ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা আর পরম্পরার পবিত্র ভূমি ভারত। বৈদিক ধর্মের পীঠস্থান। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাত থেকে বঙ্গ – প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। আয়তনের দিক থেকে সপ্তম এবং জনসংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। স্বাভাবিকভাবেই ভারতে প্রাচীন এবং দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। এর সব কটির সঙ্গে লেগে আছে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। জড়িয়ে আছে পবিত্রতার স্পর্শ।
উত্তরে বরফে মোড়া হিমালয় থেকে দক্ষিণে নীল জলরাশি, গ্রীষ্মমণ্ডলের শ্যাম শোভা বিজড়িত কেরল থেকে সবুজ মখমলের বাংলা, বৃষ্টি বিধূরিত চেরাপুঞ্জি থেকে মরুভূমির রুক্ষতায় রাজস্থান – ভারত যেন এক টুকরো পৃথিবী। আমরা এখানে আলোচনা করলাম ভারতের ৫ দর্শনীয় স্থান নিয়ে যা মুগ্ধ করে গোটা বিশ্বকে।
১। অজন্তা ও ইলোরা – একই সঙ্গে ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় স্থান। গুহার দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের বর্ণপরিচয়। অতীতের শিল্পীরা আদরে আর শ্রমে এঁকে রেখেছেন শিল্পের সহজপাঠ। মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। হিন্দু ধর্মের ১৭টি, বৌদ্ধ ধর্মের ১২টি এবং জৈন ধর্মের ৫টি প্রাচীন মন্দির রয়েছে এখানে। রাষ্ট্রকুট রাজবংশের সময়কালে নির্মাণ করা হয়েছিল এই স্থাপত্যগুলি। সব ধর্মের উপাসনালয়ের এই সহাবস্থান সে যুগে ভারতবর্ষের ধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন বহন করে। প্রায় ২ হাজার বছরের প্রাচীন এই গুহাগুলি বহুকাল জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে থাকার পর ১৮১৯ সালে নতুন করে আবিষ্কৃত হয়৷
২। বারাণসী – প্রায় ৪ হাজার বছরের প্রাচীন নগরী বারাণসী। মার্ক টোয়েন এই শহরকে ‘ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মানুষদের কাছে পবিত্র স্থান। পৌরাণিক মতে বারাণসী শহরের পত্তন করেন সুহোত্রের পুত্র কাস্য। তাই বারাণসীর অপর নাম কাশী। এখানে আছে ১৭৮০ সালে নির্মিত কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, কাল ভৈরব মন্দির, সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির, দুর্গা মন্দির এবং অন্নপূর্ণা মন্দির-সহ আরো বিভিন্ন মন্দির। আর গঙ্গা ছাড়া বারাণসীকে কল্পনা করাই অসম্ভব। রয়েছে মনিকর্ণিকা ঘাট৷ গঙ্গার ধারের এই শ্মশানে শেষকৃত্য হলে নাকি অক্ষয় স্বর্গবাস, এমনই বিশ্বাস হিন্দুদের৷ বারাণসী মানে শুধু ধর্ম নয়, পেটপুজোও৷ বিখ্যাত কাশীর প্যাঁড়া, রাবড়ি আর কচুরি-জিলিপি। আর বেনারসি শাড়ির তো বিশ্ব জোড়া খ্যাতি।
৩। অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির – স্বর্ণ মন্দির নামে পরিচিত হলেও এর আসল নাম শ্রী হরমন্দির সাহিব (যার অর্থ ঈশ্বরের মন্দির)। শিখদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান (যদিও অন্যান্য ধর্মের মানুষও এখানে আসে)। ১৫৭৭ থেকে ১৬০৪ খ্রীষ্টাব্দে মন্দিরটি শিখদের ৫ম গুরু, গুরু অর্জন দেব নির্মান করেছিলেন। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আফগান আক্রমণে মন্দিরটির কিছুটা অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যা ১৭৬৪ সালে পুর্নস্থাপিত হয়। এর দুই শতাব্দী পরে ১৮৩০ সালে ১৬২ কেজি সোনা দিয়ে গোটা মন্দিরটি মুড়ে দেন মহারাজা রঞ্জিত সিং। সেই সময় খরচ হয়েছিল ৬৫ লাখ টাকা। সেই থেকেই নাম স্বর্ণ মন্দির। ১৯৯০ সালে ৫০০ কেজি সোনা দিয়ে পুনঃআবরণ করা হয়েছিল এই মন্দির। আজকের হিসাবে যার মূল্য ১৪০ কোটি টাকা। এই মন্দিরে লঙ্গরে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিদিন খাওয়ানো হয় ১ লাখ মানুষকে।
৪। কর্ণাটকের হাম্পি – তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে এই প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ ভারতের এক সময়ের ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি ও বীরগাথার দলিল ধরে রেখেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পৃথিবীর অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলির মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে কর্ণাটকের হাম্পি-কে। বাহমনি রাজ্যের সুলতান দীর্ঘদিন ধরে বিজয়নগরকে লুট করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। হাম্পি জুড়ে ছড়িয়ে আছে তৎকালীন স্থাপত্যের সব ধ্বংসাবশেষ। মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে গ্রানাইট পাথরের তৈরি একটি সুবিশাল রথ। তার গায়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য। যেটি মুদ্রণ করা ভারত সরকারের নতুন ৫০ টাকার নোটে। রয়েছে মিউজ়িক টেম্পল। একক পাথরের তৈরি বিশালাকার ১৬টি স্তম্ভ ধরে আছে মন্দিরের ছাদ। কান পেতে আঘাত করলেই শোনা যায় সরগমের সপ্তসুর। মন্দির চত্বরের কিছুটা পূর্ব দিকে রয়েছে কিং ব্যালান্স। সেখানে নাকি রাজারা নিজের সমান ওজনের সোনাদানা মণি-মুক্তো ওজন করে দান করতেন ব্রাহ্মণ ও গরিবদের মধ্যে। দেখা যায় রামায়ণ বর্ণিত হনুমানের জন্মস্থান অঞ্জনী পর্বতও।
৫। আগ্রার তাজমহল – বেগম মমতাজের স্মৃতিতে ১৬৫৩ সালে এটি নির্মাণ করেন তৎকালীন মুঘল সম্রাট শাহ জাহান। ফরাসি প্রভাব ও রুচিময় নকশার ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুঘল সাম্রাজ্য শৈলীর নকশা সমগ্র ভবনটিতে রয়েছে। বেশিরভাগ অংশই সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি। সঙ্গে সূক্ষ্ম পাতলা পুষ্পশোভিত সাজসজ্জা এবং মূল্যবান জেড, ল্যাপিস লজুলি, হীরা এবং মুক্তো খচিত। তাজমহলের পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন সুন্দর প্রাসাদ, পুকুর এবং গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের সঙ্গে বিস্তৃত শোভাময় বাগানও রয়েছে। এটি বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যগুলির মধ্যে অন্যতম।