২০১১ সালে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জামানার পতন ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। এরপর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে কেবলমাত্র রক্তক্ষরণের সম্মুখীন হয়েছে বামেরা। তবে একুশের বিধানসভা ভোটে আর রক্তক্ষরণের কোনও অবকাশ রইল না। ১৯৪৬ সালের পর এই প্রথম বাম শূন্য বিধানসভা গঠিত হতে চলেছে বাংলায়। নির্বাচনী যুদ্ধে বামেদের এই ফল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এবারে এক ঝাঁক তরুণ ছেলে-মেয়েকে প্রার্থী করে নতুন করে ফিরে আসার লড়াই লড়েছিল তারা। ফল বের হতে দেখা গেল বামেদের নতুন প্রচেষ্টাকেও সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে রাজ্যের মানুষ।
এই রাজ্যের বাম নেতৃত্ব সম্বন্ধে অভিযোগ ছিল তারা নতুন প্রজন্মকে সামনের সারিতে তুলে আনছে না। এর ফলে বর্তমান সময়ের দাবি ও চাহিদার সঙ্গে বামেরা সংযোগ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। এবারের ভোটে সৃজন ভট্টাচার্য্য, মীনাক্ষী মুখার্জি, প্রতিকুর রহমান, পৃথা তা’দের প্রার্থী করে তারা। বৃদ্ধ তন্ত্রের যে ছাপ বামেদের গায়ে লেগেছিল সেটা একরকম ঝেড়ে ফেলা গিয়েছে। তবুও রাজ্যবাসী তাদের প্রত্যাখ্যান করায় আগামী দিনে কোন পথে বামেরা এগোবে তা নিয়ে সম্পূর্ণ দিশাহীন তারা। এই পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের মতো করে কিছু প্রেসক্রিপশন তুলে ধরছি বামপন্থীদের জন্য।
১) কলঙ্কিত চরিত্র পুনরুদ্ধার করা-
২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠন করে প্রথম নিজেদের চরিত্রে কালির দাগ লাগায় বামপন্থীরা। যে কংগ্রেসের অর্থনৈতিক নীতি এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করে এসেছে তাদের সঙ্গে হাত মেলানোটা ভোটারদের একটা বড়ো অংশ মেনে নিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর তৈরি নতুন রাজনৈতিক দল আইএসএফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির ওপর কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছে বাম নেতৃত্ব।
এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই লড়তে হলে বামেদেরকে আবার গোড়ায় ফিরে যেতে হবে। কংগ্রেস এবং আইএসএফ এর হাত ছেড়ে বরং বৃহত্তর বামফ্রন্ট গঠন করে আগামী দিনে লড়াই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি ভোটের লড়াইয়ে এই বৃহত্তর বামফ্রন্টকে নিয়ে মানুষের দরবারে হাজির হতে হবে তাদেরকে। এতে মানুষকে এটুকু বোঝানো সম্ভব হবে যে আদর্শগত জায়গায় আগে যা সমঝোতা করেছিল, সেই ভুল তারা সংশোধন করে নিয়েছে। তারা ভোটের লড়াই বামপন্থার নীতিতেই লড়তে চায়।
২) আদর্শগত সংযোগ গড়ে তোলা প্রতিটি শ্রেণীর সঙ্গে-
সমাজে আজও শাসকরা শোষিতদের শোষণ করে। তাই বামপন্থী রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা আজও আছে। কিন্তু বাংলার বাম নেতৃত্তের মুশকিল হল তাঁরা সম্পূর্ণরূপে দিশেহারা। বলা যেতে পারে চরিত্র হারিয়ে মধ্যবিত্ত এবং এলিট সম্প্রদায়ের দলে পরিণত হয়েছে তারা। অথচ যাদের কথা তারা সব সময় মুখে বলে সেই রিকশাচালক, বাড়ির ঠিকা কর্মী, কলকারখানার অস্থায়ী কর্মী অথবা বাজারের সবজি বিক্রেতা তাদের সঙ্গে যাবতীয় সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এই মানুষগুলির মূল চাহিদা কি, তারা বর্তমানে কোন দৃষ্টিতে সমাজকে দেখছেন এসব কিছুই আর বোধহয় বুঝতে পারেন না এ রাজ্যের বামপন্থী নেতারা।
ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই লড়তে হলে আবার গোড়ায় পৌঁছতে হবে বামপন্থীদের। যাদের জন্য তারা নতুন সূর্যের ভোর আনার স্বপ্ন দেখে সেই মানুষগুলির আসলে বর্তমান চাহিদা কি এবং তারা কিভাবে জীবন কাটাতে চায় সেই বিষয়টা সবার আগে বুঝে উঠতে হবে। এইজন্য নেতা থেকে শুরু করে একেবারে নিচুতলার কর্মী সবাইকে কলকাতার পার্টি অফিস ছেড়ে জেলায় জেলায় গিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যেতে হবে। বড় বড় লম্বা-চওড়া কথা বলার আগে এই মুহূর্তে বামপন্থীদের খুব প্রয়োজন উল্টোদিকের মানুষের কথা মন দিয়ে শোনা। এই শিক্ষা দিয়েই তারা বুঝতে পারবে বাজারে সবজি বেচলেও বাড়িতে রেফ্রিজারেটর থাকতে পারে। সেই মানুষটা একটা মোটরসাইকেলের স্বপ্ন দেখে থাকে। তাই বর্তমানের লড়াইটা হবে তার এই সবজি বিক্রির বিষয়টিতে নিশ্চয়তা প্রদান করা। কারণ এই সবজি বিক্রেতা মোটেও সরকারি চাকরি চাইতে যাবে না। সেই জন্য যারা সরকারি চাকরির প্রত্যাশা করবে তাদেরকে যেমন চাকরি দিতে হবে, তেমনই যে সবজি বেচতে চাইবে তাকে সবজি বিক্রির জন্য আরও সুন্দর পরিকাঠামো প্রদান করার আশ্বাস পৌঁছে দিতে হবে।
৩) যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই গোটা রাজ্য নয়-
এ রাজ্যের বাম নেতারা অদ্ভুত একটা আত্মশ্লাঘায় ভোগেন। তারা মনে করেন যাদবপুর এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজ্যের দুই শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বামপন্থী ছাত্রদের আধিপত্য আছে মানেই তারা সেরা। কিন্তু বাম নেতাদের বুঝতে হবে রাজ্যের খুব অল্প সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী এই দুই বিশ্ববিদ্যালয় পড়েন। এর বাইরে আরও অসংখ্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর বাইরে আরও অসংখ্য ছেলেমেয়ে কলেজের চৌকাঠে পা রাখেন না তাই এমন ভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে যাতে শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা যেমন সমৃদ্ধ হন, তেমনই রাজ্যের গড়পড়তা সাধারন ছেলে-মেয়েরা যেন বামপন্থীদের সঙ্গে আত্মিক যোগ অনুভব করেন। সেই কারণে নিজেদের আদর্শ কথা বলতে গিয়ে কঠিন কঠিন শব্দ প্রয়োগ না করে সহজ-সরল কথায় প্রত্যক্ষ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করাটা জরুরী।
৪) এলিটিজম ত্যাগ করতে হবে-
এ রাজ্যের বামপন্থী কর্মীদের অদ্ভুত একটা সব জান্তা মনোভাব আছে। সেই সঙ্গে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত শিক্ষা নিয়ে এতটাই অহংকারী যে উল্টোদিকের কম পড়াশোনা করা মানুষটি তাদের সঙ্গে কথা বলতে আসলে রীতিমতো লজ্জা অনুভব করেন। তার কারণ এ রাজ্যের বামপন্থী কর্মী-সমর্থকরা কথা বলার সময় বারেবারে বুঝিয়ে দেন তারা উচ্চশিক্ষিত। তার ওপর কথায় কথায় তুমি কিছু বোঝো না, আপনি কিছু জানেন না এই মনোভাব ত্যাগ করতে হবে বামপন্থীদের। বরং নিজেদের আচরণ দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে তাদের সঙ্গে বামেদের কোনও পার্থক্য নেই।
গ্রামের বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অনুভূতিকেই প্রাধান্য দেন। কে পরিষেবা দিল, কে সৎ এই বিষয়গুলি তাদের কাছে ততটা গুরুত্ব পূর্ণ হয় না ভোটের ক্ষেত্রে। বরং কোন মানুষ তার মন ছুঁয়ে গিয়েছেন সেটাই প্রধান বিচারয্য হয়। আর এক্ষেত্রে বামপন্থীরা যতই উন্নয়নের কথা বলুক তারা সাধারণ মানুষের ঘরের ছেলে হয়ে উঠতে পারছে না। বরং দূরের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে থেকে যাচ্ছে। স্বাভাবিক বিষয় হলো আমজনতা আপনজনকে ভোট দেবে, দূরের শুভাকাঙ্ক্ষীকে নয়।
৫) শহর নয়, জেলার লড়াকু নেতাদের আলিমুদ্দিনের দায়িত্ব দেওয়া হোক-
সিপিআই(এম) এর রাজ্য সদরদপ্তরে এই মুহূর্তে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কলকাতা এবং তদসংলগ্ন অঞ্চলের নেতারা। রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র খাতায়-কলমে পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত নারায়ণগড়ের বাসিন্দা হলেও কানাঘুষো শোনা যায় তার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। বরং মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তীরা দলের অভ্যন্তরে ছড়ি ঘুরিয়ে আসছেন। অথচ তারা কলকাতার যে সমস্ত অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেন সেখানে বরাবরই বাম বিরোধী মনোভাবের মানুষের সংখ্যাধিক্য আছে। এছাড়া তাদের সঙ্গে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের কোনও সংযোগ নেই।
এরকম গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগহীন নেতাদের পরিবর্তন করা খুব জরুরি। এছাড়া মহম্মদ সেলিমের ভাবমূর্তি সম্বন্ধে সিপিআই(এম) এর অভ্যন্তরেই যথেষ্ট বিতর্ক আছে। দলের একাধিক নেতা বারবার অভিযোগ করেন এই পলিটব্যুরো সদস্য জন্যই আব্বাস সিদ্দিকীর দলের সঙ্গে বাধ্য হয়ে জোট তৈরি করা হয়েছিল। বামপন্থীদের উত্থান ঘটাতে হলে সেলিমকে রাজ্যের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে যত দ্রুত সম্ভব দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত সিপিআই(এম) সর্বোচ্চ নেতৃত্তের। এর পাশাপাশি কলকাতার নেতাদের ক্ষমতা খর্ব করে জেলার তাপস সিনহা, আভাস রায়চৌধুরী, সুশান্ত ঘোষ, কান্তি গাঙ্গুলি এবং নতুন প্রজন্মের মীনাক্ষী মুখার্জি, ইব্রাহিম আলিদের দলীয় সংগঠনের মাথায় তুলে আনা উচিত। সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা অভিজ্ঞ হিসেবে অবশ্যই পরামর্শ দেবেন। কিন্তু দলের রাস জেলার এই যুব নেতাদের হাতে তুলে দেওয়াটা খুব জরুরী এই মুহূর্তে।
এই যুবনেতাদের হাতে দলের দায়িত্ব সম্পূর্ণ তুলে দিলে আশা করা যায় তারা যে কোনও আন্দোলন একেবারে মাটি কামড়ে গড়ে তুলতে পারবেন। সেক্ষেত্রে লাগাতার ধর্মঘট করা বা ঘেরাও বিক্ষোভের মত বিষয়গুলি করার ক্ষমতা থাকবে এই নেতাদের। কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের বাম নেতাদের মধ্যে ঠাণ্ডা ঘরে বসে কঠিন কঠিন তত্ত্বকথা আওড়ানোর আয়েস পেয়ে বসেছে। তাই বামপন্থীদের পুনরুত্থানের পথ তৈরি হতে পারে একমাত্র রাস্তায় নেমে। আর সেই রাস্তায় নামার জন্য গ্রামবাংলাই প্রধান ভরসা।
আমরা আমাদের মতো করে প্রেসক্রিপশনে পাঁচটি ওষুধ তুলে ধরলাম বাম নেতৃত্তের জন্য। তবে তারা এই প্রস্তাব মানবে কিনা সেটা তাদের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়।