কলকাতা হোক বা অন্য কোথাও, মিষ্টি ওমিষ্টির দোকানের সঙ্গে খাদ্যরসিক বাঙালির সম্পর্ক বহু পুরোনো। বাঙালি আর মিষ্টির এই রসালো সম্পর্কের মাঝে ঢুকে পড়তে পারে না কেউই। নেমন্তন্ন বাড়ির শেষ পাতে হোক কিংবা বিজয়ার পরের দিন সকালে, বাঙালি বাড়িতে মিষ্টির আনাগোনা থাকে বারো মাস। এমনকি মাছ, যাকে বাঙালির খাদ্য তালিকায় একেবারে অপরিহার্য ধরা হয়, খুঁজে দেখলে হয় তো সেই মাছ খান না এমন বাঙালিও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু মিষ্টিতে ‘না’ বলা বাঙালি মেলা ভার। আর শুধু বাঙালি কেন, যে কোনো ভাষাভাষীর মানুষের সঙ্গেই মিষ্টির বন্ধন অচ্ছেদ্য।
বাঙালির মিষ্টির চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়েই হয়তো তৈরি হয়েছে বাংলার মিষ্টির রকমভেদ। আজ এত ধরণের এত স্বাদের মিষ্টি বাংলায় পাওয়া যায় যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এক সময় মিষ্টির জন্ম লগ্নে বৈচিত্র্য ছিল নিতান্তই হাতে গোণা। কলকাতা শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে প্রাচীন কিছু মিষ্টির দোকানের নাম। এরাই মিষ্টি প্রিয় বাঙালির রসনা তৃপ্তির মূল কারিগর। আসুন আজ জেনে নেওয়া যাক কলকাতার সুপ্রাচীন কিছু মিষ্টির দোকানের ইতিহাস।
১) কলকাতার বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক:
কলকাতার প্রাচীনতম মিষ্টির দোকান গুলির মধ্যে অন্যতম হল বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক। ব্রিটিশ ভারতে কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল যে বছর, সেই ১৮৮৫ সাল বলরাম মল্লিক এবং রাধারমণ মল্লিকের পথ চলা শুরু। তারপর থেকে একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিক ভাবে এই মিষ্টির দোকানের সুনাম বজায় আছে। বেশ কয়েকবার কলকাতার সেরা মিষ্টির দোকানের খেতাবও জিতেছে এই প্রতিষ্ঠান। চিরাচিরত বাঙালি মিষ্টি তো বটেই, সেই সঙ্গে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা ফিউশন মিষ্টিও বিক্রি হয় এখানে, যার মধ্যে চকোলেট মিষ্টির জনপ্রিয়তা সবথেকে বেশি। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় এই দোকানের একাধিক শাখা রয়েছে।
২) কলকাতার ভীম চন্দ্র নাগ:
কলকাতার মিষ্টির দোকানের ইতিহাসে ভীম চন্দ্র নাগের সূচনা বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিকেরও আগে। ১৮২৬ সালে পরাণ চন্দ্র নাগ এই মিষ্টির দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। বউবাজারের এই দোকানের মিষ্টির জনপ্রিয়তা বরাবরই ছিল আকাশছোঁয়া। এই দোকানের যে মিষ্টি আজও ঐতিহ্যশালী ভাবে জনপ্রিয় তা হয় লেডিকেনি এবং আশু ভোগ। এছাড়াও এদের আইসক্রিম সন্দেশ, রোজ ক্রিম সন্দেশ এবং পেস্তা সন্দেশও সুস্বাদু। ভীম নাগের বিশেষ মিষ্টি ‘আবার খাবো সন্দেশ’ একবার ট্রাই করতেই পারেন।
৩) কলকাতার গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী:
কলকাতার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান গুলির মধ্যে বরাবরই প্রথম সারিতে জায়গা করে নেয় গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী। ১৮৪৪ সালের কলকাতার বুকে এই দোকানের পথ চলা শুরু হয়েছিল। গিরিশ চন্দ্র আর নকুড় চন্দের জনপ্রিয়তা এত বছরেও এতটুকুও কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। কলকাতা ছাড়িয়ে এই প্রাচীন দোকানের মিষ্টির জনপ্রিয়তা পৌঁছে গেছে দেশের নানা প্রান্তে। গিরিশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দীর নলেন গুড়ের সন্দেশ, কালাকাঁদ এবং রসমালাই একবার চেখে দেখলে তার স্বাদ ভুলতে পারবেন না কিছুতেই। সঙ্গে মিষ্টি দই আর চকোলেট মিষ্টি কথাও না বললেই নয়। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে এই দোকান আজও স্বমহিমায় বর্তমান।
৪) কলকাতার কে সি দাস:
কলকাতার মিষ্টির দোকানের তালিকায় কে সি দাসের নাম থাকবে না তা হতেই পারে না। মিষ্টির দুনিয়ায় বিপ্লব এসেছে এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই। বাঙালির মিষ্টির আবেগের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে যে রসগোল্লা,কে সি দাস বিখ্যাত সেই রসগোল্লার জন্যেই। নানান স্বাদের রকমারি রসগোল্লা তৈরিতে এই দোকানের জুড়ি নেই। সেই ১৮৬৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সমান তালে নিজেদের জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে পেরেছে এই কে সি দাস। আধুনিকতার ছোঁয়া ঐতিহ্যকে মলিন করে দিতে পারে নি। বাঙালি মিষ্টির পাশাপাশি এরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা স্বাদের ফিউজন মিষ্টিও প্রস্তুত করে থাকে। তাছাড়া এদের ল্যাংচা, নলেন গুড়ের রোল এবং গুলাব জামুন বিখ্যাত। বর্তমানে কলকাতা শহরের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়েছে কে সি দাসের মিষ্টির দোকানের শাখা প্রশাখা। কলকাতায় এই দোকান রয়েছে ধর্মতলা চত্বরেচত্বরে।
৫) কলকাতার বাঞ্ছারাম:
কলকাতার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান গুলির মধ্যে বাঞ্ছারামের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৬ সালে মধ্য কলকাতায় একটা ছোট্ট দোকান থেকে বাঞ্ছারামের পথ চলা শুরু দোকানের মালিক বাঞ্ছারাম ঘোষের। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত বাঞ্ছারামের মিষ্টির দোকানের জনপ্রিয়তা গোটা কলকাতা শহর জুড়ে প্রসিদ্ধ। এই দোকানের মিষ্টি স্বাদের জন্য অল্প সময়েই বিপুল পরিমাণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এদের রসগোল্লা এবং সন্দেশ যেমন জনপ্রিয়, তেমনি পুলি পিঠে এবং মিহিদানার জনপ্রিয়তাও কম নয়। বিশেষত, বাঞ্ছারামের ভ্যানিলা এবং স্ট্রবেরি সন্দেশ একবার চেখে না দেখলেই নয়। দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর বাঘা যতীন এলাকায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই বাঞ্ছারাম মিষ্টির দোকান। তবে কলকাতার নানা প্রান্তেই রয়েছে এদের শাখা।
বাঙালি রসনাকে তৃপ্ত করতে গেলে যে এই সমস্ত সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান গুলিতে একবার অন্তত ঢুঁ মেরে আসতেই হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।