মমতা ব্যানার্জি তখন কংগ্রেসের একজন ছাত্র নেতা। সেই সময় তিনি পড়াশোনা করতেন হাজরার যোগমায়া দেবী কলেজ। সেই সূত্রে হাজরা, রাসবিহারী, গড়িয়াহাট, ভবানীপুর সংলগ্ন অঞ্চল ছিল তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র। এই জায়গাগুলি শহর কলকাতার মধ্যে হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার নামের সঙ্গে কংগ্রেসের তৎকালীন রাজ্য নেতৃত্ব ও মিডিয়ার পরিচিতি ছিল। একদিন হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে হেভিওয়েট সিপিআই(এম) নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে দক্ষিণ শহরতলীর যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। অনেকের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে মমতাও হকচকিয়ে গিয়েছিলে। তবে তার চিরাচরিত হার না মানা মনোভাবকে সঙ্গী করে তিনি নির্বাচনে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েন।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তখনই রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে দিল্লির রাজনীতিতে অন্যতম পরিচিত মুখ। বামেদের অন্যতম ঘাঁটি বলে পরিচিত যাদবপুর থেকে তার জয় লাভ করা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা ছিল বলে রাজনৈতিক মহলের প্রায় সকলেই ধারণা করেছিলেন।কিন্তু ফলাফল বের হলে দেখা গেল নক্ষত্র পতন ঘটিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমবারই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সোমনাথ বাবুর মত রাজনীতিককে হারিয়ে দিতে তিনি সফল হয়েছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় ঘটেছিল। তার পরিবারে এমন কেউ কেউকেটা ছিলেন না যার হাত ধরে তিনি রাজনীতির ময়দানে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি তার পুরানো দল কংগ্রেসের পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। এমনকি পরিবারতন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে একাধিকবার বিজেপিকে পর্যন্ত নিশানা করেন তিনি। আজ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা ছাড়াও রাজ্যবাসীর একাংশ পরিবারতন্ত্রে মদত দেওয়ার অভিযোগ করে।
তৃণমূল সুপ্রিমো সত্যিই একসময় আন্তরিকভাবে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের ঘোর সমালোচক ছিলেন। পরবর্তীতে বোধহয় দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চিরাচরিত ঐতিহ্য মেনে তার ও তার দলের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই পরিবারতন্ত্র গেড়ে বসেছে। এখন তিনি যতই অস্বীকার করুন না কেন, বাস্তব হল তৃণমূল কংগ্রেসে একাধিক ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের নমুনা বিদ্যমান। আমরা বরং তৃণমূলের অভ্যন্তরে থাকা পরিবারতন্ত্রের উদাহরণগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নিই।
১) মমতা ব্যানার্জির নিজের পরিবার
অতীতে তৃণমূল নেত্রী একাধিকবার দাবি করেছিলেন তার বিরুদ্ধে যাতে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ না ওঠে তাই তিনি তাঁর পরিবারের লোকজনদের রাজনীতির সামনের সারিতে আসতে দেন না। কিন্তু তার এই অবস্থান পরবর্তীকালে তিনি নিজেই পাল্টে ফেলেন। রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তার উত্তরসূরি হিসাবে দলের সামনের সারিতে নিয়ে আসেন তিনি। অভিষেক সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপন ভাইপো হন।
তৃণমূলের নেতাকর্মীদের একাংশ জনান্তিকে দাবি করেন দলের প্রকৃত ক্ষমতা বর্তমানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাকেই মমতা পরবর্তী তৃণমূলের হোতা হিসাবে চিহ্নিত করে।
শুধু অভিষেকেই শেষ নয় গতবছর লোকসভা নির্বাচনে দলের খারাপ ফলাফলের পর তৃণমূল নেত্রী “জয় হিন্দ বাহিনী” বলে দলের অভ্যন্তরে একটি নয়া সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই সংগঠনের মাথায় বসান তার ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই সঙ্গে বিরোধীরা অভিযোগ করে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ক্রীড়া সংস্থাগুলি বর্তমানে কালীঘাটের এই বন্দোপাধ্যায় পরিবারের দুই ভাই অজিত ও স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় কুক্ষিগত করে রেখেছে।
২) পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকারী পরিবার
তৃণমূলের অভ্যন্তরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলাকে অধিকারী পরিবারের “সাম্রাজ্য” বলে উল্লেখ করেন অনেকে। সাম্প্রতিক সময়ে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হলে তিনি রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন। কিন্তু তার আগে শুভেন্দু ছিলেন তৃণমূলের অভ্যন্তরে অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন নেতা। সেই শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী হলেন এই অধিকারী সাম্রাজ্যের কর্তা। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিশিরবাবু একাধারে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের সভাপতি এবং সেইসঙ্গে লোকসভার সাংসদ। শুভেন্দুর দাদা দিব্যেন্দু অধিকারী হলেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আরেক লোকসভা কেন্দ্র তমলুকের সাংসদ। তার ছোট ভাই সৌমেন্দু অধিকারী হলেন কাঁথি পৌরসভার তৃণমূল চেয়ারম্যান।
একটি পরিবার পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তৃণমূলের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক এবং সংসদীয় পদ নিজেদের দখলে রেখেছে, এটি নিঃসন্দেহে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের একটি আদর্শ উদাহরণ। এক্ষেত্রে তৃণমূল নেত্রী তার দলে প্রত্যক্ষভাবে পরিবারতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন তা বলাই যায়।
৩) দক্ষিণ কলকাতার বিশ্বাস পরিবার
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “কিচেন কেবিনেটের” অন্যতম সদস্য অরূপ বিশ্বাস। অবিবাহিত এই তৃণমূল নেতার ভাতৃবধূ জুঁই বিশ্বাস কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর (বর্তমানে ওয়ার্ড কোর্ডিনেটর) এবং ভাই স্বরূপ বিশ্বাস দীর্ঘদিন দক্ষিণ কলকাতার যুব তৃণমূল সভাপতি হিসাবে এই অঞ্চলের দলীয় রাজনীতিতে শেষ কথা ছিলেন। বিরোধীরা অভিযোগ করেন দাদার প্রশ্রয়ের হাত মাথার ওপর থাকার ফলে স্বরূপ বাবু গোটা টলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
৪) তপসিয়ার খান পরিবার
কলকাতার তপসিয়া অঞ্চলে তৃণমূলের যাবতীয় কর্তৃত্ব জাবেদ খান পরিবারের হাতে সীমাবদ্ধ। জাবেদ খান নিজে রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী এবং তার ছেলে ফইয়াজ আহমেদ খান হলেন কলকাতা কর্পোরেশনের অন্যতম একজন প্রভাবশালী। কাউন্সিলর (বর্তমানে ওয়ার্ড কোর্ডিনেটর)।
৫) তারক সিং পরিবার
দক্ষিণ কলকাতার এই তৃণমূল নেতা দীর্ঘদিনের কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র পারিষদ। বর্তমানে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের অন্যতম প্রশাসক। তার ছেলে ও মেয়ে কলকাতা কর্পোরেশনে তৃণমূল কাউন্সিলর, বর্তমানে ওয়ার্ড কোর্ডিনেটর। একটি পরিবারের বাবা ছেলে ও মেয়ে তিনজনেই দলের অন্যতম পৌর প্রতিনিধি, এই ঘটনা যেমন বিরল উদাহরণ তেমনি রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অন্যতম নমুনা।
তৃণমূলের অভ্যন্তরে পরিবারতন্ত্রের এরকম উদাহরণ আরো অনেক আছে।জেলায় জেলায় এরকম অনেক পরিবার পাওয়া যায় যে পরিবারের একজন তৃণমূলের বিধায়ক ও অন্য আরো দুই-তিন জন সদস্য পৌরসভার বা পঞ্চায়েতের প্রধানসহ আরও নানান প্রশাসনিক দায়িত্বে আসীন। তৃণমূলের পক্ষ থেকে হয়তো দাবি করা হতে পারে উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকেই দল দায়িত্ব দিয়েছে, সে তারা যতই একই পরিবারের মানুষ হোক। কিন্তু এটা মানতেই হবে পরিবারের কোনো একজনের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি থাকলে তার হাত ধরে অন্যরা নিজেদেরকে দলের সামনের সারিতে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে যোগ্য অথচ পারিবারিক ঐতিহ্য নেই এরকম অনেক তৃণমূল কর্মী যে বঞ্চিত হয়েছেন তার ভুরি ভুরি নমুনা সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই ছড়িয়ে আছে।