“জীবন মানেই হতাশা আর ব্যর্থতা। তার মানে এই নয় যে জীবন ওখানেই থেমে যাবে। কিছু একটা করতেই হবে, জীবন সম্বন্ধে এটাই মানসিকতা হওয়া উচিত।”
– রতন নাভাল টাটা
জীবন সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে গিয়ে এক সময় এই উক্তিটি করেন ভারতের এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পপতি। কর্মজীবনে রতন টাটার সাফল্য নিয়ে শুধু এই দেশেই নয়, পৃথিবীর কোনো অংশের কোনো মানুষেরই মনেই কোনো ধরনের সংশয় নেই। কারণ তিনি মুখের কথায় নয়, কাজে করে প্রমাণ করে দিয়েছেন তার যোগ্যতা ও মেধা। অথচ তার এই পথ চলাটা খুব একটা সহজ ছিল না। ছোটবেলায় তাকে বড়োসড়ো পারিবারিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়।
তার মাত্র ১০ বছর বয়সে তার বাবা নাভাল টাটা একজন সুইস-ভারতীয় মহিলাকে বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়ে তোলেন। রতন টাটার মা তাকে এবং তার ভাইকে নিয়ে হঠাৎ করেই প্রচন্ড অসহায় অবস্থায় পড়ে যান। এই পরিস্থিতিতে তার ঠাকুমা এগিয়ে আসেন। তিনি তাদের তিনজনের যাবতীয় দায়ভার গ্রহণ করেন। এরপর ভারতে তার স্কুল জীবন সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন আমেরিকায়। সেখানকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আর্কিটেকচারে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আমেরিকারই একটি ছোট ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে তার প্রথম কর্মজীবন শুরু হয়।
আমরা অনেকেই ভাবি তিনি টাটা গ্রুপে যোগ দিয়েছিলেন একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি হিসাবে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হলেও রতন টাটা প্রথমে একজন সাধারণ কর্মচারী হিসাবে টাটা স্টিলে যোগদান করেন। তার দায়িত্ব ছিল ব্লাস্ট ফার্নেসের কাজকর্ম দেখাশোনা করা। বরাবরের পরিশ্রমী এবং একাগ্র মানসিকতার অধিকারী হওয়ায় তিনি ধাপে ধাপে টাটা সংস্থার উচ্চপদে উঠে আসেন। তৎকালীন টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান জে আর ডি টাটা তাকে গ্রুপের অন্য একটি সংস্থা নেলকোর আর্থিক স্বাস্থ্য উদ্ধারের দায়িত্ব দিলে তিনি সফল হন।
১৯৯১ সালে বয়স জনিত কারনে জে আর ডি টাটা সংস্থার চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যাওয়ার আগে রতন টাটাকে তার পূর্বসূরী মনোনীত করেন। পরবর্তী একুশ বছর চূড়ান্ত দক্ষতার সঙ্গে টাটা গোষ্ঠীর ব্যবসা পরিচালনা করে তাকে একটি সফল বহুজাতিক সংস্থায় পরিণত করতে সফল হন রতন টাটা। টাটা গোষ্ঠীর একাধিক উচ্চপদস্থ আধিকারিক তাকে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলেও সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ৭৫ বছর বয়সে তিনি টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সংস্থায় তার দীর্ঘ অবদানের কথা মাথায় রেখে তাকে টাটা গোষ্ঠীর এমিরেটাস চেয়ারম্যান পদে মনোনীত করা হয়।
অবসর-জীবন পরবর্তী রতন টাটা –
তার অবসর জীবন নিয়ে রতন টাটা একাধিক সাক্ষাৎকারে এবং সামাজিক মাধ্যমে উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে কাজগুলো কর্মজীবনে করে উঠতে পারেননি সেগুলো নিয়েই বর্তমানে তার সময় কেটে যায়। পোষ্যদের সঙ্গে সময় কাটাতে খুবই পছন্দ করেন এই অকৃতদার শিল্পপতি। এই ঘটনায় কেউ মনে করতে পারে দীর্ঘ কর্মজীবনের পর রতন নাভাল টাটা হয়তো অখণ্ড অবসর যাপন করছেন! সে ক্ষেত্রে আবার ভুল করবো আমরা। রতন টাটারা কখনো চুপচাপ বসে থাকতে পারে না।
তার বর্তমান ভূমিকা –
টাটা গোষ্ঠী থেকে অবসর গ্রহণের সময় রতন টাটা তার উত্তরসূরি নির্বাচিত করেছিলেন সাইরাস মিস্ত্রিকে। শাপুরজি-পালানজি গোষ্ঠীর ছোট ছেলে সাইরাস পারিবারিক ভাবেও টাটাদের আত্মীয়। কিন্তু টাটা গোষ্ঠীর মূল্যবোধের প্রশ্নে রতন টাটার সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যেই বিরোধ বাধে তার। এরপর টাটা গোষ্ঠীর মূল সংস্থা টাটা সন্সের পরিচালন সমিতি সাইরাস মিস্ত্রিকে সংস্থার চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করে এবং অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্য রতন টাটাকে অনুরোধ করে। সংস্থার বিপদের সময় অবসর ভেঙে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রায় এক বছর সেই দায়িত্ব পালন করার পর এন চন্দ্রশেখরণের হাতে যাবতীয় দায়িত্বভার অর্পণ করে তিনি পুনরায় অবসর নেন টাটা গোষ্ঠী থেকে।
জরুরী পরিস্থিতিতে অবসর ভেঙে টাটা গোষ্ঠীর দায়িত্ব হাতে তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও টানের পরিচয় পাওয়া যায়। একাধিক বার তিনি বলেছেন টাটা গোষ্ঠীর সদর দপ্তর মুম্বাইয়ের “বোম্বে হাউজ” ছিল তার বাড়িঘর, ধ্যান-জ্ঞান।
রতন টাটা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম বাণিজ্য ও শিল্প উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। সেইসঙ্গে টাটা পরিবার ও টাটা গোষ্ঠীর দাতব্য সংস্থা টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও আছেন তিনি। করোনা সংক্রমণ ভারতে ছড়িয়ে পড়লে তার নির্দেশে টাটা ট্রাস্ট ৫০০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম দান করে।
করোনা সংক্রমনের ফলে লকডাউন জারি হলে একাধিক বেসরকারি সংস্থা নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ কমাতে নির্বিচারে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছিল। সংস্থাগুলির সেই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে রতন টাটা বলেছিলেন “কর্মীরা হলো সংস্থাগুলোর সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে সংস্থাগুলির উচিত কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো। এই কর্মীরাই একসময় সংস্থাকে মুনাফা এনে দিয়েছে এটা মাথায় রাখা উচিত পরিচালকদের।”
মানবিক কাজ এবং মানুষের কাজে লাগে এরকম আবিষ্কারের প্রতি তিনি সর্বদাই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। সেই কারণেই টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর অসংখ্য নবীন শিল্পোদ্যোগী এবং স্টার্টআপগুলির পাশে দাঁড়ান। ব্যক্তিগত অর্থ প্রায় এক ডজনেরও বেশি স্টার্টআপ সংস্থায় ইতিমধ্যেই তিনি বিনিয়োগ করেছেন।
রতন টাটার বিনিয়োগ আছে এরকম স্টার্টআপ সংস্থাগুলি হল-
স্ন্যাপডিল
পেটিএম
ওলা ইলেকট্রিক
কার দেখো
লেন্সকার্ট
টর্ক মটর
আরবান ল্যাডার
আরবান ক্ল্যাপ
শাওমি
ক্যাস করো ইত্যাদি।
রতন টাটা ও তার পরিবার তাদের আয়ের ৬৫ শতাংশ অর্থ জনসেবার লক্ষ্যে বিভিন্ন চ্যারিটির মাধ্যমে দান করে থাকে। সমাজকল্যাণে ব্রতী এই অভিজ্ঞ শিল্পপতি নতুন শিল্প সংস্থাগুলিকে প্রতিমুহূর্তে বিভিন্ন পরামর্শ দানের মাধ্যমে পাশে দাঁড়ান। সবাইকেই বলেন “লক্ষ্য হওয়া উচিত আমাদের কাজের মাধ্যমে মানুষ যেন ভালো থাকে।”
এই প্রসঙ্গে বাকিদের সঙ্গে তার এবং টাটা গোষ্ঠীর মূল্যবোধের ফারাক বোঝাতে একটি বিখ্যাত উক্তি সবশেষে উল্লেখ করছি-
“আমরা উদ্যোগপতি। রিলায়েন্স আদানীরা হলো ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। ওদের লক্ষ্য মুনাফা অর্জন করা। আমাদের লক্ষ্য নতুন নতুন ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করে মানুষের জীবনযাত্রার মানকে আরও উন্নত করে তোলা।”
– রতন নাভাল টাটা
দারুন লাগলো! 👍🏽
😌