ব্রিজ বা ওভারব্রিজের সৃষ্টি শহরের ব্যস্ততম রাস্তা গুলির যানজট কাটানোর উদ্দেশ্যে। কখনো কখনো আবার দুর্গম এলাকায়, যেখানে স্বাভাবিক রাস্তা তৈরি করা সম্ভব নয়, সেখানে যাতায়াতের উপায় হিসেবে বানানো হয় ব্রিজ। তবে ব্রিজ নির্মাণের আগে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। কারণ ব্রিজের উপর নির্ভর করে থাকে যাত্রীদের জীবন।
রাস্তায় ঘাটে ব্রিজ বা সেতু আমরা আকছার দেখি। কোথাও নদীর উপর দিয়ে ব্রিজের মাধ্যমে দিব্যি চলাচল করে গাড়ি,আবার কোথাও সাধারণ রাস্তার উপর দিয়েই অতিরিক্ত যান চলাচলের রাস্তা হিসেবে কাজ করে করে ব্রিজ বা সেতু। বিদ্যাসাগর সেতু, বিবেকানন্দ সেতু, দ্বিতীয় হুগলি সেতু কিংবা রবীন্দ্র সেতু, কলকাতা শহরের নিত্য দিনের যাতায়াতের সঙ্গী এই সমস্ত ব্রিজ গুলো আমাদের হাতের তালুর মতো চেনা। কিন্তু এই জানেন কি পৃথিবীর বুকে এমন কিছু ব্রিজ আছে যার উপর দিয়ে হাঁটতে গেলে আপনার পা টলমল করে উঠবে? ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই যাতায়াতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক সেই সব ব্রিজ। আসুন আজ জেনে নেওয়া যাক তেমন কিছু ব্রিজের কথা।
১) ইউক্রেনের আই পেট্রি ব্রিজ:

ইউক্রেনের পাহাড়ের উপর অবস্থিত আই পেট্রি ব্রিজকে পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক ব্রিজ বলে মনে করা হয়। এমনকি একে সবথেকে বিপজ্জনক বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। কেন বিপজ্জনক এই ব্রিজ? এই ব্রিজের নীচে যে পাহাড়ি উপত্যকা রয়েছে, তা অন্তত ৪২০০ ফুট গভীর। ইউক্রেনের ক্রিমেয়ান পর্বতের দুটি সুউচ্চ শৃঙ্গের সংযোজক হিসেবে এই ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। দড়ি দিয়ে কাঠের পাটাতন বসানো এই ব্রিজ সর্বক্ষণ হাওয়ায় ভয়ানক কাঁপে। এছাড়া কুয়াশাতেও সারাক্ষণ মোড়া থাকে এই ব্রিজ। ফলে ভয় আর বিপদের আবহেই পথ চলতে হয় এই ব্রিজ দিয়ে।
২) কানাডার ক্যাপিলানো ব্রিজ:

কানাডার ক্যাপিলানো ব্রিজ পৃথিবীর বিপজ্জনক ব্রিজ গুলির তালিকায় প্রথম সারিতে জায়গা করে নেয় অনায়াসেই। উত্তর ভ্যাঙ্কুভার অঞ্চলে এই ব্রিজটি অবস্থিত। এর নীচ দিয়ে বয়ে গেছে ক্যাপিলানো নদী। এই ঝুলন্ত ব্রিজ ২৩০ ফুট উঁচু এবং ৪৫০ ফুট লম্বা। এই ব্রিজের উপর থেকে প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখার লোভে প্রতি বছর বহু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটক এখানে যান। প্রাণ হাতে করে তাঁরা ক্যাপিলানো ব্রিজ পারাপার করেন।
৩) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রয়্যাল জর্জ ব্রিজ:

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ঝুলন্ত ব্রিজের নাম রয়্যাল জর্জ ব্রিজ। শুধু তাই নয়, এর কিছু ঐতিহাসিক তাৎপর্যও রয়েছে। ১৯২৯ সালের বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার সময় এই ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল। আরকানসাস নদীর উপর এই ব্রিজ ৯৫৫ ফুট উঁচু। এটি ২০০১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের উচ্চতম ব্রিজ ছিল। পরে চীন এর চেয়ে উঁচু ব্রিজ বানায়। আজ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এই রয়্যাল জর্জ ব্রিজ।
৪) নেপালের ঘাসা ব্রিজ:

নেপালের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে এক গভীর নদী উপত্যকার উপর ঘাসা ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। এই ব্রিজ স্থানীয় পশুর পালদের চলাফেরা করার জন্য বানানো হয়েছিল। রাস্তার মাঝে হঠাৎ পশুরা দল বেঁধে চলে এলে যে যানজটের সৃষ্টি হত, তা এড়াতেই নেপালের ঘাসা ব্রিজের উৎপত্তি। বিপজ্জনক ব্রিজের তালিকায় এই ব্রিজ অন্যতম। সুউচ্চ এই ব্রিজের বিপদ মাথায় নিয়েই রোজ স্থানীয় গাধা, ভেড়া প্রভৃতি পশুর দল এপার থেকে ওপারে যায়। ব্রিজ পারাপার করেন কৃষকরাও।
৫) সুইৎজারল্যান্ডের ট্রিফ্ট ব্রিজ:

ইউরোপের আল্পস পর্বতমালার অন্যতম উঁচু এবং বিপজ্জনক ঝুলন্ত ব্রিজ হল ট্রিফ্ট ব্রিজ। আপনি উচ্চতায় ভয় পান আর নাই পান, সুইৎজারল্যান্ডের ট্রিফ্ট ব্রিজের সৌন্দর্য আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না কিছুতেই। সুইৎজারল্যান্ডের হিমবাহের উপর ৫৫৮ ফুট দীর্ঘ এই ব্রিজ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ৩২৮ ফুট উঁচু। পাহাড়ি উচ্চতায় প্রচুর হাওয়ার ফলে সারাক্ষণ নড়তে থাকে এই ব্রিজ।
৬) চীনের রোলড্ ড্রাগন ব্রিজ:

চীনের রোলড্ ড্রাগন ব্রিজকে অনেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্রিজের আখ্যা দিয়ে থাকেন। ব্রিজের উচ্চতা তো একে ভয়াবহ করে তুলেইছে, কিন্তু সেই সঙ্গে এই ব্রিজের অন্য একটি ভয়ানক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হল চীনের এই রোলড্ ড্রাগন ব্রিজ তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ কাঁচ দিয়ে। দুর্বল হৃদয়ের মানুষের পক্ষে এই ব্রিজ যে একেবারেই উপযুক্ত নয়, তা বলাই বাহুল্য। চীনের তিয়ানানমেন পর্বতের উপর প্রায় ৪৬০০ ফুট উঁচুতে এই ব্রিজ অবস্থিত। এটি মাত্র ৫.২ ফুট চওড়া।
৭) রাশিয়ার কুয়ানদিনস্কি ব্রিজ:

এটি গাড়ি চলাচল করার ব্রিজ। আর সেই কারণেই হয়তো এই ব্রিজ আরো বেশি করে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। গাড়ি চলাচলের জন্য এই ব্রিজে রয়েছে মাত্র ৬ ফুট চওড়া রাস্তা। অত্যন্ত সাবধানে দক্ষ হাতে ধীরে ধীরে এই ব্রিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই নীচে রয়েছে বরফ শীতল নদী। পরিস্থিতি আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে কারণ এই ব্রিজের ধাতব কাঠামোর বাইরে দেয়া হয়েছে কাঠের আবরণ। ফলে বরফে এই ব্রিজ হয়ে পড়ে অত্যন্ত পিছল। বছরের পর বছর ধরে একই ভাবে পড়ে আছে রাশিয়ার এই ব্রিজ। কোনোরকম সংস্কার করা হয় নি।
পৃথিবীর আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে এমনই অজস্র বিপদের আশঙ্কা। কিন্তু সব কিছুকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের পৃথিবী অপরূপা।