সোমবার সপ্তম দফায় রাজ্যের ৩৭ টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট শুরু হয়ে গিয়েছে। এরমধ্যে মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ এবং জঙ্গিপুরে নির্বাচন হবে না প্রার্থীদের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কারণে। অর্থাৎ রাজ্যের 35 টি কেন্দ্রে ভোট হতে চলেছে। মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিম বর্ধমান এবং কলকাতা জেলায় এই পঁয়ত্রিশটি কেন্দ্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সপ্তম দফার নির্বাচন মানে রাজ্যের ভোট পর্ব প্রায় শেষের দিকে এসে হাজির হয়েছে। তবে এই সপ্তম দফাতেও রুপোলী জগত এবং হার্ডকোর রাজনীতিবিদ মিলিয়ে বেশ কিছু তারকা প্রার্থী ময়দানে আছেন। যাদের অনেককে রীতিমতো হেভিওয়েট বলা যায়। আমরা ভোটের সকালে সপ্তম দফার সাত তারকার তালিকা প্রস্তুত করেছি।
১) সায়নী ঘোষ-
টলিউড অভিনেত্রী সায়নী বর্তমান নিউ এজ জেনারেশনের কাছে অন্যতম পরিচিত মুখ। কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় তার জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। অতীতে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজের রাজনৈতিক মনোভাব তিনি প্রকাশ করেছেন। সব সময় প্রগতিশীলতার পক্ষে কথা বলেন এই অভিনেত্রী। অনেকেই মনে করতেন তিনি বোধহয় বামেদের প্রতি দুর্বল। যদিও একুশের নির্বাচনী পর্ব শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে দেখা গেল সায়নী ঘোষ তৃণমূল নেত্রীর হাত ধরে জোড়া ফুল শিবিরে যোগ দিচ্ছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার সায়নীকে দূরের আসানসোল দক্ষিণ কেন্দ্রে প্রার্থী করেছেন। পশ্চিম বর্ধমানের এই কেন্দ্রটি মোটামুটি শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই সপ্তম দফার ভোটে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তারকা প্রার্থী সায়নী ঘোষ। যদিও তার লড়াই খুব একটা সহজ নয়। কারণ আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে বিজেপির প্রভাব ভালোমতো বেড়েছে। সেইসঙ্গে ক্রমশ পিছিয়ে থাকলেও বামেদের প্রভাব একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠন করে এই কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই ত্রিমুখী লড়াইয়ের সায়নী কতটা বাজিমাত করতে পারবেন তা সময় বলবে। তবে তিনি যে প্রচারের আলো অনেকটাই কেড়ে নিয়েছেন তা মানতেই হবে।
২) ঐশী ঘোষ-
সপ্তম দফার ভোটে অন্যতম তারকা প্রার্থী হলেন জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ঐশী ঘোষ। পশ্চিম বর্ধমানের কয়লা খনি অধ্যুষিত জামুরিয়া কেন্দ্রে এই ছাত্রনেত্রীকে প্রার্থী করেছে সিপিআই(এম)। দিল্লির বুকে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবল ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার ফলে রাজ্যব্যাপী তার লড়াকু ভাবমূর্তি আছে। এর পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে জামুরিয়া বামেদের দখলে থাকা একটি আসন। ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনেও এখানে জয়ী হয়েছিল সিপিআই(এম) প্রার্থী।
ভোট প্রচারে ঐশী বেশ ভালই সাড়া ফেলেছেন ফেলেছেন। যদিও পশ্চিম বর্ধমানের অন্যান্য কেন্দ্রের মতো এখানেও বিজেপির সংগঠন ভালোমতো গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই ছাত্রনেত্রীর লড়াই খুব একটা সহজ হবে না। তবে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি অবশ্যই সপ্তম দফার অন্যতম তারকা প্রার্থী। তার জন্য গোটা দেশের নজর এসে পড়েছে জামুরিয়া কেন্দ্রে।
৩) ফিরহাদ হাকিম-
রাজ্য রাজনীতিতে অন্যতম হেভিওয়েট নাম ফিরাদ ‘ববি’ হাকিম। তৃণমূল নেত্রীর অন্যতম আস্থাভাজন এই নেতা একসঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী পদ সামলানোর পাশাপাশি কলকাতা পুরসভার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সঙ্গে তৃণমূলের কোর কমিটির এই সদস্য একাধিক জেলায় দলের পক্ষ থেকে সংগঠন দেখভালের দায়িত্বেও আছেন।
কলকাতা বন্দর কেন্দ্রটি থেকে এবারেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই কেন্দ্রে তার বিরুদ্ধে কংগ্রেস এবং বিজেপির প্রার্থী থাকলেও সত্যি বলতে গেলে ফিরহাদ হাকিম একচেটিয়াভাবে এগিয়ে আছেন। তার কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি এ ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই সঙ্গে রাজ্যের অন্যতম প্রধান সংখ্যালঘুর নেতা তিনি। সব মিলিয়ে সপ্তম দফার ভোটে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তারকা প্রার্থী ফিরহাদ হাকিম।
৪) রুদ্রনীল ঘোষ-
টলিউড তারকা রুদ্রনীল দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার রাজনীতিতে অন্যতম চর্চিত মুখ। একসময় সিপিআই(এম) দলীয় সদস্য হিসেবে মাঠে-ঘাটে রাজনীতি করেছেন তিনি। পরবর্তীকালে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর থেকে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম স্নেহধন্য হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের শাসকদলের নেক নজরে থাকার জন্য কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের কমিশনার হন এক সময়। পরবর্তীকালে রাজ্যের জন পরিষেবা দপ্তরের অন্যতম কমিশনার পদে বসেছিলেন তিনি।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই ধীরে ধীরে তৃণমূলের থেকে দূরে সরতে শুরু করেন এই টলিউড অভিনেতা। পরবর্তীকালে সরাসরি বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তাকে দক্ষিণ কলকাতার বহু আলোচিত কেন্দ্র ভবানীপুরে প্রার্থী করেছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরানো কেন্দ্রটি দখল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে গেরুয়া শিবির। মনে করা হচ্ছে রুদ্রনীলের কারণে এই কেন্দ্রে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই রুদ্রনীল রাজ্যের অন্যতম তারকা প্রার্থী।
৫) শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়-
ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষের বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থী করেছে তাদের দলের বর্ষীয়ান নেতা তথা রাজ্য রাজনীতির অন্যতম পরিচিত মুখ শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে। এই বর্ষীয়ান নেতাকে ভবানীপুরের ময়দানে নামিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেড়ে যাওয়া আসনটি দখলে রাখার চেষ্টা করছে তৃণমূল।
ভবানীপুর কেন্দ্রে রুদ্রনীল এবং শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এই দুই হেভিওয়েটের লড়াইকে কেন্দ্র করে ভোটের প্রচার বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল। রাজনীতির বিভিন্ন যোগ-বিয়োগের খেলায় ভবানীপুর কেন্দ্রে শেষ পর্যন্ত কি ফল হবে আগাম অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের জন্য এই কেন্দ্রে অনেকেরই মতে কিছুটা হলেও অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল।
৬) সুব্রত মুখার্জি-
রাজ্য রাজনীতির এভারগ্রীন ম্যান হিসেবে পরিচিত সুব্রত মুখার্জি। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলে অত্যন্ত কম বয়সে তিনি রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই রাজ্য রাজনীতির অন্যতম আলোচিত মুখ তিনি। দক্ষিণ কলকাতার এই নেতা সম্বন্ধে একসময় মনে করা হতো বামফ্রন্ট সরকার থেকে চলে গেলে সুব্রত মুখার্জি হবেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও একাধিকবার দল পরিবর্তনের কারণে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকটাই টোল খেয়ে যায়। সেই কারণেই রাজ্য রাজনীতির হেভিওয়েট হিসেবে থেকে গেলও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কক্ষপথ থেকে তিনি অনেক দূরে ছিটকে গিয়েছেন।
বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে এবারে হ্যাটট্রিক করার লড়াই লড়ছেন বর্ষীয়ান সুব্রতবাবু। এই কেন্দ্রটি তার হাতের তালুর মতো চেনা। নির্বাচনী লড়াইয়ে তিনি প্রতিপক্ষদের থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে থেকেই দৌড় শুরু করেছেন বলা যেতে পারে। সপ্তম দফার নির্বাচনে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক ওজন এবং দাপটের কথা বিচার করলে সবচেয়ে বড় তারকা তিনিই।
৭) অগ্নিমিত্রা পল-
বাঙালি ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই লাইম লাইটের আলোয় ছিলেন অগ্নিমিত্রা পল। পরে বিজেপিতে যোগ দিয়ে তিনি তাদের রাজ্য মহিলা মোর্চার সভানেত্রী পদ পান। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের এই অন্যতম সেলিব্রেটি-রাজনীতিবিদকে আসানসোল দক্ষিণ কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে বিজেপি।
অগ্নিমিত্রা পলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের আরেক তারকা প্রার্থী সায়নী ঘোষ। এই কেন্দ্রে তৃণমূল এবং বিজেপি দুটি দলই তারকা প্রার্থী দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সপ্তম দফার নির্বাচনে লাইম লাইটে উঠে আসা অন্যতম কেন্দ্র হল আসানসোল দক্ষিণ।
সপ্তম দফার প্রধান সাতজন তারকার তালিকায় না আসলেও অন্যতম আরেকজন তারকা প্রার্থী হলেন ‘গরিবের ডাক্তার’ ফুয়াদ হালিম। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তার প্রতিপক্ষ তৃণমূলের হেভিওয়েট রাজনীতিবিদ সুব্রত মুখার্জি। করোনা কালীন সময়ে মাত্র ৫০ টাকায় সাধারণ মানুষের ডায়ালিসিস করে দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেন ফুয়াদ হালিম। যদিও ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তিনি ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। তবে এবারে বালিগঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রে রাজ্যের এই পরিচিত ডাক্তারকে প্রার্থী করে তৃণমূলকে পাল্টা চাপে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে সিপিআই(এম)।