বিহারের নির্বাচনী ফলাফলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সরাসরি কোনো যোগাযোগ না থাকলেও তার একটা পরোক্ষ প্রভাব অবশ্যই এ রাজ্যে পড়বে। এই দুই প্রতিবেশী রাজ্যের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অনেকটাই মিল আছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের দল জেডি(ইউ) এর যেমন পশ্চিমবঙ্গে কোনো প্রভাব নেই, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসেরও বিহারের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব নেই। অথচ বিজেপি কংগ্রেস, বাম দলগুলোর দুই রাজ্যেই প্রভাব আছে। এমনকি লালু প্রসাদ যাদবের আরজেডির অল্প বিস্তর প্রভাব আছে পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু অঞ্চলে।
বামেদের একসময়ের ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা থেকে তারা দীর্ঘ নয় বছর দূরে আছে। এই সময়ের মধ্যে ব্যাপক শক্তি ক্ষয় হয়ে বামফ্রন্ট বর্তমানে বাংলার অনেক দূরের তৃতীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অথচ বিহারে কোনোদিন ক্ষমতায় না থাকা সত্বেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সুফল এবারের বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছে বাম দলগুলি। মাত্র ২৯ টি আসনের লড়াই করে বাম দলগুলো একত্রে ১৬ টি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়েছে। এরমধ্যে সিপিআই (এম এল) ১২ টি আসনে জয়লাভ করেছে। সিপিআই(এম) ও সিপিআই দুটি করে আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়েছে।
বিহারের ভোটে বামেদের এই সাফল্যের পর এই রাজ্যের বামপন্থী নেতা কর্মীদের একাংশ মনে করতে শুরু করেছেন আগামী বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা ভালো ফলাফল করবে। এটা ঠিক রাজনৈতিক দলের নেতারা কর্মীদের নানাভাবে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। তাই এই মুহূর্তে বিহারের নির্বাচনী সাফল্য বামপন্থী নেতাদের কাছে চোখের মণির মতো প্রিয় হয়ে উঠেছে। আমরা বরং খুঁজে দেখার চেষ্টা করি বিহারে বামেদের নির্বাচনী সাফল্যের প্রভাব এই রাজ্যের রাজনীতিতে কতটা পড়া সম্ভব।
১) সব বামপন্থী দল এক ছাতার তলায় আসতে পারে
বিহারের নির্বাচন প্রমাণ করে দিয়েছে বামপন্থী দলগুলো একজোট হয়ে লড়াই করলে ফলাফল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে সিপিআই (এম এল), এসইউসি (কমিউনিস্ট) এর মতো বামপন্থী দলগুলি বামফ্রন্টের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে লড়াই করতে পারে।
২) কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতায় অ্যাডভান্টেজ পেতে পারে
বিহারের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গিয়েছে মহাজোটের শরিকদের মধ্যে কংগ্রেস সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। তারা নির্বাচনী যুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করেনি বলে মহাজোটের ভেতর থেকেই অভিযোগ ওঠে। এই পরিস্থিতিতে আসন বন্টন নিয়ে বাম ও কংগ্রেস নেতৃত্ব যখন আলোচনায় বসবে তখন কিছুটা অ্যাডভান্টেজে থাকতে পারে বাম নেতারা। কংগ্রেসকে বেশি আসনে লড়তে দিলে তাতে ফলাফল খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে এই যুক্তিকে সামনে নিয়ে আসতে পারে বাম শিবির।
৩) উজ্জীবিত কর্মীবাহিনী
পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক নির্বাচনী যুদ্ধে বামেদের পরাজয়ের ফলে তাদের কর্মীবাহিনী ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বিহারের নির্বাচনে বামেদের এই সাফল্য পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী কর্মীদের অনেকটাই উজ্জীবিত করে তুলতে পারে। তার ফলে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে বামপন্থীদের সামিল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
৪) রাজনৈতিক গুরুত্ব ফিরে পাওয়া
পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার ক্ষমতা হারানোর পর বামেদের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে একটি আসনেও জিততে না পারার ফলে বামেরা এই রাজ্যে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতিতে বিহারের সাফল্য পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের রাজনৈতিক গুরুত্বকে নতুন করে মানুষের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হবে।
৫) দ্বিমুখী লড়াইকে ত্রিমুখী লড়াইয়ে পরিণত করতে পারে
বিহারের নির্বাচনে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে লড়াই করে যে সাফল্য বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পেয়েছে সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তারা যদি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানে সর্বস্ব পণ করে নেমে পড়ে, সেক্ষেত্রে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে হতে চলা দ্বিমুখী লড়াই পরিণত হবে ত্রিমুখী লড়াইয়ে। বামেরাও তখন ক্ষমতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হবে। আর মানুষ যদি একবার বোঝে যে বামেরা নতুন করে জেগে উঠছে, তখন অনেকেই আবার বামেদের দিকে ফিরে আসবে বলে অনুমান করা যায়।
ঘটনা হলো একটি রাজ্যের নির্বাচনে পাওয়া সাফল্য থেকে উজ্জীবিত হওয়ায় এবং শিক্ষা নেওয়া যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূল লড়াইটা পশ্চিমবঙ্গের বাম নেতা কর্মীদেরকেই লড়তে হবে।