সেই যে ব্রিটিশরা আমাদের ‘চা’র নেশা ধরিয়ে ছিল তারপর থেকে জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে এই পানীয়টি। অনেকে নেশা বললে মদ সিগারেটের কথা ভাবেন, কিন্তু চা যে নিজেই একটি নেশা তা তারা বিশ্বাস করতে চান না নিজেদের সরলতার কারণেই! অনেকেই আছেন সকালে উঠে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে চোখ বোলান। সকালে উঠে যদি এই গোটা ব্যাপারটা না ঘটে তবে চা খোরদের মেজাজ একেবারে বিগড়ে যায়!
খবরের কাগজ অর্থাৎ সংবাদপত্রের সঙ্গে কতজনের যে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার ইয়াত্তা নেই! ঐতিহাসিকরা মনে করেন রোমান সম্রাটদের বার্তা লেখা প্রস্তর ফলকগুলিই হল সংবাদপত্রের আদি রূপ। এগুলোকে বলা হতো ‘অ্যক্টা দিউরমা’। রোমান সম্রাটদের বিভিন্ন নির্দেশ বা বিধান রাজ কর্মচারীরা ছোট ছোট পাথরের ফলকে খোদাই করে রোম সাম্রাজ্যের নানা স্থানে টাঙিয়ে রাখত যাতে প্রজারা সেই নির্দেশগুলি সহজেই জেনে যেতে পারে।
রোম সাম্রাজ্যের অ্যক্টা দিউরমার যা লক্ষ্য তার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় সংবাদপত্রের ভূমিকা। তবে আধুনিক সংবাদপত্রের প্রচলন প্রথম চীনে শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। অষ্টম শতাব্দীতে চীনের রাজার নির্দেশে রাজদরবার থেকে ‘কাইয়ুয়ান ঝাও-বা’ অর্থাৎ ‘আদালতের বার্তা’ নামে প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র বের হওয়া শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে সংবাদপত্র ছিল স্বাভাবিক ভাবেই হাতের লেখা। তারপর ধীরে ধীরে সময় গড়াতে গড়াতে মধ্যযুগে পৌঁছে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক গুটেনবার্গ প্রথম ছাপাখানার ব্লক আবিষ্কার করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই সংবাদপত্র ব্লকের মাধ্যমে ছাপানো শুরু হয়ে যায়।
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে সংবাদপত্র প্রবেশ করে অফসেট যুগে। তারপর দ্রুত ভোল বদল হয় তার। কম্পিউটার প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বর্তমানে আধুনিক ডিজিটাল প্রিন্টিং ব্যবস্থার মাধ্যমে সংবাদপত্র ছাপানো হয়। তবে আমাদের অনেকের যতই অভ্যেস থাক সকালে উঠে সংবাদপত্র পড়ার, কালের নিয়মে ছাপানো সংবাদপত্রের দুনিয়া বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। বেশকিছু পরিচিত সংবাদপত্র ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ এখন সময় ডিজিটাল মাধ্যমের। তাই মানুষও ডিজিটাল মাধ্যমেই খবর পড়ে নিতে চায়।
স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানেই সংবাদপত্রের জায়গা অনেকটাই দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত সংবাদপত্র বাধ্য হয়ে ছাপা খবরের কাগজে বের করার পাশাপাশি নিউজ পোর্টাল খুলেছে। গোটা সংবাদ দুনিয়ার যখন এই অবস্থা, তখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় হাতে লেখা সংবাদপত্র কি এখনো পড়েন আপনি? নিশ্চয়ই ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাবেন বা ভাববেন প্রশ্নকর্তার মস্তিষ্কে কোনো গণ্ডগোল আছে বলেই এই প্রশ্ন করছে!
কিন্তু না, এখনো একটি দৈনিক সংবাদপত্র আছে যেটি হাতে লেখা! নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে গেলেন? তাহলে শুনুন এই সংবাদপত্রটি প্রকাশ হয় ভারত থেকেই। চেন্নাইয়ের ‘দ্য মুসলমান’ হল সেই হাতে লেখা দৈনিক সংবাদপত্র, যেটি গত ৯৩ বছর ধরে একই ভাবে প্রকাশ হয়ে আসছে!
১৯২৭ সালে সৈয়দ আজহাতুল্লাহ এই সংবাদপত্রটি প্রকাশ করেন। সেই সময়ে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক সংবাদপত্র প্রকাশিত হলেও তার কোনোটিই মুসলমান সম্প্রদায়ের খবরের দিকে বিশেষ নজর দিত না। এই খামতি পূরণ করতে সৈয়দ আজহাতুল্লাহ হাতে লিখে উর্দু ভাষায় দ্য মুসলমান নামে দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করা শুরু করেন। তিনিই ছিলেন এর সম্পাদক।
সৈয়দ আজহাতুল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র সৈয়দ ফাজলুল্লাহ পত্রিকাটির হাল ধরেন। ২০০৮ সালে তিনি মারা গেলে তার পুত্র সৈয়দ আরিফুল্লাহ দ্য মুসলমানের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আরিফুল্লাহ এই হাতে লেখা সংবাদপত্রের সম্পাদকের ভূমিকা পালন করছেন। জানা গিয়েছে আরিফুল্লাহ নিজেই পত্রিকার যাবতীয় সংবাদ নির্বাচন করে থাকেন।
চার পাতার এই সংবাদপত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হল এর ‘ক্যালিগ্রাফি’। কলমের সাহায্যে হাত দিয়ে সুন্দর ডিজাইন করে লেখাকেই ক্যালিগ্রাফি বলা হয়। প্রতিদিন একটি বড় কাগজে তিনজন অতি দক্ষ ক্যালিগ্রাফার নির্দিষ্ট ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে পত্রিকাটির সমস্ত সংবাদ লেখেন। চেন্নাই ছাড়াও ভারতের নানা প্রান্তে এই পত্রিকাটির সংবাদদাতারা ছড়িয়ে আছেন। তবে হাতে লেখা এই উর্দু সংবাদপত্রটির প্রধান প্রতিবেদক চিন্নাস্বামী সুব্রামানিয়ান।
দ্য মুসলমানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এটি আর পাঁচটা সংবাদপত্রের মতো সকালবেলায় প্রকাশ হয় না, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় পাঠকরা এই সংবাদপত্র হাতে পান! তার কারণ হচ্ছে বর্তমান ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহার না করে যেহেতু প্রতিটি সংবাদ, তাই সময় বেশি লাগে। স্বভাবতই এই কারণে সংবাদপত্র প্রকাশে দেরি হয়।
সবচেয়ে আশ্চর্য করা বিষয় আমরা যখন ছাপানো খবরের কাগজের বদলে ডিজিটাল মিডিয়ার নিয়ে বর্তমানে বেশি আগ্রহী, তখন সম্পূর্ন স্রোতের বিপরীতে হাঁটা এই সংবাদপত্রটির দৈনিক পাঠক সংখ্যা ২২ হাজারেরও বেশি! মূলত ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত খবর সংবাদপত্রের নির্দিষ্ট চারটি পাতায় ঠাঁই পায়। উর্দু ভাষায় প্রকাশ পেলেও কেবলমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা যে এই সংবাদপত্রের পাঠক তা কিন্তু নয়, অনেক হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষও দ্য মুসলমানের নিয়মিত পাঠক।
দ্য মুসলমান কেবলমাত্র যে একটি হাতে লেখা সংবাদপত্র হিসাবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সফল হয়েছে তাই নয়, এই সংবাদপত্রটি বিলুপ্ত হতে বসা ক্যালিগ্রাফি শিল্পকেও অক্সিজেন দান করেছে। কারণ ডিজিটাল প্রিন্ট মিডিয়া আসার ফলে এখন আর হাতে করা নকশা বা লেখার সেরকম কোনো চাহিদা নেই। এই পরিস্থিতিতে একটি সংবাদপত্রে গত তিরিশ বছর ধরে তিনজন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী নিরলসভাবে তাদের কাজ করে চলেছেন তা সত্যিই উল্লেখ করার মতো বিষয়।
বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা সংবাদপত্র দ্য মুসলমানের দৈনিক মূল্য মাত্র পঁচাত্তর পয়সা! এত কম মূল্যে আর কোনো সংবাদপত্র বর্তমান সময়ে পাওয়া যায় না। আগামী দিনেও দ্য মুসলমান ঐতিহ্যকে ধরে রেখেই তার অস্তিত্ব সফলভাবে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে এই আশাই রাখি আমরা।