গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তাদের অভাবনীয় সাফল্যের পর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভেবেছিল এই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা স্রেফ সময়ের ব্যাপার। যদিও খুব দ্রুত তাদের সেই ভুল ভেঙে যায়। তারপর থেকেই তারা ২০২১ এর বিধানসভা ভোটকে লক্ষ্য রেখে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে। এই মুহূর্তে রাজ্য বিজেপির সঙ্গে সঙ্গে তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও পাখির চোখ হলো অধরা মাধুরীকে নিজেদের দখলে নিয়ে আসা। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করা। আরএসএসের কোনো কোনো তাত্ত্বিক নেতা মনে করেন বাংলাকে জয় করতে পারলে তবেই বিজেপির ভারত বিজয় সম্পূর্ণ হবে!
একটা কথা বিজেপি নেতৃত্ব খুব পরিষ্কার করে বুঝে গিয়েছে তা হল পশ্চিমবঙ্গকে নিজেদের দখলে নিয়ে আসা খুব একটা সহজ নয়। তার জন্য রীতিমতো পরিকল্পনার প্রয়োজন আছে। সেই মোতাবেক বিজেপি নেতারা ইতিমধ্যেই ময়দানে নেমে পড়েছে। আমরা বরং আলোচনা করে দেখি সেরা কোন ৫ টি রণকৌশলের মাধ্যমে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে সফল হবে।
১) মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদান
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের সময় মতুয়া জনগোষ্ঠীর ভোট একচেটিয়াভাবে বিজেপি পেয়েছিল। লোকসভা ভোটে মতুয়াদের এভাবে ঢেলে বিজেপিকে সমর্থন করার কারণ হলো ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে পরিষ্কার ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ থেকে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের তারা শরণার্থী মনে করে এবং তাদের বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব দেবে। এই মানদণ্ড অনুযায়ী নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় মতুয়ারা বিজেপিকে সমর্থন করে। পরবর্তীকালে এনআরসি আইন পাস হলেও তা এখনও বলবত করতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। ইতিমধ্যেই বিধানসভা ভোট এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছে অথচ মতুয়ারা এখনো নাগরিকত্ব পায় নি। এখনো পর্যন্ত নাগরিকত্ব না পাওয়ায় ক্ষোভে তারা বিজেপির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে গেলে মতুয়া জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়া বিজেপির পক্ষে খুবই জরুরী। এই রাজ্যের প্রায় ৬০ টি বিধানসভা আসনের জয় পরাজয় মতুয়া ভোটের ওপর নির্ভর করে। মতুয়া ভোট নিজেদের দখলে রাখার লক্ষ্যে অমিত শাহ, কৈলাস বিজয়বর্গীয়র মতো নেতারা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন আগামী জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই তারা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে। তাই বিজেপির উচিত বিধানসভা ভোটের আগেই মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা যাতে নাগরিকত্ব পায় সেই দিকে নজর দেওয়া।
২) শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে হাত মেলানো
শুভেন্দু অধিকারী এখনো পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেস না ছাড়লেও এটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে তিনি আর ওই দলে থাকবেন না। তবে তার পরবর্তী গন্তব্য সম্বন্ধে তিনি এখনো পর্যন্ত কিছু জানাননি। মনে করা হচ্ছে হয় তিনি বিজেপিতে যোগ দেবেন, না হলে মেদিনীপুর ভিত্তিক নিজের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গড়ে তুলবেন।
শুভেন্দু অধিকারী যদি বিজেপিতে যোগ দেয় তো ভালো, না হলেও বিজেপির উচিত শুভেন্দু যদি নতুন কোনো দল বা মঞ্চ তৈরি করে তবে তার সঙ্গে জোট বাঁধা। কারণ এই রাজ্যে কমপক্ষে ৬০ টি বিধানসভা আসনের জয় পরাজয় শুভেন্দু অধিকারীর ওপর নির্ভর করে। বাংলা দখলের লক্ষ্যে বিজেপির উচিত এই সুযোগ গ্রহণ করা।
৩) শোভন চ্যাটার্জিকে সক্রিয় করে তোলা
কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চ্যাটার্জি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিলেও সেখানে এখনো পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন তিনি। তাদের সাংগঠনিকভাবে দুর্বল দুটি অঞ্চল দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা ও দক্ষিণ কলকাতায় ভালো ফল করতে হলে শোভন চ্যাটার্জীর সক্রিয়তা অবশ্যই জরুরি। তাই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বে উচিত একুশের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে শোভন চ্যাটার্জীর সঙ্গে যাবতীয় সমস্যা মিটিয়ে ফেলা। রাজনীতির মঞ্চে বিজেপির হয়ে শোভন চ্যাটার্জীর যদি আবার সক্রিয় হন তাহলে দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ কলকাতার অনেক হিসেব নিকেশ উল্টে যাওয়া সম্ভব।
৪) রাজ্যের প্রতিটি বুথে লড়াই করার মত সংগঠন গড়ে তোলা
বিগত নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় পশ্চিমবঙ্গের ভোটে জিততে হলে সাংগঠনিক শক্তি থাকা অবশ্যই জরুরি। এখনো রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় বুথ স্তরে বিজেপির কোনো সংগঠন নেই। তাদের রাজ্য নেতৃত্তের উচিত এই জায়গাগুলিতে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা।
৫) নরেন্দ্র মোদিকে দিয়ে বেশি করে সভা করানো
দেশের বাকি অংশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা যথেষ্টই আছে। বিশেষত বিজেপির রাজ্য নেতাদের মধ্যে তেমন কোনো হেভিওয়েট নাম না থাকায় তাদের উচিত প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে রাজ্যের নানান স্থানে সভা করানো। আর তাহলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে সক্ষম হবে তারা। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির এই সহজ পথটিকে তাদের অবশ্যই বাস্তবায়িত করা উচিত।
এই পাঁচটা কারণ ছাড়াও মুকুল রায়ের সাংগঠনিক দক্ষতার ওপর ভরসা করা উচিত দিলীপ ঘোষদের। সেক্ষেত্রে তাদের লাভ হবে বলেই মনে হয়। যদিও রাজনীতির ময়দানে প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন সমীকরণ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই এই সমস্ত অনুমান যেকোনো মুহূর্তে সম্পূর্ণ বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।