নিজস্ব সংবাদদাতা: ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন এবং এরপর পঞ্চায়েত ভোট। প্রতিবারই বাংলায় ভোটের সময় উৎসব কম, যুদ্ধ বেশি হয়। তাই তো এখন ভোট উৎসব আর পালন হয় না। বরং ভোটযুদ্ধ হয়। রক্ত, হিংসা, হানাহানি ভোটের সময়ের রোজকার ঘটনা। কিন্তু কেন প্রতিবার রক্তাক্ত নির্বাচন দেখে রাজ্য? বাঙালিকে দেশে ও দুনিয়ার দিকে দিকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিন্যাসে। আগামী পাঁচ বছর শাসকদলের পাকাপোক্ত অবস্থান সমাজের একটি অংশকে রুজি-রোজগারে সুবিধা করে দেবে- এমন ধারণা থেকেই নির্বাচনকালীন হিংসার জন্ম হয়। আর সেই হিংসার সরাসরি ফল রক্তপাত, খুন কিংবা অন্য কোনপ্রকারে মৃত্যু।
বর্তমান সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের এই লাগামহীন রাজনৈতিক হিংসার জন্য দোষারোপ করা যথার্থ। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের মদতপুষ্ট গুণ্ডারা হিংসায় সরাসরি যুক্ত হয়েছে বা হিংসায় ইন্ধন দিয়েছে। কিন্তু এই রাজ্যের রাজনৈতিক হিংসার ইতিহাস শুধু গত ১০ বছরেই সীমাবদ্ধ নয়। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছর এবং তারও আগে কংগ্রেস আমলেও মানুষ রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছে। অতীতের সেই রক্তাক্ত দিনের সাক্ষী মমতা নিজেও। তিনি ভালমতই জানেন, বাংলায় ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে ‘ক্যাডার-রাজ’ একমাত্র রাস্তা।
যুবসমাজকে কর্মসংস্থানের নামে দলের সক্রিয় ক্যাডারে পরিণত করার রাস্তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দেখিয়ে গিয়েছে সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকার। সফল এই পথকে আপন করে নিয়েছেন মমতাও। এলাকায় ক্লাবের অনুদান থেকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ, আমজনতার অধিকার এলাকার বাহুবলী নেতাদের হাতে হস্তান্তরিত করার অভিযোগ উঠেছে বারবার। সেই বাহুবলীরা শাসকদলের স্বার্থরক্ষা করতে নির্বাচনের সময়ে রক্তক্ষয়ী লড়াই বা খুনখারাপিতে সামিল তো হবেই। দশকের পর দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে এই ট্র্যাডিশন চলে আসছে।
রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় খুন-সন্ত্রাস কিংবা রক্তপাত আলাদা মাত্রা পায়। কারণ সেই আঞ্চলিক ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায়, এলাকায় একটি মাছের ভেড়ীর অধিকার কোন পক্ষের হাতে থাকবে, সেটিও ঠিক করে দেয় এই পঞ্চায়েত নির্বাচন। আগামী পাঁচ বছর পেটের ভাত নিশ্চিত করতে প্রতিবেশীর দিকেই কাটারি হাতে তেড়ে গিয়েছে মানুষ- এমন ঘটনাও বিরল নয়। তবে রাজ্য সরকার সেই বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলির হাতে অস্ত্র না তুলে দিয়ে চাকরির চিঠি তুলে দিতে পারলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতে পারত। ভেড়ি দখলে কোনো দলের দিকে তাকিয়ে থাকা বা এলাকার নির্দিষ্ট কোনো বাহুবলী নেতাকে কাটমানি দেওয়ার প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু তেমনটা আগেও হয়নি। এখনও হয় না। তাই ভোট আর উৎসব নেই। তা ভোটযুদ্ধে পরিণত হয়েছে।