ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাব বর্ণময় এক মেলবন্ধন। বিশেষ করে এই পর্যায়ে মোগল শাসকদের কথা বলতেই হবে। দেশে আমরা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে যাঁদের শাসক হিসেবে পেয়েছি, তাঁদের অনেকেই ইতিহাসে নিজস্ব বিশিষ্টতায় স্মরণীয় হয়ে রয়ে গিয়েছেন। আজকের ভারতবর্ষের যে চেহারা আমরা দেখতে পাই তা তৈরির পিছনে বহু যুগের বহু মানুষের পরিকল্পনা ও পরিশ্রম রয়েছে। ঐতিহাসিকেরা বলে থাকেন যে মধ্যযুগের ভারতবর্ষ ক্রমশ সবদিক থেকেই উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছিল।
এই সময়ে ভারতের শাসক ছিলেন যাঁরা তাঁরা মোগল শাসক। বাবরের হাত ধরে যাঁদের শাসনপর্ব শুরু, তারপর হুমায়ুন থেকে আকবরের সময়ে যা চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। তাঁর পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গির, শাহজাহান, এমনকি ঔরংজেবের সময়েও এ দেশের নানান উন্নতি সাধন ঘটে। ফলে সবমিলিয়ে বলা ভুল হবে না যে মোগলরা ভারতবর্ষকে নানাদিক থেকে সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। সেগুলি জানবার চেষ্টা করলে দেখা যাবে–
শিল্পকলা
https://www.theguardian.com/artanddesign/2012/nov/30/art-treasures-of-mughal-empire
ভারতবর্ষের শিল্পকলার আজকের চেহারা যা আমরা দেখি তাঁর পিছনে মোগলদের অবদান অনস্বীকার্য। মধ্যযুগে মোগল শাসকের উৎসাহেই মূলত ছবি আঁকার শিল্প বিশেষ ভাবে বিকশিত হয়। সেই সময়ের রং, ছবির ধাঁচ, মানুষের অবয়ব বিশেষ ভাবে আজ সারা বিশ্বে “মুঘল পেন্টিং” নামে খ্যাতি লাভ করেছে। সেই সময়ে আঁকা নানান ছবির মধ্যে তখনকার শাসনব্যস্থা সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী ভারতবর্ষের ইতিহাসে চিত্রশিল্পের যে ধারা অনেক শতাব্দী ধরে বহমান, মোগলদের সান্নিধ্যে তা সঠিকভাবে বিকাশের সুযোগ পায়।
স্থাপত্য
মোগলদের সান্নিধ্যে ভারতীয় স্থাপত্য যে চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল তার সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল। শ্বেতপাথরের এই স্থাপত্যকীর্তি সম্ভবত মোগল সাম্রাজ্যের অবদানের সবচাইতে বড়ো প্রমাণ। মোগলদের স্থপতিদের হাতের কারুকাজ আজ পৃথিবীবিখ্যাত। যা আজও পৃথিবীর সমস্ত স্থপতিদের কাছে ঈর্ষার বিষয়। এছাড়াও দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, আড়াই দিন কা ঝোপড়া, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তি মোগলদের হাতেই সৃষ্টি। এসব আজও সারা পৃথিবীর পর্যটকদের টেনে আনে।
শাসনব্যবস্থা
মোগলরা এদেশের শাসনভার নিজেদের কুক্ষিগত করবার আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা অনেকটাই ছড়ানো-ছিটনো ছিল। প্রথমে হুমায়ুন এবং তার পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে আকবর, এঁদের সময় থেকে ভারতের শাসনব্যবস্থার খুঁটিনাটি নিপুণভাবে নিয়ন্ত্রন করা শুরু হয়। সাম্রাজ্যকে বিশেষ বিশেষ অঞ্চল, জায়গির, পরগণায় ভাগ করে সেই সমস্ত অঞ্চলের জন্য কিছু শাসক নিযুক্ত করে রাখার ফলে রাজস্ব লাভ ও বণ্টনের সুবিধাও হয়। এছাড়াও নানান শস্য ও জরুরি পণ্যের দাম বেঁধে দেবার ফলে ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন মোগল শাসকেরাই।
রাজনীতি
বাবর কিংবা হুমায়ুনের শাসনকাল মোটামুটি যুদ্ধবিগ্রহ এবং আভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটাতেই কেটে গিয়েছিল। কিন্তু মোগল বাদশা আকবর নিজে নিরক্ষর হলেও সমাজনীতি এবং রাজনীতিতে ছিলেন অত্যন্ত কুশলী। তিনি বুঝেছিলেন শাসন করতে হলে শোষণ করা চলবে না। প্রজাদের উপর থেকে নানান কর মকুব করে দেন তিনি। আকবর ও তার পরবর্তী মোগল শাসকেরা রাজনৈতিক বিবাহকে প্রাধান্য দিতেন ভীষণভাবে, যা তাঁদের জন্য এবং সার্বিকভাবে এই দেশের জন্য প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে একাধিকবার।
সঙ্গীত ও নৃত্যকলা
মোগল আমলে সঙ্গীত ও নৃত্যকলা প্রথমে আকবর ও পরে জাহাঙ্গিরের সময় চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। বহু সঙ্গীতকার ও নৃত্যশিল্পীদের যথাযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন সমস্ত মোগল শাসকেরাই। আকবরের সময় প্রখ্যাত সঙ্গীতের কিংবদন্তী তানসেন নিজের প্রতিভা দিয়ে সঙ্গীতের নতুন এক ঘরানার পত্তন করেন। আর নৃত্যের বহু মুদ্রা এইসময় আলাদাভাবে প্রচলন করা হয়। মোগল আমলের ভারতবর্ষ শৈল্পিক আঙ্গিকে সারা বিশ্বে নিজস্ব আলোয় উদ্ভাসিত হয়, যা আজকের শিল্পীদের পথ দেখিয়েছে।