‘বেকার’…
এমনই একটা শব্দ একটি মানুষ তথা একটা সম্পূর্ণ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। নবীন প্রজন্ম জাতির ভবিষ্যৎ…. আর সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেরুদণ্ড ভঙ্গকারী পদ্ধতি হল ‘বেকারত্ব’।
একটি ছেলে বা মেয়ে ছোট থেকেই একটা স্বপ্ন নিয়ে বড়ো হয়, স্বপার্জিত অর্থে নিজ ও নিজ পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হবে সে। সেই লক্ষ্যে ছোট থেকেই লেখাপড়ায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখা যায়, সে স্বপার্জনে যখন ব্যর্থ হয়, এমতাবস্থায় পারিবারিক, সামাজিক ও সাংসারিক চাপ তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
প্রতিদিন বাবা মায়ের প্রশ্নবান অথবা অন্য কারো সাথে তুলনা…. অমুকের ছেলেটা চাকরি পেয়ে গেল রে, তুই কি আর…..??? মনে মনে অবক্ষয়িত হতে থাকে সে। এরপর হয়তো বা একদিন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, নয়তো সমাজবিরোধী কোনো পথ, নয়তো বাড়িতে ফেরাই সে বন্ধ করে দেয়।
একটি শব্দ…’বেকারত্ব‘…মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারে সব কিছু। এর প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উৎসাহী মনোভাব।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যে কোনো মানুষ ছেলেদের দেখলেই প্রশ্ন করে… “তুমি কী করো?” আর মেয়েদের দেখলেই তাদের স্বাভাবিক প্রশ্ন…”বিয়ে হয়েছে তো? ছেলে কী করে?”
যদিও আগের চেয়ে পরিবর্তন হয়েছে সমাজব্যবস্থা। এখন ছেলে মানেই চাকরি ও মেয়ে মানেই চাকরিওয়ালা ছেলের সাথে বিয়ে, এর বাইরে বের হয়েছে কিছু শতাংশ মানুষ। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ এখনো এর উপরে ভিত্তি করেই চলছে।
স্বাভাবিক এই দুটি প্রশ্ন একটি ছেলে বা একটি মেয়ে, যে ছোট থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে বড় হয়ে উঠেছে …তাদের পক্ষে মারাত্মক অবমাননাকর।
বর্তমানে একটি ছেলে বা মেয়ে পাশ করে থেকেই সার্টিফিকেট ও সিভি ফটোকপি করে, দৈনিক পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতে থাকে, সাপ্তাহিক চাকরির পত্রিকা কেনে, অনলাইন ফর্ম ফিল আপ করতে থাকে। আর যখন যেখানে চাকরির পরীক্ষা হয় দৌড়ে দৌড়ে সেসব জায়গায় গিয়ে ধর্ণা দেয়। কিন্তু চাকরি যেন ডুমুরের ফুল হয়ে গিয়েছে। তার নাম শোনা যায়, কিন্তু তার নাগাল পাওয়া যায় না।
এ ক্ষত্রে একটা ছেলে হামেশাই শুনতে থাকে, ‘আর কতদিন বাবার পয়সায় গিলবে? এবারে নিজে উপার্জনের ব্যবস্থা করো!’
আর একটা মেয়েও যে স্বনির্ভর হবার স্বপ্নে বিভোর। তাকে কেউ তার চাকরি বিষয়ে প্রশ্ন না করে তার বিয়ে ও তার সাথে তার হবু স্বামী কী চাকরি করে এমন প্রশ্ন করে…
সেটা যথেষ্ট অবমাননাকর।
বেকারত্ব এক সমাজিক ব্যাধি:-
বেকারত্ব এক সমাজিক ব্যাধি। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেরুদণ্ড কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে তাকে পঙ্গু করে দেয়।
বর্তমানে শুধু মেধা ও যোগ্যতা থাকলেই চাকরি হয় না। এর জন্য লাগে সুপারিশ, লাগে তদ্বির, লাগে ঘুষ, লাগে তেল দেবার ক্ষমতা থাকা। যার এগুলো নেই, সে বঞ্চিতের দলে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
‘নো ভ্যাকান্সি’ শুনতে শুনতে একজন ছেলে বা মেয়ের আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকে। তারপরে এতদিনের কষ্ট করে অর্জন করা সার্টিফিকেটগুলো যখন কিছু স্বার্থলোভী মানুষ নাড়াচাড়া করে বলে…
‘এই! এতে শিকে ছিঁড়বে না! নেক্সট!!!’ কেমন যেন শূন্য মনে হয় জীবনটা তাদের। বরাবর নব্বই শতাংশ নম্বর পেয়ে আসা ছেলে বা মেয়েটির বিচার হয় তার পকেটের নিক্তিতে, তার পারিবারিক প্রেক্ষাপটের নিক্তিতে, তার রাজনৈতিক কোন তকমা আছে কিনা সেই নিক্তিতে….এর পরেও কি মনোবল স্থির করে রাখা যায়?
নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে না পারার চাপ, বাড়িতে বাবা মায়ের চাপ, বাইরে প্রেমিক- প্রেমিকার চাপ, আর কর্ম সন্ধান ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের মানসিক চাপ… এত চাপে চাপে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চিড়ে চ্যাপ্টা হতে হতে বেঁচে থাকে, আর যারা পারে না তারা রেললাইনে ঝাঁপ দেয়, নবান্নের সামনে গায়ে আগুন দেয়, নীরবে প্রেমাস্পদকে অন্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়, ড্রাগে আসক্ত হয়ে… মোটকথা শেষ হয়ে যায় সম্ভবনা।
পরিসংখ্যান:-
রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যতম শাখা সংস্থা ILO (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন) তাদের বার্ষিক ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট সোশ্যাল আউটলুক -ট্রেন্ডস এর রিপোর্টে প্রকাশ করে!
ভারতে বিগত তিন বছরের পরিসংখ্যান…
২০১৭ র শেষে মোট ১.৮৩ কোটি বেকার ছিল৷
২০১৮ র বেকার সংখ্যা ১.৮৬ কোটি হয়েছে
এবং ২০১৯ সালে ওই সংখ্যা হবে ১.৮৯ কোটি৷
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর, এই চার মাসে শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৫ শতাংশ।
তাহলে আমরা দেখছি, দেশে লাফিয়ে বাড়ছে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের বেকারত্বের হার। কাজ করতে সক্ষম কিন্তু বেকার, এরকম শিক্ষিত ছেলে-মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেই পরিমাণে কাজের পরিধি বাড়ছে না।
প্রতিবছর বেকারত্ব উত্তরোত্তর বাড়ছে আর তার প্রভাবে মানসিক ভাবে, শারীরিক ভাবে, আর্থিক ভাবে ভেঙে পড়ছে সমাজের কাঠামো তথা যুবসমাজ।