“রাজার মুকুট, রাজার সাজ
অন্য কেউ তা পরবে আজ”
রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের প্রত্যেকটা পরিবর্তন আপাতদৃষ্টিতে অকস্মাৎ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। দাবার মতোন মেপে-বুঝে-সামলে খেলতে হয় প্রত্যেকটা দান_কিস্তিমাতের দানটা নিজের নামে লিখতে।
বর্তমান বঙ্গরাজনীতিতে বিজেপির উত্থান তথা অভূতপূর্ব সাফল্য রাজনৈতিক মহলে তুলেছে ব্যাপক আলোড়ন। ২০১৪র লোকসভা নির্বাচনের ২টি আসন থেকে ২০১৯এর লোকসভা নির্বাচনের ১৮টি আসন_বিস্তীর্ণ একচেটিয়া সবুজের মাঝে পদ্মের এই আকস্মিক প্রাচুর্যের জন্য অনুঘটকের কাজ করেছে গেরুয়া শিবিরের বহু আঙ্গিক পলিটিক্যাল স্ট্রাটেজি।
বিজেপির পলিটিক্যাল স্ট্রাটেজির প্রথমেই আসে পশ্চিমবঙ্গের স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষকে একমুখী পরিচালনা। শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতি,বেকারত্ব, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের চূড়ান্ত অস্বচ্ছতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ ইত্যাদি অভিযোগকে কেন্দ্র করে জনমানসে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল তার বিরুদ্ধে বিকল্প হিসেবে কংগ্রেস বা সিপিএম এর জায়গায় গেরুয়া শিবির সক্ষম হয়েছিল নিজেদের তুলে ধরতে। বিগত নির্বাচন গুলিতে কংগ্রেস ও সিপিএম নিজেদের মর্তাদশগত বিরোধ ভুলে জোট করা সত্ত্বেও পরাজয়ের সম্মুখীন হওয়ায় বিরোধী দল হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতার যে পতন হয়, সেই পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাময় বিরোধী দল হিসেবে বিজেপির উত্থান ঘটে। বিজেপির পক্ষে না হলেও শাসক শ্রেণীর বিপক্ষে যাওয়ার তাগিদ যে জনমানসে গেরুয়া শিবির তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিল তারই প্রমাণ মেলে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নরেন্দ্রমোদীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা অব্যশম্ভাবী ভাবেই বিজেপির পলিটিক্যাল স্ট্রাটেজির কেন্দ্রবিন্দু। উত্তর ভারতের তথাকথিত ‘বিজেপি বলয়’ এর বাইরে এসে প্রায় সমগ্র পূর্ব ভারত,দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক, তেলেঙ্গানার মতো অঞ্চলে বিজেপির অপ্রত্যাশিত সাফল্য অপ্রতিরোধ্য মোদী সরকারের যে ‘ইমেজ’ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিল তাতে পৃথক মাত্রা যোগ করেছিল “হর হর মোদী,ঘর ঘর মোদী” কিংবা “আবকি বার মোদী সরকার, বারবার মোদী সরকার” এর মতো চমকপ্রদ প্রচারকার্য। নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হিসেবে কংগ্রেস বা বিরোধী ঐক্যজোটের সম্ভাব্য মুখকে ঘিরে যে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় জনমানসে সেই জায়গায় রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর অবিসংবাদিত গ্রহণযোগ্যতার ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম হয় রাজ্য বিজেপি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে ২০১৯ এর ফলাফলে।পশ্চিমবঙ্গের ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের সিংঘভাগ তৃণমূলের সমর্থনে এবং সেই স্বার্থে শাসকদল সংখ্যালঘু তোষণে উদ্যতএমন ক্ষোভ পশ্চিমবঙ্গের জনগণের একাংশের। মুখ্যমন্ত্রীর তিন তালাকের বিরোধিতা, হজ টাওয়ার নির্মাণ, ইমাম ভাতা প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলি জনগণের কিছু অংশের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে, তাকে পুঁজি করেই বিজেপির পাল্টা প্রচার চালায় উন্নয়নের পক্ষে কিন্তু তোষণের বিপক্ষে। ক্ষেত্রবিশেষে হাজীনগর riot, চন্দ্রকোনা রোডের কালীমন্দির ভাঙচুর,২০১৭ সালের বাদুড়িয়ার দাঙ্গা,ধূলাগড় এর ঘটনার মতো সাম্প্রদায়িক ঘটনা বারে বারে উঠে আসে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে। যার ফলে তোষণ-বিমুখ পশ্চিমবঙ্গ বাসীর বিকল্প পথ সন্ধানের তাগিদ মসৃণ করে দেয় গেরুয়া শিবিরের বিজয়রথের পথকে।
শেষ কয়েক বছরে তৃণমূলের কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ফলে শবর,রাজবংশী, কামতাপুরি প্রমুখ আঞ্চলিক ইস্যু গুলোর প্রতি সেভাবে সরকারি প্রতিক্রিয়া না মেলায় সেই অভাব পূরণে কৌশলী পদক্ষেপ নেয় বিজেপির নেতৃত্ব। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে জাতি ও উপজাতিভিত্তিক ভোটের অংক মেলানোর জন্য এই বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অর্জুন রাম মেঘওয়াল ও অরবিন্দ মেনন কে যথাক্রমে জঙ্গলমহল ও উত্তরবঙ্গের প্রচারকার্যের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করে বিজেপির নেতৃবর্গ এবং এ প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপির নিশীথ প্রামাণিকের নাম উল্লেখযোগ্য। লোকসভা ভোটের ফলাফল দৃষ্টান্তমূলক ভাবে ফুটে ওঠে এই যৌথ প্রচেষ্টার প্রভাব।
এছাড়াও হুগলি,ব্যারাকপুর, রানাঘাট অঞ্চলের প্রভাবশালী মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটের এক বিশাল অংশ নিজেদের পক্ষে আনতে সর্বোতভাবে চেষ্টা করে বিজেপি নেতৃত্ব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গে আসেন মতুয়া সম্প্রদায়কে সম্বোধন করার উদ্দেশ্যে _যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নজিরবিহীন। মতুয়া সম্প্রদায়ের ঘরের ছেলে শান্তনু ঠাকুরের বঁনগায় ভোটের টিকিট পেয়ে জয়লাভ,এই ব্যাপক সমর্থনলাভের স্ট্রাটেজিরই ফলশ্রুতি বলা চলে।
এবং সবশেষে বলা চলে তৃণমূলের একসময়ের “স্ট্রাটেজি মেকার” মুকুল রায়ের বিজেপিতে পদার্পণ স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য বিজেপির রণকৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে ভোটের মাটি শক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। বঙ্গ বিজেপির চাণক্য হিসেবে তার সাংগঠনিক ক্ষমতা দলের একেবারে নীচুতলার কর্মীদেরও প্রত্যক্ষভাবে দলীয় কার্যে যুক্ত হওয়ার যে রাস্তা করে দিয়েছিল তারই ফলশ্রুতি ২০১৯ এর ফলাফল। পশ্চিমবঙ্গে আবারও সেই মুকুল-ম্যাজিকেই ভর করে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে গেরুয়া শিবির, “উনিশে হাফ,একুশে সাফ” করার লক্ষ্যে।