তেজস্বী যাদবের স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। ঝাড়খণ্ডের হয়ে রঞ্জি খেলেছেন। আইপিএল-এ দিল্লী ডেয়ার ডেভিলস টিমেও ছিলেন। মঙ্গলবার বিহার ভোটের ফল প্রকাশের সময় মনে হচ্ছিল যেন আইপিএল-এর সুপার ওভার চলছে। সাম্প্রতিককালে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এমন টানটান উত্তেজনার রাজ্য নির্বাচন দেখা যায়নি।

বুথ ফেরত সমীক্ষার হিসাব উল্টে দিয়ে পাটলিপুত্রের দখল নিয়েছে এনডিএ শিবির। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় ম্যাজিক ফিগার ১২২। এনডিএ জিতেছে ১২৫ আসন। এর মধ্যে বিজেপির ৭৪ এবং নীতিশের ৪৩টি আসন। অন্যদিকে মহাজোট ম্যাজিক ফিগারের থেকে ১২ আসন দূরে থেমেছে। তাদের মোট আসন ১১০। এর মধ্যে তেজস্বীর দল এককভাবে জিতেছে ৭৫ আসন। এবং তারাই বিহারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। কংগ্রেস ৯০ আসনে প্রার্থী দিলেও জিততে পেরেছে মোটে ১৯ আসনে। বরং উল্লেখযোগ্য ভালো ফল করেছে বামেরা। মাত্র ২৯ আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৮ আসন হাসিল করেছে তারা। বোঝা যাচ্ছে কান ঘেঁষে জিতেছে এনডিএ। কংগ্রেস যদি তেজস্বীকে আরও বেশি আসনে লড়তে দিত তাহলে ফলাফল অন্যরকম হতে পারত।

Nitish2jpg
the hindu

করোনা আবহে এই ভোট হওয়া নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল। কংগ্রেস, আরজেডি, বামেরা তো এই সময় ভোট না করার দাবিই তুলেছিলেন। বিজেপিও দোলাচলে ছিল। একমাত্র নীতিশ কুমারই ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। ভোট এখনই হোক। কেন? হয়তো বিজেপিকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নীতিশ। কারণ, এখন ভোট না হলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হবে। তাহলে সুবিধে পাবে গেরুয়া শিবির। সাধারণত আঞ্চলিক দলগুলি জাতীয় কোনও দলকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। শিবসেনা এর যথার্থ উদাহরণ। যাই হোক, এমন বাতাবরণে ভোট ঘোষণা করে দিল নির্বাচন কমিশন।

614317 laluyadavpti
DNA india

এই সময় বিজেপির আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। সেটাই স্বাভাবিক। লালু জেলে। কংগ্রেস অস্তমিত সূর্যের মতো পাটে বসেছে। বামেদের তো দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। সব মিলিয়ে বিরোধী শিবির ছন্নছাড়া। কিন্তু প্রচার শুরু হতেই আমূল বদলে গেল ছবিটা। যে তেজস্বী ভোট চাইছিলেন না, তাঁর জনসভাতেই উপচে পড়া ভিড় দেখল গোটা দেশ। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল লাগামছাড়া আবেগ। উল্টো দিকে নীতিশের সভা কিছুটা নিষ্প্রভ। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তাঁর বিরুদ্ধেই স্লোগান উঠেছে। মেজাজ হারিয়ে নীতিশ দর্শকদের বেরিয়ে যেতে পর্যন্ত বলে দিয়েছেন।

Modi 111 571 855
outlookindia

এখান থেকেই মোটামুটি বিহার ভোটে কি হতে চলেছে সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছিল সরকার বিরোধী হাওয়া প্রবল। পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকার পর আর নীতিশ কুমারকে আরেকবার চাইছে না বিহারবাসী। এই সময় খেলা ঘোরাতে মাঠে নামেন মোদী। একের পর এক জনসভা করেন। বিজেপির দাবি ছিল, নীতিশ কুমারের সরকারের বিরুদ্ধে জনমত থাকলেও বিহারে ‘মোদী ম্যানিয়া’ এখনও প্রবল। ফল ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে, গেরুয়া শিবিরের দাবি খুব একটা ভুল ছিল না।

Screen Shot 2020 11 04 at 7.38.20 PM 1090x600 1
thewire

লোকসভায় ৪০ টি আসনের মধ্যে ৩৯ টি জিতেছিল এনডিএ জোট। এর মধ্যে ১৭টি বিজেপি, ১৬ টি পেয়েছিল নীতিশের জেডিইউ আর রামবিলাস পাসোয়ানের এলজেপি জিতেছিল ৬টি আসন। আর বাকি ১ টা আসন গিয়েছিল কংগ্রেসের ঝুলিতে। লালু-তেজস্বীর আরজেডি শূন্য, একটা আসনও জিততে পারেনি। অর্থাৎ মোদী ঝড়েই বাজিমাত। বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল সেই মোদী ঝড় এখনও অটুট। কিন্তু নীতিশের ভোট কমেছে অনেকখানি। জেডিইউ-র ঝুলিতে গিয়েছে মাত্র ১৫.৪ শতাংশ ভোট। বিজেপির ঝুলিতে ১৯.৫ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ বলা যেতে পারে মোদীই নীতিশ কুমারকে টেনে তুলেছেন।

37c1ed5c f838 4e37 8daf 4dd3a0846fcc
telegraphindia

এবারের বিহার ভোটে আশ্চর্যজনক বিষয় হল লোকসভা ভোটের লজ্জাজনক হারের পর আরজেডি-র ঘুরে দাঁড়ানো। লালু জেলে। অনেকে সন্দেহ করেছিলেন একা তেজস্বী কি করবে? সেই তেজস্বী কিন্তু একাই ম্যাচ ঘুরিয়েছে শুধু নয়, বিহারের মাটিতে সোনা ফলিয়েছে। অনেক বড় বড় নেতা দেখেছে বিহার। লালু প্রসাদ যাদব, নীতিশ কুমার, জর্জ ফার্নান্ডেজ, রামবিলাস পাসোয়ান। গোটা বিহার এঁদের কথা এক বাক্যে শোনে, মানে। কিন্তু তাঁদের পর আর কেউ উঠে আসেনি। বিজেপির রবি শঙ্কর প্রসাদ, রাজীব প্রতাপ রুডির মতো নেতারা আছেন। কিন্তু গোটা বিহারে তাঁদের আধিপত্য নেই। এরা এলাকার নেতা। পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে বিচার করলে অরূপ বিশ্বাসের যেমন দক্ষিণ কলকাতা বা টালিগঞ্জ ছাড়া বাংলার অন্যত্র অর্থাৎ মেদিনীপুর বা পুরুলিয়ায় অ্যাপিল নেই, রবিশঙ্কর বা রাজীবও সেরকম। কিন্তু এই ভোটের ফল প্রকাশের পর এটা নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়, আরও একজন প্যান বিহার মুখের উত্থান হল বিহারে, সে সরকার গড়তে পারুক আর না পারুক, তিনি হচ্ছেন তেজস্বী যাদব।

PM Modi Smile Shy 1280x720 1
postcard.news

এই ভোটে শেষ বিষয়টি হল মোদী ফ্যাক্টর। হ্যাঁ, গোটা দেশে এখনও মোদী ঝড় অটুট। ভোটের আগে বিহারে অমিত শাহ কোনও সভা করেননি। করোনা থেকে সদ্য সেরে উঠেছেন। তবে নাড্ডা ছিলেন। আর ছিলেন মোদী। গোটা দেশ বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। করোনা নাজেহাল করে দিয়েছে দেশবাসীকে। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শুধু বিহারেই কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছেন। এই নিয়ে বিরোধীরা নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করছেন মোদীকে। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আক্রমণ শানিয়েছেন। কৃষি বিল নিয়ে বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালের তুলনায় বিজেপির ভোট বৃদ্ধি গেরুয়া শিবিরের নেতাদের মধ্যে সঞ্জীবনীর সঞ্চার করেছে। এই সবগুলো ক্ষেত্রেই যে মোদী সরকার ভালো কাজ করেছে তা ভোট দিয়ে মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে বলেই প্রচার করছেন বিজেপি নেতারা। অর্থাৎ মোদী ম্যাজিক অটুট।
এখন দেখার বিহার ভোটের ফল বাংলায় কোনও প্রভাব ফেলতে পারে কিনা! মোদী ম্যাজিক পশ্চিমবঙ্গে কতটা কাজ করবে সেটাও দেখার। তবে বাংলাতেও যে একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে, সেটা এখনই চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।