পশ্চিমবঙ্গের মতো তামিলনাড়ুতেও আগামী বছরের মে মাসে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনের আগেই তামিল রাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছে সুপারস্টার রজনীকান্তের নতুন রাজনৈতিক দল তৈরির ঘোষণা। তামিল জনগণের “থালাইভা” রজনীকান্ত নতুন দল তৈরীর কথা ঘোষণা করতে গিয়ে জানিয়েছেন করোনা মহামারীর কারণে দেরি হয়ে গিয়েছে। না হলে আরো আগে তার রাজনৈতিক দল তামিলনাড়ুর রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়ত। তিনি জানিয়েছেন আগামী জানুয়ারি মাসে তার নতুন রাজনৈতিক দলের নাম ঘোষণা করবেন এবং একইসঙ্গে তামিলনাড়ুতে পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দেবে এই দল। নতুন দলের কথা ঘোষণা করতে গিয়ে রজনীকান্ত বলেন তার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। তিনি চান দুর্নীতিমুক্ত এক তামিলনাড়ু গড়তে। এই কথাটা ঘোষণা করা তার পক্ষে খুব জরুরি ছিল। কারণ এর আগে গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠেছে বারবার। অনেকে মনে করছেন তার ফ্যান ক্লাব “রজনী মাক্কাল মন্দ্রমকেই” হয়তো রাজনৈতিক দলে পরিণত করবেন রাজনিকান্ত।
এর আগে ২০১৭ সালে তামিল সিনেমার আর এক জীবন্ত কিংবদন্তি কমল হাসান “মাক্কাল নিধি মাইয়াম” নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে তামিল রাজনীতির মূল মঞ্চে প্রবেশ করেন। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তামিলনাড়ুর ৩৯ টি কেন্দ্রেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটি আসনেও জয়লাভ করতে ব্যর্থ হয় এই রাজনৈতিক দলটি। তবে প্রথমবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই ৬ শতাংশ ভোট তারা নিজেদের দখলে আনতে পেরেছে। এখন আবার রজনীকান্ত তার তৈরি রাজনৈতিক দল নিয়ে তামিলনাড়ুর ভোট মঞ্চে প্রবেশ করেছেন। এই দুই সুপারস্টারের তৈরি দল আগামী বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের মধ্যে জোট তৈরি করে কিনা তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনার পারদ তুঙ্গে উঠেছে। যদিও রজনীকান্ত জানিয়ে দিয়েছেন আগামী বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের ২৩৪ টা আসনেই তার তৈরি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
তামিলনাড়ুর রাজনীতির দুই কিংবদন্তি করুণানিধি ও জয়ললিতার মৃত্যুর পর তামিল রাজনীতিতে এক বড়োসড়ো শূন্যতা তৈরি হয়েছে। করুণানিধি পুত্র স্ট্যালিন রাজনীতিতে পোড়খাওয়া হলেও তার রাজনৈতিক উচ্চতা কখনোই বাবার সমতুল্য নয়। অন্যদিকে জয়ললিতার মৃত্যুর পর তার দল এআইএডিএমকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দু ভাগ হয়ে যেতে বসেছিল। কোনোরকমে সেই পরিস্থিতি সামলানো গেলেও “আম্মা” জয়ললিতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এমন কোনো নেতা সেই দলে আপাতত কেউ নেই। বরং স্টালিনের নেতৃত্বে ডিএমকে কিছুটা হলেও নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে।
তামিল রাজনীতি বরাবরই ব্যক্তি পুজোয় আস্থা রেখেছে। করুনানিধি ও জয়ললিতার পরবর্তী পর্যায়ে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে তা দখল করার সুবর্ণ সুযোগ কমল হাসান ও রজনীকান্তের কাছে। গোটা তামিলনাড়ু জুড়ে রজনীকান্তের অসংখ্য ভক্ত ছড়িয়ে আছে যারা তার এক ডাকে মুহুর্তের মধ্যে জড়ো হয়ে যেতে পারে। এই সুবিধা তার রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
• কি হতে পারে রজনীকান্তের রাজনৈতিক পরিকল্পনা?
রজনীকান্তের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সুসম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। একই রকম ভাবে ১৯৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় তিনি করুণানিধির সমর্থনে গলা ফাটিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন জয়ললিতা। ভোটে জিতে সরকার তৈরি করে করুণানিধির ডিএমকে। এরকম একটা প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অনেকেই মনে করেছিল রজনীকান্ত হয়তো বিজেপিতে যোগ দেবে।
যদিও নতুন রাজনৈতিক দল তৈরির কথা ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি পরিষ্কার বলে দেন বিজেপির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে না তার দলের। সেইসঙ্গে তামিলনাড়ুর বর্তমান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তিনি যে জোট গড়ে তুলবেন না, তাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে রজনীকান্তের নবগঠিত দল একাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে মনে হচ্ছে। প্রথমবার ভোটে প্রতিদ্বন্দিতা করেই তামিলনাড়ুর ক্ষমতা দখল করা রাজনীর প্রধান লক্ষ্য হবে, সেটা এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়। তবে ভোটের পর সরকার গড়ার প্রশ্ন আসলে তিনি বিজেপির সমর্থন নেবেন না এ কথা জোর দিয়ে বলার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি।
এই নতুন দলের আগমনে তামিল রাজনীতি কতটা আলোড়িত হবে?
দীর্ঘদিন ধরে তামিলনাড়ুর রাজনীতি ডিএমকে এবং এআইডিএমকে এই দুটি দলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু করুণানিধি ও জয়ললিতার প্রয়াণের পর সেই পরিসরটা দখল করে নিতে পারেন কমল হাসান ও রজনীকান্ত। এক্ষেত্রে বাজারদর রজনীকান্তের পিছনেই সবচেয়ে বেশি! কারণ তামিল সমাজে রজনীকান্তের প্রভাব অনস্বীকার্য। সেক্ষেত্রে রজনীকান্তের প্রতিষ্ঠিত দল সামনের সারিতে খুব সহজেই উঠে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। যার ফলে সবচেয়ে বেশি এআইএডিএমকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ করুণানিধির মৃত্যুর পর শূন্যতা তৈরি হলেও তা অনেকটাই সামলে নিতে পেরেছে এম কে স্ট্যালিন।
তবে, রজনীকান্তের দলকে সামনে রেখে তামিল রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে বিজেপি। তারা হয়তো এই দলের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করতে পারে। তবে এই সম্ভাবনা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। তার মূল কারণ হল এই দ্রাবিড় ভূমে উত্তর ভারতের বিজেপিকে খুব একটা সুনজরে দেখেনা মানুষজন!
রজনীকান্ত অবশ্য তার নতুন দল ঘোষণার সময় পরিষ্কার জানিয়েছেন তিনি দলের প্রধান হয়ে থেকে যেতে চান। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার বাসনা তার নেই। সে ক্ষেত্রে নতুন একটি ধারা দেখা যাবে তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে। এর আগে এম জি রামচন্দ্রন, করুণানিধি, জয়ললিতারা সবাই দলের প্রধান থাকার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন। সেক্ষেত্রে রজনীকান্তের দল যদি তামিলনাড়ুর ক্ষমতা দখল করতে সফল হয়, তবে মুখ্যমন্ত্রীর না হয়ে তিনি বাইরে থেকে সরকারের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায় রজনীকান্তের দল যত সাফল্য পাবে ততোই তামিলনাড়ুতে বিপদে পড়বে কংগ্রেস ও বিজেপির মতো দুটি সর্বভারতীয় দল। রজনীকান্তের উত্থান তামিল রাজনীতিকে তার পুরানো দাপটের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অন্তত রজনী ভক্তরা এই মুহূর্তে সেই স্বপ্নেই বিভোর!