পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ প্রাথমিক বা আপার প্রাইমারির শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতির অভিযোগে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। সেইসঙ্গে নতুন করে উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করার নির্দেশনা জারি করেছে আদালত। কেবলমাত্র নির্দেশ জারি করাই নয়, সেই সঙ্গে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য দিন ধরে সময় বেঁধে দিয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময়ের এক চুলও এদিক-ওদিক করা চলবে না।

১১ ডিসেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য এই মামলার রায় দান করেন। বিচারপতি মামলার রায় দিতে গিয়ে জানান উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের মেধা তালিকা প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে প্যানেল তৈরি করা পর্যন্ত, প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তাই গোটা প্রক্রিয়া বাতিল করে দিয়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে হাইকোর্টের পক্ষ থেকে।

images 50 4
News 18 Bangla

২০১২ এবং ২০১৫ সালের টিচার এবিলিটি টেস্ট (টেট) পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থীরা ২০১৬ সালে রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি বের হলে আবেদন করেন। ২০১৮ সালে আবেদনকারীদের ভেরিফিকেশন এবং ২০১৯ সালে মেধা তালিকায় থাকা প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। তখনই অভিযোগ ওঠে পর্যাপ্ত নাম্বার থাকা সত্ত্বেও অনেক আবেদনকারীর নাম মেধা তালিকা জায়গা পায়নি, অথচ অনেক কম নম্বর পেয়েও বা টেট উত্তীর্ণ না হয়েও মেধা তালিকায় অনেকেই স্থান পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেন চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। যদিও সেই সমস্ত অভিযোগে গুরুত্ব না দিয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষক নিয়োগের প্যানেল প্রকাশ করে দেওয়া হয়।

প্যানেল প্রকাশের পর অসংখ্য চাকরিপ্রার্থী অভিযোগ করেন উপযুক্তদের বাদ দিয়ে কম নাম্বার থাকা এবং টেট পরীক্ষায় পাশ না করা এমনকি শিক্ষক নিয়োগের ফর্ম ফিলাপ না করে থাকা অনেককেই প্যানেলে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে কলকাতা হাইকোর্টে প্রায় ২ হাজা টি মামলা দায়ের হয় !

images 51 3
www.banglanewslive.co.in

কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সবকটি মামলাকে একসঙ্গে এটাচ করে শুনানি চলতে থাকে। গত মাসেই এই মামলার যাবতীয় শুনানির কাজকর্ম শেষ হয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর কলকাতা হাইকোর্ট উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার দীর্ঘ রায়ে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় এত বিপুল পরিমাণ অনিয়ম এবং দুর্নীতির ঘটনা ঘটায় এই নিয়োগ প্রক্রিয়া আর চলতে দেওয়া যাবে না। উল্টে বিচারপতি নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য রাজ্য সরকারের সামনে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেন।

হাইকোর্টে রায়ে জানিয়েছে রাজ্যে পর্যাপ্ত শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব থাকায় নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। এজন্য আগামী ৪ জানুয়ারি থেকে আগ্রহী চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে নতুন করে আবেদন পত্র গ্রহণ করা শুরু করতে হবে সরকারকে। গোটা প্রক্রিয়া আগামী 31 শে জুলাইয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে বলে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য। তিনি জানিয়েছেন ইন্টারভিউ এবং ভেরিফিকেশন পর্ব মিটিয়ে ১০ মে-এর মধ্যে মেধা তালিকা বার করে ফেলতে হবে রাজ্য সরকার এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনকে। প্রয়োজনে ভার্চুয়াল মাধ্যমের সাহায্যে চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সেইসঙ্গে উচ্চ প্রাথমিকের শূন্য পদের তালিকা নতুন করে আপডেট করার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি।

images 52 2
AajBikel.com

কলকাতা হাইকোর্টের এই নির্দেশের পর অসংখ্য চাকরিপ্রার্থী যেমন আশাহত হলেন তেমনি অনেকেই নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন। তবে চাকরি প্রার্থীরা এই পরিস্থিতির জন্য সমস্বরে রাজ্য সরকারকেই দায়ী করছেন। তাদের মূল বক্তব্য সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে দুর্নীতিতে মদত দেয়ার ফলে তাদের আজ এই পরিণতি। ঘটনা হলো দীর্ঘ সাত বছর ধরে অসংখ্য হবু শিক্ষক মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিনগুলো পার করে গিয়েছেন সরকারের গাফিলতিতে। অবশেষে সেই দুর্দশা তাদের কাটলো বলে মনে করা হচ্ছে।

কলকাতা হাইকোর্ট রায় দিতে গিয়ে পরিষ্কার জানিয়েছে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছিল।হাইকোর্টের এই রায় দানের ফলে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীরা সরকারকে চেপে ধরার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। বিশেষত আগামী বছর বিধানসভা ভোট হওয়ায় এই অস্ত্র বিরোধী শিবির সহজে ছাড়া করতে চাইবে না। তারা চাকুরিপ্রার্থী শিক্ষকদেরকে উস্কে দিয়ে রাজ্যের সরকারের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করতে চাইবে।

এই সমস্ত হিসাব-নিকাশের বাইরে গিয়ে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে চলেছে বিদ্যালয়গুলির ছাত্রদের এবং সেইসঙ্গে অসংখ্য উপযুক্ত তরুন-তরুনীর যারা আগামী দিনে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে বছরের পর বছর এই রাজ্যের সরকারি ও সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পঠন-পাঠন শিকেয় ওঠার জোগাড়। অন্যদিকে অসংখ্য তরুণ-তরুণী যারা উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের প্যানেলভুক্ত হয়েছিলেন, আশা করেছিলেন যে দ্রুত সমস্ত জটিলতা কেটে গিয়ে তারা নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে যাবেন। কিন্তু হাইকোর্টের এই রায় দানের ফলে তাদের চোখে সত্যিই গাড় অন্ধকার নেমে এসেছে!