বাঙাল বনাম ঘটি
বাঙাল – ঘটির যুদ্ধ আজ বহু বছর ধরে চলে আসছে এই বাংলায়।বাঙাল ঘটির এই ঝগড়া রেষারেষি , এসব খানিকটা খুনসুটি। এপার বাংলার উত্তর কলকাতা সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যুগের পর যুগ ধরে যারা রাজত্ব করছে তাদের ঘটি বলে এবং অপার বাংলা থেকে দেশভাগের সময় যে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি এসে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস স্থাপন করেছে তাদের বাঙাল বলে। চায়ের দোকান হোক কি অফিসের ক্যান্টিন, বা লোকাল ট্রেনে কিংবা পাড়ায় পাড়ায় সবজায়গায় যে বিষয় আজও বাঙালির জীবনে সরগম তোলে তা হলো ঘটি বনাম বাঙাল। ঘটি বাঙালের এই লড়াই দেশভাগের পর থেকে শুরু হলেও তা থামার সম্ভাবনা খুব একটা নেই।এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে আচার, ব্যবহার, খাবার, সংস্কার আলাদা হলেও তারা আজ এত বছর ধরে একসাথে পথ চলতে চলতে কখন যে এক হয়ে গেছে তা বলতে পারা খুব কঠিন। কিন্তু যেকোনো বিষয়ে বিনা অজুহাতেই ঝগড়া করতে দুপক্ষই সামিল হয়ে যাই অত্যন্ত আনন্দের সাথে। দুপক্ষই দুপক্ষকে খোঁটা দেয় যে কোনো কাজে।
ভুড়িভোজে ঘটি – বাঙাল
ভুরিভোজে তো তাদের ঝগড়ার অন্ত নেই। রান্নাঘরকে নিয়েই তো তাদের ঝগড়ার প্রধান বিষয়। এবিষয়ে কেউ কারোর চেয়ে কম যাই না। বাঙালরা বলে ঘটিরা সব খাবারে চিনি দেয় গেঁড়িগুগলি খাই। এদিকে ঘটিরা বাঙালদেরকে খোঁটা দিয়ে বলে তারা বনজঙ্গল থেকে এনে চুলকানিপাতা খাই , পঁচামাছ শুঁটকি খাই ।ঘটিদের ডিশ হল- আলুপোস্ত,মাছের টক,কাতলা কারী,রুই পোস্ত ইত্যাদি বহু পদ। বাঙালদের ডিশ হল-কচুলতি ইলিশের মাথা দিয়ে, শুঁটকি মাছ, চচড়ি ইত্যাদি। তবে ঘটি আর বাঙালদের সবচেয়ে প্রিয় ডিশ এর মধ্যে অন্যতম হলো গলদাচিংড়ির মালাইকারী আর সর্ষে ইলিশ। বাঙালরা ঘটিদের চিংড়ি মাছ নিয়ে খোঁটা দিয়ে বলে চিংড়ি তো জলের পোকা। কিন্তু খাদ্য প্রিয় বাঙালির কাছে এই দুই আইটেমই অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু যতই ঝগড়া হোক না কেন এখন ঘটির হেঁসেলে ঢুকে পড়েছে কচুর লতি , পুঁইশাক আর বাঙালের হেঁশেলেও ঢুকে পড়েছে আলুপোস্ত, গুগলি ইত্যাদি বহু পদ।
সৌজন্যে : jiyo bangla সৌজন্যে: jiyo bangla
খেলাধুলা (ইস্ট বেঙ্গল বনাম মোহনবাগান)
বাঙাল – ঘটি মানেই ইস্টবেঙ্গল – মোহনবাগান। এ নিয়েও তাদের বিতর্কের শেষ নেই। খেলার মাঠের থেকে শুরু করে বাড়িতে ও পাড়ায় পাড়ায় চলে ব্যাঙ্গ,বিদ্রুপহাসিঠাট্টা। কিন্তু আজ ইস্টবেঙ্গলে ঘটি খেলোয়াড় যেমন খেলে তেমনিই মোহনবাগানে ইস্টবেঙ্গেলের খেলোয়াড়ও খেলে।এখন অনেকে বাঙাল হয়েও মোহনবাগানের সমর্থন করে এবং ঘটি হয়েও অনেকে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থন করে। কিন্তু খেলার মাঠে এখনো চলে ইট -পাটকেল। সবুজ মেরুন আর সবুজ হলুদ আজ দুজনেই দুজনের পরিপূরক।
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বাঙাল-ঘটি
আবার পূজা অর্চনাতেও এই দুই জাতির মধ্যে মতভেদ আছে। বাঙালরা লক্ষী পুজোয় ফল মিষ্টান্নের সাথে মাছ ও উৎসর্গ করে কিন্তু অপরপক্ষে ঘটিরা পুজোতে নিরামিষ ভোগের আয়োজন করে। এই দুই জাতির ভাষা এক হলেও বিভিন্ন উচ্চারণে পার্থক্য দেখা যাই ,শব্দের প্রয়োগ হয় বিভিন্নভাবে। যেমন বাঙালরা বলে খাইমু, যাইমু, কেন, কেডা ,প্রভৃতি আর ঘটিরা বলে খাবো, যাবো, কেনো, প্রভৃতি। বাঙালরা বলে ঘটিরা আতিথেয়তা করতে জানে না বাড়িতে লোকজনএলে বিরক্তবোধ করে কিন্তু এইসব সৌজন্যতাবোধ আসে মানুষের নিজ নিজ শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে এভাবে একটা জাতকে পুরোপুরিভাবে দোষারোপ করাটা খুব কঠিন।
শেষে তাই বলা যাই,ঘটিরা যতই তাদের উদ্বাস্তু বলুক না কেন বাঙালরা জানে সব ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে এসে আবার ঘুরে দাঁড়াতে।তাদের মধ্যে আছে উদ্যম শক্তি।আর ঘটিদের মধ্যে বনেদিয়ানার ছাপ স্পষ্ট সুতরাং বিগত ১০০ বছর আগে ঘটিরা তাদের যতই অপমান করুক পাশের জায়গাটা কিন্তু তারা ছেড়ে দিয়েছে তাইতো দুই জাতি একসাথে কাঁধে কাঁধ দিয়ে হাঁটছে। এখন প্রায় দেখা যাইঘটি পরিবারের সাথে বাঙাল পরিবারের বন্ধুত্ব। ঘটি বাঙালের মধ্যে বিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি। ঘটি বাঙালের এই মিষ্টি লড়াই চলুক চিরন্তন। মানুষ তা উপভোগ করে আনন্দের সাথে। এই দুস্টু মিষ্টি ঝগড়া নিয়ে চলুক না এই সম্পর্ক তাতে কি যাই আসে এই দুই জাতের মধ্যে থাকুক অটুট ভালোবাসা এবং ১০০ শতাংশ বাঙালিয়ানা বোধ। এই দেশে প্রচুর কবির জন্ম হলেও তাদের অনেকের জন্মভিটে কিন্তু বাংলাদেশে। এপারে যেমন আছে রবীন্দ্রনাথ , ওপারে তেমনি জীবনানন্দ দাশ। যাই হোক,এপার বাংলা আর ওপার বাংলা মিশে গেছে এই দুই জাতের বাঙালির রক্তে। স্বাধীনতার সময় দুই গোষ্ঠীর শত শত মানুষ প্রাণ দিয়েছে।প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের একটি লাইন বলা যাই –
আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি
বিনম্র শ্রদ্ধায়
মেশে তেরো নদী সাথে সাগরের জল
গঙ্গায় , পদ্মায়।
আমি বাংলার গান গাই – প্রতুল মুখোপাধ্যায়
শেষে রবীন্দ্রনাথের কথায় বলা যাক –
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর