ভারতবর্ষ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, বিভিন্ন ধর্মের বসবাস এই ভারতে এবং মানুষের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বতন্ত্র পার্থক্যই হল ধর্ম। ভারতের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বারংবার নানান ধর্ম প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। বিভিন্ন পিরিয়ডে ভারতের নানান স্থানে গড়ে উঠছে আলাদা আলাদা সব ধর্মের প্রতীকি ধর্মস্থান গুলি।
এই দেশে হিন্দুদের সংখ্যা বেশী হওয়ার দরুন প্রচুর মন্দির আমরা প্রায়সই দেখে থাকি, কিন্তু ভারতের ইতিহাসে এমন ঐতিহ্যবাহী অনেক গীর্জা বা চার্চ আছে যাদের কথা হয়ত অনেকেরই অজানা! তাই ভারতের বিখ্যাত 10 টি চার্চ সম্বন্ধে বিশদে জানতে অবশ্যই পড়ুন আজকের এই বিশেষ প্রচ্ছদটি।
ভারতবর্ষ এর তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম খ্রিস্টান, ইতিহাসনুসারে, 52 AD তে কেরলের মালাবার কোষ্টে থমাস নামে এক খ্রিস্টান ভারতে এই ধর্মের প্রবর্তন শুরু করেন। ক্রমশ কেরল থেকে শুরু করে গোয়া, তামিলনাড়ু ইত্যাদি ভারতের অন্যান্য জায়গা গুলিতে এই ধর্মের প্রতীকি গীর্জা বা চার্চ গুলি একের পর এক নির্মান করা হয়। বর্তমানে ভারতে শতাধিক চার্চ নির্মিত হয়েছে, তার 10 টি বিখ্যাত চার্চের কথা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এই চার্চ গুলি ভারতবর্ষ এর ইতিহাসে স্বতন্ত্র ভাবে ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রাখে।
1. ব্যাসিলিকা অফ বম্ জেসাস (Baslica of Bom Jesus), গোয়া:
ভারতবর্ষ এর বিখ্যাত এবং পুরোনো চার্চ গুলির মধ্য অন্যতম হল এই ব্যাসিলিকা অফ বম্ জেসাস চার্চটি। এটি একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ যেটি গোয়ায় অবস্থিত। কোন এক সময়ে এই গোয়াই ছিল পর্তুগীজদের রাজধানী এবং এই গীর্জাটি পর্তুগীজ উপনিবেশিক স্থাপত্যের অন্যতম সেরা উদাহরণ হিসাবে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে এও উল্লেখ্য এই গীর্জাটি পর্তুগীজদের তৈরী স্থাপত্য গুলির মধ্যে সাতটি আশ্চর্যের একটি। 1594 সালে এই চার্চটির নির্মান শুরু হয় এবং 1605 নির্মান কাজ সুসম্পন্ন হয়। চার্চটির অন্দরের কারুকার্য এবং মার্বেলের কাজ পর্যটকদের কাছে অতিসয় চমকপ্রদ। এই গীর্জার অন্যতম আর্কশন এই গীর্জাতে মমি বানিয়ে রাখা হয়েছে খ্রিস্টান পাদ্রী ফ্রান্সিস জাভিয়রের মৃতদেহকে। এছারাও এই চার্চটিতে একটি সংগ্রহশালাও আছে যেখানে এই চার্চটির ইতিহাসের সাথে জরিয়ে থাকা বিভিন্ন বস্তু সাজিয়ে রাখা রয়েছে এবং এই গীর্জাটি এখন UNESCO র তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
2. ক্রাইস্ট চার্চ (Christ Church), সিমলা:
ভারতবর্ষ এর উত্তরের হিমাচল প্রদেশে রাজধানী সিমলাতে অবস্থিত আরেকটি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবেষ্ঠিত গীর্জা হল ক্রাইস্ট চার্চ। সিমলা শহড়টির ঠিক মাঝখানে 1857 সালে এই চার্চটি নির্মিত হয়। এই গির্জাটি নিওগথিক স্টাইলের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত সিমলার একটি বিশিষ্ট নিদর্শন। এই চারচটিতে 5টি সূক্ষ্ম কাচের তৈরী জানালা আছে এবং এই প্রতিটি জানলা খ্রিস্টানদের 5টি প্রধান গুণাবলী যথা বিশ্বাস, দাতব্যতা, আশা, ধৈর্য এবং নম্রতা র প্রতীক। ভারতের বৃহত্তম পাইপ অর্গান নামক বাদ্য যন্ত্রটি 1899 সালে এই চার্চটিতে স্থাপিত হয়।
3. সেন্ট পল্ ক্যাথিড্রাল (St. Paul’s Cathedral), কোলকাতা:
ভারতবর্ষ র আরেকটি বিখ্যাত চার্চ হল পশ্চিবঙ্গের কোলকাতায় অবস্থিত সেন্ট পল্ ক্যাথিড্রাল চার্চ। এই চর্চটি গথিক পুনর্জাগরণ শৈলীতে তৈরি করা হয়েছে। 1839 সালে এই চার্চটির নির্মান কার্য শুরু হয় এবং 1847 সালে শেষ হয়। বিভন্ন মতানুসারে এই চার্চটিই হল এশিয়ার প্রথম এপিস্কোপ্যাল চার্চ। এই গীর্জাটিকে কলকাতায় ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে “আকর্ষণীয় দ্বীপ” নামে অভিহিত করা হয়। এই গীর্জাটিতে ক্রিসমাসের সময় বিপুল সংখ্যক ভীড় বিশেষ ভাবে লখ্যণীয়। এই চার্চ এ সমাধি স্থলে ক্যাথিড্রালের প্রতিষ্ঠতা বিশপ ড্যানিয়েল উইলসন এবং অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি জন্ প্যাক্সটন নরম্যানের সমাধি অবস্থিত রয়েছে। পুরো চার্চটিতে কাচের জানালায় অসাধারন ফ্রেস্কো র কাজ অসামান্য শিল্প কলার প্রতীক।
4. ফ্রান্সিস চার্চ (Church of Saint Francis), কোচি:
ভারতবর্ষ র দক্ষিনে কেরালার কোচিতে অবস্থিত এই চার্চটি। কেরালার এই সেন্ট ফ্রান্সিস গীর্জার আকর্ষণীয় ইতিহাসের পাশাপাশি এর অবিশ্বাস্য স্থাপত্যের কাজ পর্যটকদের বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করে, বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে পর্যটকদের ভীড় জমাতে দেখা যায়। এই জায়গাটিতে একসময় প্রখ্যাত এক্সপ্লোরার ভাস্কো দা গামার মূল অবশেষ রাখা ছিল তবে তার দেহাবশেষ 14 বছর পরে ফিরে নেওয়া হয়েছিল লিসবন শহড়ে, কিন্তু এখনও তার সমাধিস্থানের সঠিক স্থানটি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা আছে এই চার্চটিতে। এর স্থাপত্যটি পর্তুগিজ, ডাচ এবং ব্রিটিশ প্রভাবগুলির এক দুর্দান্ত মিশ্রণকে প্রতিফলিত করে। এই গীর্জাটির বিশিষ্ট বৈশিষ্ঠ হ’ল গাবিত টাইমার ফ্রেমযুক্ত ছাদ এবং চ্যান্সেল ছাদের উপরে বসে দুটি স্টেপড চূড়া। 1904 সালের সুরক্ষিত স্মৃতিসৌধ আইন অনুসারে চার্চটিকে 1933 সালের এপ্রিল মাসে এটি সুরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে ঘোষণা করা হয়, বর্তমানে চার্চটি, ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে রয়েছে।
5. সেন্ট থমাস ক্যাথেড্রাল ব্যাসেলিকা (St. Thomas Cathedral Basilica), চেন্নাই:
দক্ষিণ ভারতের আরেকটি বিখ্যাত চার্চ হল তামিল নাড়ুর চেন্নাই অবস্থিত সেন্ট থমাস ক্যাথেড্রাল ব্যাসেলিকা। ভারতবর্ষ এর ঐতিহাসিক চার্চ গুলির মধ্যে এই চার্চটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যীশুর বারোজন প্রেরিতদূতদের মধ্যে অন্যতম সেন্ট থমাসের সমাধির ওপরে 16 শতাব্দিতে এই গীর্জাটি নির্মিত হয় তবে পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা 19 শতাব্দিতে নিও গথিক ভঙ্গিতে এই চার্চটির পুনর্নির্মাণ করেন। এই চার্চটির উচ্চতা প্রায় 210ft এবং গীর্জার অভ্যন্তরীণ দেওয়াল গুলি পেইন্টিং এবং সুদৃশ্য ফ্রেস্কো দিয়ে সুন্দরভাবে সজ্জিত। এছারা চার্চটির ভেতরে অবস্থিত সংগ্রহশালাটি পর্যটকদের আকর্শন দ্বিগুন করে তোলে।
6. সেন্ট ফিলোমেনার ক্যাথেড্রাল (St. Philomena’s Cathedral), মহীশূর:
ভারতবর্ষ র বৃহত্তম চার্চ হিসেব গন্য করা হয় কর্ণাটকের মহীশূরে অবস্থিত এই গীর্জাটিকে, এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম চার্চ হিসাবেও পরিচিত। এই গীর্জাটি নিও গথিক স্টাইল ব্যবহার করে 1936 সালে নির্মিত করা হয় এবং এর স্থাপত্যটি জার্মানির কোলোন ক্যাথেড্রাল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকদের ধরনা। চার্চটিতে প্রায় 800 জনের আবাসনের সুব্যবস্থা রয়েছে এবং খ্রিস্টের জীবনের বিভিন্ন স্তর যথা তাঁর জন্ম, দ্য লাস্ট স্যাপার ও ক্রুশবিদ্ধকরণ সহ সুন্দর চিত্রগুলি প্রদর্শন করা রয়েছ গীর্জার অন্দরমহলে। গির্জার স্তম্ভগুলিও দুর্দান্ত ফুলের নকশায় সুসজ্জিত রয়েছে। বহু চল্লচিত্রে এই চার্চটি প্রায়শই দেখা যায় যেমন 1977 র বিখ্যাত হিন্দি ছবি ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’ র চার্চের দৃশ্যটি এই চার্চের ভিতরেই শুট করা হয়েছিল।
7. সেন্ট জোসেফের ক্যাথেড্রাল (St Joseph’s Cathedral), হায়দরাবাদ:
ভারতবর্ষ র সেরা গীর্জা গুলির মধ্যে হায়দরাবাদে অবস্থিত সেন্ট জোসেফের ক্যাথেড্রাল র নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এটি একটি রোমান ক্যাথোলিক চার্চ। গীর্জাটির ভেতরে প্রায় 500 লোকের থাকার ব্যবস্থা করা আছে। এই চার্চটির মূল আকর্শন হল চার্চটির মাথার ওপরে 1892 সালে স্থাপিত 5 টি ঘন্টা গুলি। এই গীর্জাটির বেল-টাওয়ারের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে, শহরের চমকপ্রদ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। 1892 সালে ইতালী থেকে এই ঘন্টাগুলি আনাহয়, এখানে ঘন্টাগুলি এমনভাবে ধ্বনিত হয় যে বিভিন্ন খ্রিস্টান স্তব বিশেষত আওয়ার লেডি “আভে মারিয়া” এর স্তবগান বিভিন্ন থিমে শোনা যায়। গীর্জার অভ্যন্তরের প্রধান অ্যালকোভে, মাইকেলানজেলো দ্বারা বিখ্যাত ভাস্কর্য Pietà র অনুকরণ রয়েছে।
8. অল্ স্যান্ট ক্যাথেড্রাল (All Saints Cathedral), এলাহাবাদ:
দক্ষিণ ভারত ঘুরে এবার আসি উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে অবস্থিত অল্ স্যান্ট ক্যাথেড্রাল এ, ভারতবর্ষ র প্রাচীনতম চার্চের মধ্যে অন্যতম হল এই আলোচ্য গীর্জাটি। এই ক্যাথেড্রাল হ’ল গিথিক স্টাইল অফ আর্কিটেকচার দ্বারা অনুপ্রাণিত গীর্জার মধ্যে একটি যা 13 শতকে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে নির্মিত, কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রধান নকশাকার ব্যক্তি ব্রিটেনের প্রখ্যাত স্থপতি স্যার উইলিয়াম এমারসন এই গীর্জাটির নকশা তৈরী করেন 1871 সালে। গীর্জাটিতে প্রায় 400 জন লোক থাকার ব্যবস্থা আছে। ক্যাথেড্রালের কাঁচ ও মার্বেলের কাজগুলি 125 বছরেরও বেশি সময় পরেও পুরোপুরি রক্ষিত রয়েছে, এছারা ক্যাথেড্রালটিতে অনেকগুলি ফলক রয়েছে যাতে ভারতের বিভিন্ন ব্রিটিশ নাগরিকের মৃত্যুর ছবি চিত্রিত আছে।
9. ইম্যাকুলেট কনসেপশন ক্যাথেড্রাল (Immaculate Conception Cathedral),পন্ডিচেরি:
ভারতবর্ষ এর কেন্দ্র শাসিত রাজ্য দক্ষিণের পন্ডিচেরিতে এই চার্চটি অবস্থিত। এখানে এই গীর্জাটি ‘সাম্বা কোভিল’ নামে পরিচিত যেখানে ‘কোভিল’ কথাটির অর্থ হল চার্চ। 1791 সালে এই গীর্জাটি নির্মিত হয় এবং এই চার্চটির সাথে ফ্রান্সের একটি গীর্জার বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। এটি ভারতের ঐতিহ্যময় ইতিহাসে ফরাসি স্থাপত্যের একটি চিত্তাকর্ষক উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। পন্ডিচেরির বিভিন্ন পর্যটন স্থান গুলির মধ্যে এটি একটি এবং পন্ডিচেরি ভ্রমনের সময় মাদার টেরেসা এই চার্চটি পরিদর্শনে এসেছিলেন।
10. সেন্ট মেরি চার্চ (St. Mary’s Church), তিরুভিথামকোড:
ভারতবর্ষ র তামিলনাড়ু রাজ্যের কন্যাকুমারী জেলার তিরুভিথামকোডে অবস্থিত এটি একটি অর্থোডক্স চার্চ। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এটি বিশ্বাস যে এটি ভারতের প্রাচীনতম গীর্জা যেটি 57 AD তে সেন্ট থমাসের দ্বারা নির্মিত হয় এবং 2007 র 16 ডিসেম্বর, মালানকার মেট্রোপলিটন, এটিকে একটি আন্তর্জাতিক সেন্ট থমাস তীর্থযাত্রা কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণাও করেছে। এটি ভারতের প্রাচীনতম গীর্জা যা এখনও অবধি পুনর্গঠন করা হয়নি। সমগ্র গীর্জাটি তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত রয়েছে এবং এর দেয়ালগুলি স্থানীয় পাথর দ্বারা নির্মিত, একটি মাল্টি-টিপড চিসেল দিয়ে যুক্ত, এটি কেরালায় পরিচিত একটি প্রযুক্তি যা সম্ভবত 16 শতাব্দীতে বিদেশী যোগসূত্রের মাধ্যমে ভারতে আসে। বর্তমানে গীর্জার রক্ষণাবেক্ষণ মালানকারা অর্থোডক্স সিরিয়ান চার্চ দ্বারা করা হয়ে থাকে।
উপোরোক্ত আলোচ্য গীর্জা গুলি ছারাও ভারতবর্ষ এ অগনিত ঐতহ্যবাহী চার্চ রয়েছে, বিশেষ করে গোয়া এবং কেরলের চার্চগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। সেই সব চার্চগুলির কথা না হয় আরেকদিন হবে। আজকের এই প্রচ্ছদটি কেমন লাগলো অবশ্যই জানান আমাদের কমেন্ট বক্সে।
আরও পড়ুন: