিসেবের স্তূপ রামানুজন রোজ সকালে তুলে দিতেন হার্ডির হাতে কিন্তু তাতেও হার্ডি রামানুজনের কাজের মুদ্রণ এবং প্রচারের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতেন না। এতে রামানুজন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে একদিন কৈফিয়ৎ চাইলেন তাঁকে পরিবার ফেলে এতদূরে টেনে আনার। তখন হার্ডির টেবিলে চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে রামানুজনের সদ্য আবিষ্কৃত সংখ্যা বিভাজন তত্ত্বের সিরিজ।

3a62ce8a42c282d5916c206aee67f5c0a55c4deb85360ef6cc9d11b1389f
source: University of Melbourne

হার্ডি রামানুজনকে জিজ্ঞেস করলেন এইসমস্ত সূত্রের উৎস কি? প্রমাণ কোথায়? কি করে জানলে তুমি? রামানুজন উত্তর দিলেন-এসবই ঈশ্বরের স্বপ্নাদেশ। ঘুমের মধ্যে ঈশ্বর তাঁকে মন্ত্র দেন, সকালে উঠে সেসবই লিপিবদ্ধ করেন নোটবুকে।হার্ডি নাস্তিক চাঁচাছোলা মানুষ, সেই প্রথম রামানুজনের আন্তরিক বহিঃপ্রকাশে নড়েচড়ে বসলেন। ছেলেটিই যেন স্বয়ং ঈশ্বর! তিনি সেদিন বললেন, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও তোমাকে করি।

hardy hardy ramanujan w500
source: Amit books

এরপর অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে দুই অসমবয়েসী ভিনদেশি গণিতবিদের। হার্ডির উদ্যোগে রামানুজনের একাধিক গবেষণা নিবন্ধ ইংরিজি ও ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হতে থাকে। রামানুজনের কৃতিত্ব আর চাপা থাকেনা। ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আশ্চর্য প্রতিভার সুখ্যাতি ইউরোপে ছড়িয়ে যায়।
১৯১৮ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সদস্য করা হয় রামানুজনকে। কেমব্রিজের একজন গবেষক ছাত্র হিসেবেও বৃত্তি পেলেন তিনি। এত আনন্দ, এত গর্বের স্বীকৃতিই তো রামানুজনের প্রাপ্য ছিল। আরও অনেক গাণিতিক স্বপ্নের বাস্তবায়নের মুখে এই অনুপ্রেরণাটুকু ছিল সবে সূত্রপাত।


কিন্তু ভীষণ যে এক ভুল হয়ে চলেছিল এই তরুনের জীবন অঙ্কে, তা কেউ লক্ষ্য করে নি। ইংল্যান্ডের চরম ঠাণ্ডা রামানুজনের দিনের পর দিন অভুক্ত শরীরকে কাবু করে ফেলেছিল। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ডিনার টেবিলে একবারের বেশি যান নি রামানুজন। প্রথমদিন গিয়েই বুঝেছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণের উপযুক্ত পাকশাল এবং আহারাদির ব্যবস্থা এখানে নেই। সে বিষয়ে কাউকে বিব্রত করার কথাও কল্পনা করা যায়না। কোনমতে বাজার থেকে কিছু আনাজ কিনে ফুটিয়ে স্যুপ বানিয়ে ঘরে বসে খেয়ে নিতেন রামানুজন।কোনো কোনো দিন সেই অখাদ্য স্যুপ খেতে ইচ্ছে না করলে কিছু খেতেন না। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। শহর জুড়ে শোরগোল, মৃত্যু, খাদ্যের র‍্যাশনিং-এর হুড়োহুড়ি। রামানুজনের ওঠার ক্ষমতা নেই। কাশির দমকে রক্ত উঠে বিছানা বালিশে মাখামাখি। হার্ডি খোঁজ করতে এসে সেই প্রথম জানতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন রামানুজনকে। যদিও রামানুজন ভেতর থেকে জানতেন তাঁর হাতে আর সময় বেশি বাকি নেই।

নিয়মিত রামানুজনের শয্যার কাছ ঘেঁষে বসে গণিতের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেও ভেতরে ভেতরে হার্ডির বুক মুচড়ে উঠত কান্নায়। তাঁর দোষেই এমনটা হল। বাচ্চা ছেলেটাকে আরেকটু যত্নে রাখতে পারতেন শুরু থেকে।রোগশয্যাতে থেকেও ততদিনে হার্ডি ও রামানুজন সংযুক্ত ভাবে কিছু গবেষণা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।কিছুদিন পর সামান্য সুস্থবোধ করলেন রামানুজন। কেমব্রিজে ফিরে এসে আবার গবেষণায় মন দিলেন। ৩৯০০ সূত্র তৈরি করে ফেলেছেন ততদিনে। অনেক জটিল প্রশ্নের সমাধান পেয়ে গবেষক মহল ধন্য ধন্য করতে শুরু করেছে। অবশেষে রামানুজন তাঁর পত্নী এবং পরিবারের সঙ্গে দেখা করার জন্য দেশে ফেরার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। হার্ডি তাঁকে জাহাজে তুলে দিয়ে এলেন। চোখের কোলে কালি আর ক্ষয়াটে চেহারা নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন ৩১ বছরের রামানুজন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হার্ডির কাছে পৌঁছল সেই হৃদয় বিদারক চিঠি। রামানুজন আর নেই।

ramanujan works 042617032345
source: India Today


স্তব্ধ হয়ে গেল ঐশ্বরিক সংখ্যার সারণি। তবুও অসীমে বাজতে থাকলো তার অনুরণন। আজও গবেষকরা ঘেঁটে চলেছেন রামানুজনের খুঁজে পাওয়া নোটবুক, কখন কোন রহস্যভেদের মন্ত্র কাজে লেগে যায়! মাত্র বত্রিশ বছরের জীবনে একজন ভারতীয় পূজারি এত মন্ত্র রেখে গেছেন যে এক জীবনে তার প্রয়োগই বোঝা সম্ভব নয়। অবিশ্বাসীদের পক্ষে তো নয়ই!

https://www.youtube.com/watch?app=desktop&v=7wQ9uqvde3I

ramanujans magic square
source: gonitsora.com

রামানুজনের জন্ম তারিখ ২২ শে ডিসেম্বর ১৮৮৭, যা ‘ম্যাজিক স্কোয়ার-’এর ওপরের সারি অনুযায়ী ২২।১২।১৮।৮৭। বুঝলেন না? নিজের জন্মদিনের সংখ্যাগুলো নিয়েও বেঁধে গেছেন এক চমকপ্রদ ধাঁধা। ম্যাজিক স্কোয়ার এমন এক বর্গক্ষেত্র যার যেদিক দিয়েই হিসেব করা হোক, ফল হবে ১৩৯।


আজ আবারও ২২শে ডিসেম্বর, রামানুজনের ১৩৩ তম জন্মদিন।সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী আজকের দিনের নাম ‘জাতীয় গণিত দিবস’। ২০১২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রামানুজনের স্মৃতিতে এই দিনটিকে জাতীয় গণিত দিবস হিসেবে ধার্য করেছিলেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষে রামানুজনের স্মৃতিচারণার বয়েস মোটে আট বছর।ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এইদিনে কিছু সেমিনার ও সভা আয়োজন করা হয়। গণিতের মাহাত্য ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাষণ দেন বিশেষজ্ঞরা।

CQWgNhVWgAAs0DA
source: Twitter


গণিতে রামানুজনের প্রাসঙ্গিকতা কতদূর তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনা। ভারতীয় গণিতের সুবিপুল ঐতিহ্য বিদেশের গণিত গবেষণাকে সমৃদ্ধ করলেও ভারতবর্ষে বিশ্বাসী মানুষের আজ বড়ই অভাব। ছাত্রছাত্রীদের অঙ্কে ভীতি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার প্রকট সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম।কারণ, কিশোর রামানুজনকে আমরা বুঝতে পারিনি। যুবক রামানুজনকে আমরা ভরিয়ে দিতে পারিনি ঐশ্বর্যে। মৃত্যুর পর কেটে গেছে এতগুলো বছর। আজও তাঁর অবদান সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়েই হয়ত লৌকিকতা করা হবে কিছু প্রতিষ্ঠানে। গণিত দিবসের তাৎপর্য জানবে না কোন সাধারণ শিশু বা কিশোর।বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শুরু হয়ে সেখানেই শেষ হয়ে যাবে যথারীতি। আবার পরের বছর।

এভাবে নয়। জাতীয় গণিত দিবসের স্বার্থকতা আসুক বছরব্যাপী বিশ্বাসে, অনুশীলনে ও প্রয়োগে ।


https://www.banglakhabor.in/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%95-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%ac%e0%a7%9c%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a5%a4-2021-%e0%a6%b9/